মহাভারতের কথা ও অন্যান্য পুরাণের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে নৈমিষারণ্যের কথা। এক বিরাট তপোবন যেখানে মুনিরা তপস্যা করেন। সেই নৈমিষারণ্যে কুলপতি শৌণকের তত্ত্বাবধানে ১২ বছরব্যাপী এক বিরাট যজ্ঞ শুরু হয়েছে।
ঋষিরা সন্ধ্যেবেলায় যখন সারাদিনের যাগযজ্ঞ করে ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন তখন আশ্রমে আগমন হল এক পৌরাণিকের। তার নাম উগ্রশ্রবা। আগেকার দিনে এই পৌরাণিকেরাই ছিলেন কথক ঠাকুর। তারা এ রাজ্য সে রাজ্য ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ করতেন এবং মানুষের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে তাদের উপস্থাপনা করতেন।
এরা ছিল সূত অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের সাথে ব্রাহ্মণ রমণীর মিলনের ফলে এদের জন্ম। অনেকে বলেন এরাই প্রথম বর্ণসংকর। সূতপুত্র তাই উগ্রশ্রবার নাম সৌতি। তার বাবাও ছিলেন এক বিখ্যাত পৌরাণিক। তার নাম লোমহর্ষণ। তার বর্ণনা শুনে লোকেদের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত- তাই এমন নাম।
মহর্ষি ব্যাসদেব তাকে নিজের হাতে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তার প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। এহেন পিতার পুত্র সৌতি এসেছেন কথকতা করতে। তিনি সবে সবে জনমেজয়ের সর্পসত্র দেখে এসেছেন। সেখানে বৈশম্পায়নের গলায় মহাভারতের অমৃতকথা শ্রবণ করে এসেছেন। তার যেমন সেই কথা বলতে তর সইছে না, তেমনি অনেক বছর প্রবল নিয়ম নিষ্ঠা করে তপশ্চর্যা করা মুনিদেরও তার গল্প শুনতে আর দেরি পছন্দ হচ্ছে না।
কিন্তু সকলের প্রধান মহর্ষি শৌণক এখনো আসেন নি। অগ্নিসরণ গৃহে কিছু কাজ শেষ করে এসে তিনিও গল্পসভায় বসায় সবাই নড়েচড়ে বসল। যুবক সৌতি উগ্রশ্রবা কিছুটা উৎকন্ঠিত। শৌণক তাকে একটু বাজিয়ে নিতে চাইলেন। তাকে জিগাইলেন, ‘বল তো হে সৌতি তুমি ভার্গবদের কথা কী জান’?
শৌণক নিজেও ভৃগু বংশীয়। তাই তার কাছে ফাঁকি চলবে না। সৌতি ধীরে ধীরে শুরু করলেন, ‘মহর্ষি ভৃগুর স্ত্রী ছিলেন পুলোমা…’।
মহর্ষি ভৃগু সেই দশজনের একজন যাদের দিয়ে ব্রহ্মা তাঁর সৃষ্টিকার্য শুরু করেছিলেন। সৌতি এগিয়ে চললেন। তার বর্ণনায় খুশি হলেন শৌণক। ধীরে ধীরে শুরু হল মহাভারতের কথা।
পরবর্তীকালে অনেক ঐতিহাসিকেরা বলেছেন মহাভারতের অধিকাংশ প্রক্ষিপ্ত অংশ ভার্গবদের কীর্তি। তারাই মহাভারতে প্রায় জোর করেই তাদের বংশের কথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
আমরা সে আলোচনায় যাব না। আমাদের বক্তব্য হল এই যে একজন পৌরাণিক একটা গোটা সমগ্র মহাভারত কথকতা করে চলেছেন যার শ্রোতা মহাজ্ঞানী মুনিরা, তারাও মুগ্ধবৎ তার কথকতা শুনে চলেছেন এটা একবার ভেবে দেখুন। তখন মহাভারত লেখাও হয় নি কারণ সবে জনমেজয়ের কাল চলছে। পরীক্ষিৎ তো অকালমৃত।
একটা গোটা মহাকাব্য একজন মানুষ শিখে মুখস্থ করে অবিকল বলে চলেছেন। তিনি শিখেছেন তার পিতার কাছে। তিনি কাউকে শিখিয়ে যাবেন। সেই মৌখিক পরম্পরা যুগে যুগে চলতে থাকবে। এই স্মৃতি যে কী বিরাট কী ব্যপ্ত, সেইদিকে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি।
এটা অলৌকিক ভারতীয় পরম্পরা। সেইসব মানুষেরা কত স্মৃতিধর ছিলেন একবার শুধু ভেবে দেখুন। বিস্মিত হন।
শুধু ভারতবর্ষ নয়। স্মৃতি নিয়ে গ্রিকরাও খুব চিন্তা করতেন। তাদের বক্তারাও বা নাট্যকারেরা যাতে দীর্ঘক্ষণ ধরে একটানা বক্তৃতা দিতে পারে তার জন্য তারা কিছু বিশেষ পদ্ধতির আবিষ্কার করেছিলেন।
গ্রিকদের অনুকরণ করে রোমানরাও সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেন। একজন রোমান জেনারেল তার বাহিনীর সকল সৈন্যদের, ধরুন হাজার দেড়েক, নাম জানতেন এবং নাম ধরে ডাকতেন।
স্মৃতির সেই পরম্পরা প্রাচীন থেকে মধ্যযুগেও বিস্তৃত হয়েছিল। সেই কথায় আমরা পরে আসব। এখন আলোচনায় ফেরা যাক। এই যে প্রবল ও নির্ভুল স্মৃতির পরম্পরা তা যদি হারিয়ে যায় তাহলে কী হবে। ধরুন একদিন সকালে উঠে আপনি দেখলেন আপনার শৈশব থেকে গতকাল পর্যন্ত যা স্মৃতি ছিল তা হারিয়ে গেছে। কিছুই মনে পড়ছে না। তখন কী হবে? এমন ঘটনা অক্লেশে ঘটতে পারে। যাদের জীবনে ঘটেছে তাদের কথায় আমি পরে আসছি। আপাতত স্মৃতিলোপের একটা ক্লাসিক সাহিত্যিক নজির রাখা যাক।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মহাগ্রন্থ ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড’-এ মাকন্ড গ্রামের অধিবাসীদের প্লেগ হবার পর এমন ঘটনাই ঘটে। তাদের স্মৃতি হারিয়ে যায়। প্রথমে তারা তাদের শৈশবের স্মৃতি হারায়, তারপর দৈনন্দিন জিনিসপত্রের, শেষে একে অপরকে চিনতেও পারে না।
এদের মধ্যে একজন হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া সকল জিনিসের পাশে তাদের নাম লিখে রাখতে বলেন। কলা, কাঁঠাল, গরু, ভেড়া, ছাগল সব কিছুর পাশে তাদের নাম লিখে রাখা হয়। শেষে স্মৃতি আরও কমে এলে তাদের কী কাজ তাও লিখে রাখা হয়। মানে গরু কী কাজে লাগে? ছাগল কী কাজ করে? কলা একটা খাবার জিনিস।
বুয়েন্দিয়া শেষে একটা মেমারি মেশিন বানান যাতে সব ব্যক্তিগত স্মৃতি লিখে গচ্ছিত রাখা হয়। ক্রমশ সেই গচ্ছিত রাখা কাগজের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। বাড়তেই থাকে।
শেষে একজন এসে তাকে সুস্থ করে তার স্মৃতি ফিরিয়ে আনেন। বুয়েন্দিয়া প্রথমে তাকে চিনতে না পারলেও পরে বুঝতে পারেন, তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের দুঃস্বপ্নের অবসান হয়।
এই স্মৃতি একটি জটিল এনিগমা। স্নায়ুবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী সকলেই এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা করেছেন। এখনও করে চলেছেন। স্মৃতি ও তার সাথে একই তারে বাঁধা চেতনার রহস্য তারা বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে খুঁজে চলেছেন। খুব অল্পই জানা গেছে। তবু তাদের গবেষণায় ক্ষান্তি নেই।
অনেকে বলেছেন এর রহস্য ভেদ করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। এর আগে আমি চেতনা বা কনসাশনেস নিয়ে কিছু লেখা লিখেছিলাম। এবার তারই আরেক দোসর স্মৃতি নিয়ে লিখতে বসেছি। আমি বিজ্ঞানী নই। গবেষণা করি না। যারা গবেষণা করেছেন তাই তাদের কথাই বলব।
স্মৃতি কোথায় সঞ্চিত থাকে? কীভাবেই বা ফিরে আসে? কীভাবে হারিয়ে যায়? হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি কীভাবে আবার ফিরে আসে? স্মৃতির শক্তি তো আমরা সবাই জানি। তার দূর্বলতা কোথায়? কোথায় সে আমাদের বিভ্রান্ত করে? স্মৃতি নিয়ে পন্ডিতেরা কী ভেবেছেন? এসব নানান কথা আমার লেখায় আসবে।
অবধারিতভাবে আসবে সাহিত্য ও শিল্পের কথা। আসবে বিভিন্ন স্মৃতির সমস্যায় রোগাক্রান্ত মানুষদের কথা যারা গবেষণায় বিরাট ছাপ রেখে গেছেন। তাদের রহস্য এখনো উদ্ধার হয় নি বা সামান্য কিছু হয়েছে। কিন্তু সেইসব টকরো-টুকরো জ্ঞানকেই সকলে জোড়ার চেষ্টা করছেন। এ যেন এক জিগ-স্য-পাজল কিংবা ডাইনোসরের কয়েকটি হাড়ের টুকরো যা দিয়ে প্যালিয়েন্টোলজিস্ট একটা গোটা ডায়নোসরের চেহারা ভাবার চেষ্টা করছেন।
আমি আমার প্র্যাকটিসে কত মানুষ পাই যারা ধীরে ধীরে স্মৃতি হারিয়ে ফেলছেন। কেউ কেউ আছেন আছে যারা একেবারেই স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন। স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে যেসব নিরুদ্দিষ্ট বৃদ্ধদের ছবি দেখেন তারা এমনভাবেই একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে হারিয়ে গেছেন। তারা নিজেদের চেনেন না, চারপাশ চেনেন না, তাদের ভাষাও হয়ত হারিয়ে গেছে।
আমরা আজ যা কিছু হয়েছি সব স্মৃতির কারণেই। সমগ্র মানবসভ্যতা এক বৃহত্তর অর্থে দীর্ঘকালীন স্মৃতির সঞ্চয়। সেই জ্ঞান বা সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে জন্ম থেকেই সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। তাই আমাদের নিজস্ব স্মৃতিও এক অর্থে একটা বৃহৎ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্মৃতির অঙ্গ। আমরা তাকেই গ্রহণ ও বহন করে চলেছি।
সেই স্মৃতি ছড়িয়ে আছে কথকতায়, লেখায়, বইয়ে, লাইব্রেরিতে, কম্পিউটারের হার্ড ড্রাইভে। যদি সেই স্মৃতির কিছুটাও চলে যায় তবে সেই বিপন্নতা আপনি একবার অনুভব করুন! অথচ তা কিন্তু যেতেই পারে এবং তা যায়ও। বৃহত্তর ক্ষেত্রে না ভাবলেও আমি ব্যক্তির স্মৃতিতেই নিজেকে আটকে রাখতে চাইব।
স্মৃতিচারণ এক অর্থে টাইম ট্রাভেল। এই কথা বলেছেন একজন বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী। সত্যিই তাই। স্মৃতির হাত ধরে আপনি যে কোনো সময় আপনার অতীতে ঘুরে আসতে পারেন। এই স্মৃতিচারণ খুব সহজ কিন্তু নয়। আপনি ভেবে দেখুন তো আপনার শৈশবের কথা আপনি কতটা মনে রাখতে পেরেছেন? আপনার ছেলেবেলার স্মৃতি কতটা টাটকা? যদিও বা লিখে ফেলেন সেই কথা, আপনার সমসাময়িক অনেকেই দেখবেন বলবে, “এটা হয় নি। এটা তুই বানিয়ে বলছিস”। অথচ আপনার কাছে তা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার।
এটা কেন ঘটে? সত্যি কথা কে বলছেন আপনি না সেই ভদ্রলোক? আমরা সেসব নিয়ে আসব। চলুন তার আগে আমরা প্রত্যেকে নিজের স্মৃতির ক্ষমতা যাচাই করা শুরু করি। (চলবে)