অলিভার স্যাকস আমার খুব প্রিয় লেখক। উনি নামজাদা স্নায়ুচিকিৎসক ছিলেন। তেমনি দুহাত ভরে লিখে গেছেন তার সারা চিকিৎসাজীবনের দুর্লভ অভিজ্ঞতার কথা।
তার একটি বইয়ে তিনি লিখেছেন, যখন ১৯৯৩ সালে তার ষাট বছর বয়স হলো তখন হঠাৎ করেই দেখলেন তার ছেলেবেলার সব কথা প্রাঞ্জলভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে। এমন নয় যে তিনি সেভাবে তাদের কথা চিন্তা করেছেন। সম্পূর্ণ বিনা চেষ্টাতেই তার ছোটবেলার সব কথা মনে পড়তে লাগল। তিনি তখন তার স্মৃতিগুলোকে লিখে রাখলেন এবং পরবর্তী ৩ বছর ধরে সেই ধারাবাহিক স্মৃতিকে নিয়ে ১৯৯৭ সালে একটি বই প্রকাশ করলেন। তার নাম “আঙ্কল টাংস্টেন”।
সেই বইতে স্যাকস্ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুটি বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। ১৯৪০-৪১ সালে শীতের লন্ডন। জার্মান বম্বাররা মাঝে মাঝেই ‘ব্লিৎজ’ আক্রমণ শানাচ্ছে। ‘ব্লিৎজ’ একটি জার্মান শব্দ। এর অর্থ বিদ্যুৎ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্রথম দিকে আকস্মিক আঘাত হেনে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে বিরাট সুবিধেজনক অবস্থায় চলে গেছিল। তারা এর নাম দিয়েছিল ‘ব্লিৎজক্রিগ’। সেই থেকেই ইংরিজিতে এই শব্দটি আসে। স্যাকস্ নিজেও এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
তাদের বাড়ির পাশে প্রায় হাজার পাউন্ডের একটি বোমা পড়ে। সেটি ফাটে নি। আট বছরের স্যাকস্ ও তার পরিবার রাতের পোশাকেই কাকার বাড়িতে চলে যান। স্যাকস্ স্মৃতি থেকে তার অবিকল বর্ণনা দিয়েছেন।
আরেকটি ঘটনায় বলেছেন তাদের বাড়ির সামনে একটি থার্মাইট বোমা পড়ে। বোমাটি ফাটার পরে চারিদিকে আগুন লেগে যায়। স্যাকস্-এর বাবা তখন হোস পাইপ দিয়ে এবং তার দাদারা বালতি বালতি জল দিয়ে সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।
স্যাকস্ যখন বইটি প্রকাশ করেন তখন তার চেয়ে পাঁচ বছরের বড় দাদা মাইকেল তাকে বলেন দ্বিতীয় বোমা ফাটার ঘটনা তিনি চোখেই দেখেন নি কারণ সে সময় তিনি ও মাইকেল তখন সেখানে ছিলেন না। তার আরেক দাদা ডেভিড ও বাবা সেই আগুন নেভান। পরে ডেভিড এক চিঠিতে সেই ঘটনার কথা লিখে জানান। সম্ভবত স্যাকস্ সেই চিঠি পড়েন বা চিঠির কথা শোনেন। সেই থেকেই বোমা বিস্ফোরণের ভয়ংকর ঘটনা তার স্মৃতির অঙ্গীভূত হয়ে যায়। সেই স্মৃতি এতই তীব্র ছিল যে তার পক্ষে বিশ্বাস করাই অসম্ভব হচ্ছিল যে তিনি সেই সময় সেখানে ছিলেন না। আর স্মৃতিটি ততদিনে তার প্রকাশিত বইয়ের অংশও হয়ে গেছে।
এটিই হল দূরের স্মৃতির সবচেয়ে অসুবিধে। তার সবটা সত্যি কখনই নয় কিন্তু তারা আমাদের স্মৃতির সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে তাদের আলাদা করাই কঠিন।
স্মৃতি তাই যতটা না আমাদের অতীত তার সাথে আমাদের বর্তমান নিয়েও তৈরি। আমাদের বর্তমানের আবেগ, অনুভূতি, মূল্যবোধ অতীতের সাথে জড়িয়ে যায়। তারা এমনভাবে লতার মত জড়িয়ে থাকে যে তাদের আলাদা করা প্রায় অসম্ভব।
সকলেই হয়ত স্বীকার করবেন বাংলা ভাষায় যে কয়টি স্মৃতিসাহিত্য আছে তাদের মধ্যে ‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘অক্ষয় মালবেরি’ অন্যতম শ্রেষ্ঠ। এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করার মত। জীবনস্মৃতি প্রকাশিত হয় ১৩১৯ সালে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৫১। অক্ষয় মালবেরির প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। মনীন্দ্র গুপ্তের বয়স তখন ৬৫। আগেই বলেছি স্যাকস্ যখন তার শৈশবের স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন তখন তার বয়স ৬৪। পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে এমন কী কিছু ঘটে যাতে সেই শৈশবের স্মৃতি নতুন করে ফিরে আসে? স্যাকস্ তো নিজে সেই কথা স্বীকার করেই নিয়েছেন। বাকিদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী তেমন ছিল? জানার উপায় নেই কারণ তারা কেউ তা নিয়ে কিছু বলেন নি।
রবীন্দ্রনাথ কেন রবীন্দ্রনাথ তা জীবনস্মৃতির ভূমিকা পড়লেই আপনি অনুধাবন করতে পারবেন। যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কী বাদ দেয় কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোট করে, ছোটকে বড় করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।
… তাহাতে নানা জায়গায় যে নানা রং পড়িয়াছে তাহা বাহিরের প্রতিবিম্ব নহে, সে রং তাহার নিজের ভান্ডারে; সে রং তাহাকে নিজের জলে গুলিয়া লইতে হইয়াছে- সুতরাং পটের ওপর যে ছাপ পড়িয়াছে তা আদালতে সাক্ষ্য দিবার কাজে লাগিবে না’।
রবীন্দ্রনাথ নিজে আত্মজীবনী লেখার বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি মনে করতেন আত্মজীবনী লেখা এক অর্থে বিলেত থেকে আমদানি করা ফ্যাশান। সেদেশে যে কেউ অটোবায়োগ্রাফি লেখে। অর্থাৎ আত্মজীবনী যে কতটা সাহিত্যমূলক হতে পারে সে নিয়ে তার হয়ত সংশয় ছিল। কিন্তু এই মানুষটিও ৫১ বছর বয়সে এসে নিজের শৈশব নিয়ে লেখার ‘লোভ’ ছাড়তে পারেন নি। আর পারেন নি বলেই আমরা এমন একটি অসাধারণ সাহিত্য পেয়েছি।
মনোবিজ্ঞানীরা স্মৃতি নিয়ে গবেষণা করে স্মৃতির যে সময়কালের ধারাবাহিকতার অভাব, কল্পনা-বাস্তবের বিরাট প্রভেদ এবং লঘু-গুরুর গুরুত্ব নির্ণয়ে অক্ষমতার কথা বলেছেন কবি তার স্মৃতিতর্পনের শুরুতেই সেই উপলব্ধির কথা বলে রেখেছেন। নিজের মনের কোন গভীরতায় ডুব দিলে উপলব্ধি আপ্তবাক্য হয়ে ওঠে তা রবীন্দ্রনাথ না পড়লে আপনার জ্ঞানের অগোচর রয়ে যাবে। সমগ্র রবীন্দ্রনাথের সামান্য অংশ পড়াও তাই একটা অভিজ্ঞতা।
অন্যদিকে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত তার অক্ষয় মালবেরি-তে জীবন কথা শুরু করেছেন দশ মাস বয়স থেকে। যেসময় তার মায়ের মৃত্যু হয়। জীবনের ‘প্রথম স্মৃতি’ বলতে তিনি যে স্মৃতির কথা বলেছেন তা শুনুন- ‘জন্মের পরে আমার প্রথম স্মৃতিটি এই রকম মনে পড়েঃ দিনের বেলা। দুপুর গড়িয়ে গেছে অথবা তখনও বিকেল হয় নি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে অথবা সদ্য থেমেছে। রান্নাঘরের পাশের ঘরটিতে মেঝেয় পিঁড়ি পেতে একগাদা কাঁথা-বালিশের প্যাকিং দিয়ে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ঘরের মধ্যে ঘন ছায়া, মাটির মেঝের সোঁদা গন্ধ, কাঁথা-বালিশের স্যাঁতা গন্ধ, বৃষ্টির ভিজে গন্ধ। শাড়িপরা কয়েক জোড়া বিশাল বিশাল পা আমার বিছানার পাশ দিয়ে বারবার আসছে যাচ্ছে, কাছে এসে একবারও থামছে না। …’
এই স্মৃতি একজন শিশুর খুব বেশি হলে এক কি দেড় বছরের। যখন সে হাঁটতেও শেখে নি। হয়ত পাশ ফিরে সবে উল্টোতে শিখেছে, তাই এই প্যাকিং-এর ব্যবস্থা। পিঁড়িতে প্যাকিং দিয়ে রাখা। তাই তার আকৃতিও সামান্য। এই বিশেষ স্মৃতিটি আমাকে খুব আকর্ষণ করে। একজনের এত অল্প বয়সের স্মৃতি কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে? আমরা বলি শিশুদের স্নায়ুতন্ত্র পুরোপুরি তৈরি হতে মোটামোটি ২ বছর লাগে। অর্থাৎ সেই সংগঠিত হওয়া স্নায়ুর সময় স্মৃতি কিভাবে জেগে থাকতে পারে? থাকলেও সেটি কতটা তীব্র হতে পারে যে তা কবির ৬৫ বছর বয়সে এসেও জীবিত আছে?
আমি নিজের সবচেয়ে প্রাচীনতম স্মৃতির দিকে ফিরে তাকালে দেখি- ‘আমার বাবা একটা মুখোশ পরে ঘরে ঢুকেছেন। বাইরে হয়ত বিকেল বা সকাল। আমি আমাদের ঘরের ছোট্ট চৌকিতে শুয়ে আছি। সেই মুখোশ দেখে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম’। এই যে স্মৃতি এটিই যে ‘প্রথম’ তা আমি হলফ করে বলতে পারি না, আবার এটা যে ‘প্রক্ষিপ্ত’ নয় তাও বলতে পারি না। কারণ আমার মা আমার কাছে বাবার যে সামান্য কটি গল্প করেছেন তার মধ্যে এটি একটি। আমি ভয় পাওয়ায় বাবা নাকি মুখোশটিকে বাড়ির পেছনে জঙ্গলে ফেলে দ্যান। সেই গল্প শুনে আমার মন যে নিজের মত করে স্মৃতিচিত্র এঁকে নেয় নি তা আমার পক্ষে নির্দিষ্ট করে বলা খুব কঠিন।
তবে আমার মনে হয় কবি মণীন্দ্র গুপ্তেরও হয়ত ষাট বছরের কাছাকাছি এসে শৈশবের স্মৃতি জেগে উঠেছিল। যেভাবে স্যাকসের হয়েছিল। যদিও কবি তার বইয়ের কোথাও তেমন কিছু লেখেন নি।
আমিও অপেক্ষায় আছি। আর তো মাত্র ১৫ বছর। আমার স্মৃতিরাও রাতের তারার মত জেগে উঠবে। শৈশব নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন। যা আমি মা অথবা কাউকে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করতে পারি নি। সেসবের উত্তর হয়ত আমি একদিন পেয়ে যাব।
শৈশবের স্মৃতি নিয়ে আমরা অনেক কিছু বললাম। এবার স্মৃতির বিজ্ঞান ও মনের কিছু খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করব।
(চলবে)