ব্রোকা আর ওয়ার্নিক্সের আবিষ্কারের পরে এ কথা বোঝা গেল যে আমাদের মস্তিষ্কের একেকটি বিশেষ অংশ একটি বিশেষ কাজের জন্য দায়ী। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে। মস্তিষ্ক ও স্মৃতি নিয়ে গবেষণা পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে আমাদের মস্তিষ্ক-এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের নজরে আসে। তা হল আমাদের মস্তিষ্কে কোনো ব্যথার বোধ থাকে না। মানে আমাদের মস্তিষ্কে কোনো ‘পেইন রিসেপ্টর’ নেই। এসময় মৃগীর চিকিৎসার জন্য এক বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হত। মস্তিষ্কের যে অংশটা সেই মৃগীর জন্য দায়ী তাকে অপারেশন করে বাদ দেয়া হত। এই পদ্ধতি অল্পবিস্তর এখনও চলছে বলে শুনেছি।
মস্তিষ্কের যেহেতু ব্যথার বোধ থাকে না তাই লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে করোটি খুলে রুগিদের জ্ঞান থাকা অবস্থাতেই অপারেশন করা যায়। এরই সুযোগ নিয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে ওয়াইল্ডার পেনফিল্ড প্রায় হাজার জন মৃগী রুগির সার্জারি করেন এই পদ্ধতিতে। যখন সার্জারি করতেন তখন খুব অল্প মাত্রার ইলেক্ট্রোড দিয়ে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে স্টিমুলেট করে পেনফিল্ড বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া লাভ করেন।
আমাদের কানের পেছনে মস্তিষ্কের যে অংশ থাকে তার নাম টেম্পোরাল লোব। সেখানে উদ্দীপনা দিয়ে পেনফিল্ড দেখেন সেসময় রুগিরা তাদের নানান পুরনো স্মৃতির কথা বলছেন। তাই থেকে পেনফিল্ড বলেন, আমাদের চেতন ও অবচেতনের স্মৃতি সম্ভবত টেম্পোরাল লোবে সঞ্চিত থাকে। এই নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে খুব হইচই শুরু হয়।
বিরুদ্ধবাদীরা বলেন, পেনফিল্ড যাঁদের ওপর পরীক্ষা করেছেন তাঁরা সবাই মৃগী রোগে ভুগছেন। আর মৃগী রুগিদের ক্ষেত্রে মাঝেমাঝেই ভিস্যুয়াল হ্যালুসিনেশন হয়। তাই কখনই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না পেনফিল্ডের রুগিরা সার্জারির সময় তাঁদের স্মৃতি থেকেই কথা বলছেন।
এই ঘটনার পর ১৯৫৩ সালে একটা অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে যা আমাদের স্মৃতি নিয়ে ধারণাকে এক লাফে অনেকটাই এগিয়ে দ্যায়। সেই ঘটনার কথাই বলব খুব মন দিয়ে পড়ুন।
হেনরি মোলাইসন বা বিজ্ঞানীদের কাছে যিনি ‘এইচ. এম’.’ নামে পরিচিত তাঁর যখন নয় বছর বয়স তখন এক সাইকেল চালক তাঁকে এত জোরে ধাক্কা দ্যায় যে পড়ে গিয়ে তাঁর মাথায় চোট লাগে। ক্রমে সেখান থেকেই তাঁর মৃগী দেখা দ্যায় এবং ২৭ বছর বয়সে তাঁর এমন অবস্থা হয় যে মৃগীর জন্য তাঁকে বিছানায় শয্যাশায়ী হতে হয়। তাঁর চিকিৎসক স্কোভিল দেখেন যে সার্জারি ছাড়া আর উপায় নেই। এইচ. এম. যে মৃগী রোগে ভুগছিলেন সেটির নাম ছিল টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি। ঐতিহাসিকেরা বলেন জুলিয়াস সিজারও নাকি এই মৃগী রোগে ভুগতেন। তাই তাঁর জীবনের শেষের দিকে তিনি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন, সেনেটরদের ক্ষমতা খর্ব করে নিজেকে সর্বেসর্বা ঘোষণা করেন। তার ফল কী হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি।
যা হোক যখন ঠিক হল সার্জারি ছাড়া আর উপায় নেই স্কোভিল এইচ. এম.-এর দুদিকের টেম্পোরাল লোবের মাঝের অংশ কেটে বাদ দিলেন তার সাথেই হিপোক্যাম্পাস নামে একটি ছোট অংশও বাদ দ্যান। এই সার্জারির পর এইচ. এম.-এর মৃগী সম্পূর্ণ সেরে যায় কিন্তু তিনি এক মারাত্মক স্মৃতিলোপের শিকার হন।
স্নায়ুবিজ্ঞানী ব্রেন্ডা মিলনার এরপর তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। মিলনার দেখেন এইচ. এম. কে কোনো ফোন নম্বর বললে বা কোনো নতুন কিছু শেখালে তিনি খুব ভালোভাবে শিখছেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোন নম্বর বলেও দিচ্ছে কিন্তু মিনিট পনের-কুড়ি বাদে সেই নম্বর জিজ্ঞাসা করলে তিনি কিছুই মনে করতে পারছেন না। এমনকি তাঁকে যে কোনো নম্বর শেখানো হয়েছিল সেই কথাটাই তিনি মনে করতে পারছেন না। অনেক বছর পরে তিনি আয়নায় নিজেকে দেখেও চিনতে পারতেন না। তাঁর মনে তাঁর নিজের চেহারা বলতে তাঁর সার্জারির আগের চেহারাই জানা ছিল। বদলে যাওয়া মানুষটিকে তিনি চিনতে পারতেন না।
অথচ তাঁর অপারেশনের আগের স্মৃতি, তাঁর ছেলেবেলার কথা, মাথায় চোটের কথা সব মনে আছে। শুধু সার্জারির পরের কোনো ঘটনার কথাই তাঁর মনে নেই। ব্রেন্ডা তাঁকে প্রতি মাসে একবার করে ৩০ বছর ধরে দেখতে আসতেন। অথচ যখনই তিনি ঘরে ঢুকতেন এইচ. এম. তাঁকে এমনভাবে অভ্যর্থনা জানাতেন যেন তিনি তাঁকে প্রথম দেখছেন। ব্রেন্ডা খুব সুন্দর করে লিখেছেন, ‘সে (এইচ. এম.) সামান্য কিছু নতুন স্মৃতিও গড়ে তুলতে পারত না। সে বর্তমানে বেঁচে ছিল অথচ তার পা দুটো যেন অতীতের সাথে চেন দিয়ে বাঁধা। আপনারা বলতেই পারেন তার ব্যক্তিগত ইতিহাস ও স্মৃতি যেন অপারেশনের সাথে সাথেই স্তব্ধ হয়ে গেছে’।
প্রায় ৩০ বছর ধরে এইচ. এম. কে নিয়ে কাজ করে মিলনার খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্তে আসেন। এগুলো খুব মন দিয়ে পড়ুন।
*** মিলনার বুঝতে পারেন আমাদের স্মৃতির দুটি অংশ আছে। একটি ক্ষণিকের যাকে বলা হল ‘শর্ট টার্ম মেমারি’ বা ‘এস টি এম’। অন্যটি ‘লং টার্ম মেমারি’ বা ‘এল টি এম’। এস টি এম-কে আরো বলা হয় ‘ওয়ার্কিং মেমারি’। এটি আমাদের দৈনন্দিন কাজ চালাবার কাজে লাগে। আমরা প্রথমে যা শিখি তাই এস টি এম হয়ে জমা থাকে। তার পরে সেগুলো এল টি এম হয়ে দীর্ঘকালীন স্মৃতিতে জমা থাকতে পারে। আজ আপনি আপনার প্রথম কলেজে যাবার দিনের কথা, আপনার মেয়ের যেদিন জন্ম হল সেদিনের কথা বা আপনার চাকরির প্রথম দিনের কথা যখন ভাবছেন- সেগুলো আপনার এল টি এম-এ পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
*** মিলনার বুঝলেন এইচ. এম.-এর এস টি এম তৈরি হচ্ছে কিন্তু তা থেকে এল টি এম-এ রূপান্তর হচ্ছে না। সে কয়েক মিনিটের বেশি কিছুই মনে রাখতে পারছে না। এইচ. এম.-এর যেহেতু অপারেশনের আগের সব কথা মনে আছে তাই বোঝা যায় এল টি এম টেম্পোরাল লোবে জমা থাকে না। তাহলে তারা সার্জারির সাথে সাথে নষ্ট হয়ে যেত। তারা নিশ্চয়ই অন্য কোথাও জমা থাকে। আজ আমরা জেনেছি যে এল টি এম আমাদের সেরিব্রাল কর্টেক্সের বিভিন্ন অংশে জমা থাকে।
আমাদের দৃশ্যের স্মৃতি জমা থাকে মাথার পেছনে ভিসুয়াল কর্টেক্সে। স্পর্শের স্মৃতি জমা থাকে সেনসরি কর্টেক্সে। আমাদের কগনিটিভ বা বোধের স্মৃতি থাকে মাথার সামনের দিকের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে।
*** মিলনার এর পরে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত করেন। তিনি বলেন আমাদের মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এটি এস টি এম কে এল টি এম-এ পরিবর্তিত করে। যেহেতু অপারেশন করে এইচ. এম.-এর হিপোক্যাম্পাস বাদ দেয়া হয়েছে তাই তার এস টি এম তৈরি হচ্ছে কিন্তু তারা স্থায়ী এল টি এম-এ বদলে যেতে পারছে না।
স্মৃতির গবেষণার ক্ষেত্রে এই প্রতিপাদ্যগুলো একটা মাইলস্টোন ছিল। আজো আছে অপরিবর্তিতভাবে।
মিলনার যখন ভাবছিলেন এইচ. এম. হয়ত আর নতুন কিছু স্মৃতি তৈরিই করতে পারবেন না তখন তাঁকে আয়নায় ডটেড লাইন দিয়ে একটি তারা এঁকে তাঁকে পেনসিল দিয়ে যুক্ত করতে বলা হল। দেখা গেল যত দিন যাচ্ছে তাঁর আঁকা তত নিখুঁত হচ্ছে অথচ তিনি যে আগের ঘন্টায় বা আগের দিন সেটিকে এঁকেছেন সেই কথা তাঁর মনে ছিল না।
এই ঘটনা লক্ষ্য করে মিলনার ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বুঝলেন যে এস টি এম বা এল টি এম ছাড়াও আমাদের আরো দুই রকমের স্মৃতি আছে। তারা তার নাম দিলেন ‘এক্সপ্লিসিট মেমারি’ বা ‘ডেক্লারেটিভ মেমারি’- এই স্মৃতি আমাদের চেতন মনের অন্তর্গত অর্থাৎ এটি আমাদের সময়, স্থান ও লোকজন সম্পর্কে স্মৃতি বহন করে থাকে।
অন্যটি হল ‘ইমপ্লিসিট’ বা ‘প্রসেডুরাল মেমারি’। এই স্মৃতি আমাদের অচেতন মনের অন্তর্গত। এই স্মৃতি ব্যবহার করতে আমাদের কোনো চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন নেই। আপনি যখন সাইকেল চালানো একবার শিখে যাবেন তখন আপনার সাইকেল চালাতে আর ভাবতে হবে না। যিনি সেতার বাজান বা বেহালা বাজান বা হারমোনিয়াম বাজান বা কি বোর্ডে টাইপ করেন, তখন তাকে আর যন্ত্রের দিকে তাকাতে হয় না। এগুলো ইমপ্লিসিট স্মৃতি। এইচ. এম.-এর ইমপ্লিসিট মেমারি নষ্ট হয় নি কারণ সে নতুন স্কিল শিখতে পারছিল। কিন্তু তার ডেক্লারেটিভ মেমারি নষ্ট হয়ে গেছিল।
মিলনার তাই পুনরায় সিদ্ধান্ত করলেন এই ইমপ্লিসিট মেমারি নির্মাণে হিপোক্যাম্পাসের কোনো ভূমিকা নেই। আমরা আজকে জানি যে এই ইমপ্লিসিট স্মৃতির নির্মাণে আমাদের সেরিব্রাল কর্টেক্সের বিভিন্ন এলাকা সঙ্ঘবদ্ধভাবে জড়িত। কোনো নির্দিষ্ট এলাকা এর জন্য বরাদ্দ নেই।
ফ্রয়েড সেই কবে বলে গেছিলেন অচেতন মনের ক্রিয়ার কথা। ইমপ্লিসিট মেমারি আমাদের সেই অচেতন মনের উপস্থিতির কথাই প্রমান করে দিয়েছিল।
এইচ. এম. বা হেনরি গুস্তাভ মোলাইসন ২০০৮ সালে ৮২ বছর বয়সে মারা যান। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তাঁর ২১ বছর বয়সের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ছিলেন। তিনি বিয়েও করেছিলেন এবং প্রতিদিন নিজের স্ত্রীকে তাঁর ‘নতুন’ বলে মনে হত। সদাহাস্যময় এই মানুষটির চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে অবদান অসম্ভব কিন্তু তিনি নিজে কোনোদিন জানতে পারেন নি তিনি কী অসাধ্যসাধনটাই না করে গেছেন।
আমরা স্মৃতির রকমারি ও আমাদের মাথায় কোথায় তাদের অবস্থান তা নিয়ে প্রাথমিক ধারণা অর্জন করলাম। এই বৃহৎ কচকচির শেষে আমরা আবার সাহিত্য ও শিল্পের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে আসব। দেখব সাহিত্য ও শিল্প কিভাবে স্মৃতির ক্লাসিক অংশ হয়ে উঠেছে এবং স্মৃতির দূর্বলতা কীভাবে সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে।
(চলবে)
### উপরের ছবির প্রথমটি হেনরি মোলাইসনের, দ্বিতীয়টি ব্রেন্ডা মিলনারের ###