অনেক সময় এমন ঘটে আমাদের লেখা বা বক্তব্যে, শিল্পে, গানে-কবিতায় অন্যের প্রভাব পড়ে। এটা একটা খুব সাধারণ ঘটনা। কখনও এই প্রভাব খুব ছোটখাট মাত্রায় পড়ে। আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। কখনও তা এত বিরাট আকারের হয় যে তাকে আর ‘প্রভাব’ বলে ছোট করে দেখানো যায় না। তা অনুকরণের সীমা ছাড়িয়ে ‘চুরি’র পর্যায়ে উঠে যায়। আমরা বাংলায় তাকে বলি ‘কুম্ভিলকবৃত্তি’, ইংরিজিতে বলে ‘প্ল্যাজিয়ারিজম’।
একজন অন্যের লেখা তার নিজের লেখার অংশ হিসেবে প্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু যদি তিনি সেই লেখকের কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করেন, তবেই তা প্ল্যাজিয়ারিজম-এর পর্যায়ভূক্ত হতে পারে। এই সাহিত্যচুরি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গত বছর আনন্দবাজার পুজোসংখ্যায় এখনকার জনপ্রিয় কবি ও কথাসাহিত্যিক শ্রীজাতর একটি গল্প প্রকাশিত হয়। গল্পটি প্রকাশ হবার পরে অন্য এক লেখক কনিষ্ক ভট্টাচার্য আনন্দবাজারে চিঠি লেখেন যে শ্রীজাতর ‘খরগোশ ও মরুবেহাগ’ নামের গল্পটি প্রায় অবিকল তার একটি গল্পের ফটোকপি। তাই ‘প্রভাব’ পেরিয়ে তাকে ‘চুরি’ বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
শ্রীজাতও তার ফেবুর পোস্টে লিখেছিলেন সেই গল্পটি নাকি তার ২০১৬ সালে ফেবুতে নিজের লেখা একটি কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত। সেই কবিতাটিতে নাকি কনিষ্কবাবু ‘লাইক’ও করেন। অর্থাৎ তার ‘আঙ্গুলের ছাপ’ আছে ডিজিট্যাল মিডিয়ায়। কনিষ্কবাবুর গল্পটি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। শ্রীজাত তার অগণিত ফেবুর ভক্তদের প্রশ্ন করেন, আসলে কে কার চুরি করেছে তাহলে?
এটা খুব জটিল ব্যাপার। চিরকালই সাহিত্যচুরি একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। কিন্তু থিসিস চুরি? তাও নিজের এক ছাত্রের। প্রায় হুবহু। এই প্ল্যাজিয়ারিজম-এর অভিযোগ আবার উঠেছে এমন এক পন্ডিতের বিরুদ্ধে যিনি দেশে-বিদেশে সমানভাবে জনপ্রিয় তার প্রবল পান্ডিত্যের জন্য। ঘটনাচক্রে কালই তাঁর জন্মদিন গেল। আমাদের দেশে যাকে পালন করা হয় শিক্ষক দিবস হিসেবে।
অভিযোগ এনেছিলেন দর্শনের অধ্যাপক যদুনাথ সিনহা। তিনি বলেন তার ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ স্কলারশিপের জন্য জমা দেয়া থিসিসটি থেকে হুবহু তাঁর বই ‘ভারতীয় দর্শন’ এর দ্বিতীয় খন্ডে তুলে দিয়েছেন তারই শিক্ষক পন্ডিত রাধাকৃষ্ণন। এটি তঞ্চকতা কারণ কোথাও তিনি তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন নি। ঘটনাচক্রে যদুনাথবাবুর থিসিসের একমাত্র পরীক্ষক ছিলেন রাধাকৃষ্ণন এবং তিনি সেই ঐতিহ্যপূর্ণ বৃত্তিও লাভ করেন।
যদুনাথ এতেই থেমে থাকেন নি। তিনি তার ‘প্রভাবশালী’ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ১৯২৮ সালে ২০,০০০ টাকার মামলা ঠুকে দেন। রাধাকৃষ্ণনের আঁতে প্রবল ঘা লাগে। তিনিও যদুনাথের বিরুদ্ধে একলাখি মানহানির মামলা করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অধ্যাপকদের ‘পরামর্শে’ যদুনাথ তার মামলা তুলে নেন।
ওই যে বললাম প্ল্যাজিয়ারিজম খুব সহজ জিনিস নয়। এখনকারই অন্য একজন বন্ধু সাহিত্যিকের ফেবুর পোস্টে দেখলাম আনন্দবাজার নাকি শ্রীজাতর সাথে তাদের সম্পর্ক এই ঘটনার পর আংশিক ছিন্ন করেছে। যদিচ এই বক্তব্যের সত্যাসত্য আমি ঠিক জানি না।
সাহিত্যের ইতিহাসে কুম্ভিলকবৃত্তির জন্য সবচেয়ে কঠিন আঘাতের শিকার হয়েছিলেন সম্ভবত হেলেন কেলার। কেলার চোখে দেখতে পেতেন না, কানেও শুনতেন না, কথাও বলতে পারতেন না। ছয় বছর পর্যন্ত তার জীবন শব্দহীন অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। যখন অ্যানি সুলিভান তার শিক্ষিকা হয়ে এলেন তারপর তার জীবনের অভিমুখ পালটে গেল। বারো বছর বয়সেই কেলার একজন জনপ্রিয় এবং বহুপ্রসূ লেখিকায় পরিণত হন।
তার বন্ধুর এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে হেলেন তাকে ‘দ্য ফ্রস্ট কিং’ নামে একটি গল্প উপহার দেন। সেটি পরে একটি নামকরা ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়। কিন্তু সেটি প্রকাশ হবার পরে সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে সেই গল্পটি আসলে মার্গারেট ক্যানবির একটি শিশুদের জন্য লেখা ছোটগল্প ‘দ্য ফ্রস্ট ফেয়ারিস’ থেকে প্রায় অবিকল তুলে দেয়া হয়েছে। এরপর কেলারের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা হয়। বারো বছরের শিশু কেলারের মনে সেই মামলার তীব্র প্রভাব সারাজীবন ধরে ছিল।
কেলারের পাশে এসে তখনকার অনেক নামজাদা লোকেরা দাঁড়ান। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তার পক্ষে সওয়াল করে বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে অরিজিনাল রচনাগুলোই অন্যদের প্রভাব দ্বারা অনুপ্রাণিত’। পাঠকগণ আপনারা কি বেলের এই স্বীকারোক্তির মধ্যে বাঙালি হিসেবে অন্য কোনো ঐতিহাসিক সত্যের গন্ধ পাচ্ছেন না? মার্ক টোয়েন কেলারকে চিঠি লিখে সমবেদনা জানান। এমনকি লেখিকা মার্গারেটও কেলারের পাশেই ছিলেন।
অনেক পরে যখন কেলার বড় হন তখন নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, সেই গল্পটি সম্ভবত তাকে অ্যানি সুলিভান ‘ফিঙ্গার রিডিং’ করে বলেছিলেন। তারপর তার স্মৃতি থেকে তা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়। যখন তিনি গল্পটি লেখেন তখন সেই স্মৃতি ছিঁটেফোঁটাও তার মনে ছিল না।
এই যে স্মৃতির এই আশ্চর্য বিভ্রম এটা নিয়ে আমরা ‘হায় হায়’, ‘রে রে’ করি বটে কিন্তু এটা একটা খুবই সাধারণ ঘটনা। অলিভার স্যাকস তার লেখায় একে বলেছেন ‘আনকনশাস্ প্ল্যাজিয়ারিজম’ বা ‘ক্লেপটোমেন্সিয়া’- ক্লেপ্টো+ডিমেন্সিয়া। বিশেষত শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা খুবই ঘটে থাকে। তাই দেখি বীটলসের লিড গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের বিরুদ্ধে রোনাল্ড ম্যাকের গান চুরির অভিযোগ উঠলেও তিনি আদালতে ছাড় পেয়ে যান। স্যাকস্ ঠিকই বলেছেন, শিল্পী ও সাহিত্যিকেরা তাদের সৃষ্টিশীল মনের ভেতর এই প্রভাবকে জারিয়ে তুলে তাকে নিজের মত করে নেন। তাদের এই ‘অবচেতনার চুরি’ আমাদের সচেতন মনের সম্পদ হয়ে দাঁড়ায়।
এই ব্যাপারকে কেই বা আর আরেক গুরুদেবের থেকে ভালোভাবে বলতে পেরেছেন- “Good writers borrow, great writers steal.” এই কথা বলে কি এলিয়ট তার পাপস্খালন করেছেন? কারণ এখনকার এক ওয়েবসাইট ‘ক্র্যাকড ডট কম’ বলেছে এলিয়টের ওপাস ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ নাকি বিভিন্ন লেখকদের বহু লেখার অংশকে জুড়ে তৈরি করা হয়েছে। ঠিক যেভাবে কোনো মুচি চামড়া দিয়ে জুতো তৈরি করেন। তাদের তালিকায় এলিয়ট ছাড়াও আছেন মার্টিন লুথার কিং, এইচ জি ওয়েলস প্রমূখ ব্যক্তিরা। কী বলবেন আপনি?
স্যাকস্ তার লেখায় আরেক দিকপাল কবির ঘটনা উল্লেখ করেছেন তার নাম স্যামুয়েল কোলরিজ। এটি লেখার সময় তিনি কোলরিজের প্রখ্যাত জীবনীকার রিচার্ড হোমসের দু-খন্ডে লেখা কোলরিজের জীবনীর সাহায্য নিয়েছেন। কোলরিজ ছিলেন একজন অসম্ভব স্মৃতিধর মানুষ। তিনি প্রচুর পড়তেন এবং সেগুলোকে স্মৃতিতে অবিকল ধরে রাখতে পারতেন। তার সম্পর্কে বলা হত তিনি সকালে উঠে চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে ‘দ্য টাইমস’ পড়তেন এবং পরে তাকে জিজ্ঞাসা করলে বিজ্ঞাপন সমেত যে কোনো খবর মুখস্থ বলতে পারতেন।
এহেন স্মৃতিধর কোলরিজ যিনি কিনা তার কবিতার সৌন্দর্য ও গঠনের নিপুণতার জন্য আজও রসিকের নয়নের মণি তার বিরুদ্ধে প্ল্যাজিয়ারিজম-এর গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। যদিও সেই সময় রোমান্টিক কবিদের মধ্যে এই ভাবের আদান-প্রদান স্বাভাবিক ছিল। সপ্তদশ শতকে শেক্সপীয়র ও মিলটন তাদের সমসাময়িকদের রচনা থেকে এন্তার ভাব ও বিষয়ের আদান প্রদান করেছেন। অষ্টাদশ শতকে কোলরিজ ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ যুগ্মভাবে কবিতার বই প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু সমস্যার উদ্ভব হয় পরে। যখন কোলরিজের সাথে ওয়ার্ডসওয়ার্থের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। কোলরিজ নিজের ক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ ও অবসাদে নিমজ্জিত। পাশে কেউ নেই। নিজেও অতিরিক্ত মাত্রায় আফিমের নেশায় ডুবে যাচ্ছেন। এই সময়ে তার সহায় হয়ে ওঠে দুই জার্মান দার্শনিক। তাদের লেখা কোলরিজকে অত্যন্ত প্রভাবিত করে। তিনি তাদের লেখার ভাব পরে প্রায় অবিকল রূপে নিজের নামে ইংরিজিতে প্রকাশ করেন। হয়ত আফিমের নেশার কারণে, হয়ত তার প্রবল স্মৃতির জন্য অবচেতন থেকে সেই ভাব অপরিবর্তিতভাবে উঠে এসেছিল- আমরা তা জানি না। আমরা শুধু জানি এমনটা হয়। স্মৃতির এই দূর্বলতাকে সৃষ্টিশীল মানুষগুলোর ক্ষেত্রে আমরা স্বাভাবিক বলেই ধরি।
সবার কথাই হল আর গুরুদেবের কথা হবে না তা কিভাবে হয়? শঙ্খবাবু তো বলেই গেছেন সবখানে রবীন্দ্রনাথকে টেনে নামানো আমাদের বদভ্যাস। গুরুদেবের এক মাস্টারপিস ছোটগল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অনেক নিন্দুক মনে করেন এডগার অ্যালান পোর নাকি একটা লেখার অনুকরণে রচিত। কোন লেখা আমি বলতে পারব না। পো আমার সেভাবে পড়া নেই। আমাদের ছোটবেলার আরেক নায়ক সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ভৌতিক গল্পগুলো প্রায় সবই নাকি ‘বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে’ লিখিত। অথচ মানিকবাবু কোথাও সেই কথা উল্লেখ করেন নি। বাংলাদেশের আরেক জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ তার বাংলার শ্রেষ্ঠ ভূতের গল্পসংকলনের ভূমিকায় সত্যজিতের গল্পের সাথে তার গল্পের তুলনায় এ ব্যাপারে তাকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন।
সুতরাং হে পাঠক, কুম্ভিলকবৃত্তি আপনি যতটা মনে করেন ততটা সহজ ব্যাপার নয়। আমাদের মনের আর স্মৃতির বহু না জানা রহস্য লুকিয়ে আছে এর মধ্যে। তাই এসব পড়ে আমি যখন আমার লেখায় ‘পুকুর চুরি’র কথা ভাবি তখন আমার এই ভেবে শান্তি হয় যে আমি হয়ত এর মাধ্যমে ধীরে ধীরে এলিট সাহিত্যিক মহলে প্রবেশ করছি। আমাদের স্মৃতির এই দূর্বলতা নিয়ে আরো কিছু কথা আছে। আলোচনা দীর্ঘ হবে বলে সেসব নিয়ে পরের পর্বে আসছি।
(চলবে)