কুম্ভিলকবৃত্তি যে শুধুমাত্র সাহিত্যেই হয় তা নয় রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেও মাঝেমাঝেই এই অভিযোগ ওঠে।
কয়েক বছর আগে এমনই অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কংগ্রেসের কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে। ইনি সুন্দরী যেমন তেমনই বাগ্মী। সংসদে এই দলের শুধুমাত্র এনার বক্তব্যই মাঝে মধ্যে শুনতে পাওয়া যায়। এই সাংসদ ২০১৯ সালে তার প্রথম সংসদীয় ভাষণে এই কথার উল্লেখ করেন যে শাসকদল যেরকমভাবে সকলের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা করছেন, তা একপ্রকার ‘সেভেন সাইনস অফ আর্লি ফ্যাসিজম’।
তার বক্তব্যের পর চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে যায়। জি নিউজের এক সঞ্চালক মহুয়া মৈত্রের এই উক্তিকে ‘ওয়াশিংটন মান্থলি’তে ২০১৭ সালে প্রকাশিত সাংবাদিক মার্টিন লংম্যানের একটি রিপোর্তাজের কপি-পেস্ট বলে উল্লেখ করে তাকে প্ল্যাজিয়ারিজমের জন্য অভিযুক্ত করেন।
আশ্চর্যজনকভাবে মহুয়া মৈত্র আমাদের দেশে শাসকদলের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠলেও তার ত্রাতা হয়ে ওঠেন স্বয়ং লংম্যান। তিনি ট্যূইট করেন, “আমি এখন ভারতে একজন আন্তর্জাল-খ্যাত লোক। কারণ একজন রাজনীতিবিদকে সেখানে আমার বক্তব্য চুরির দায়ে মিথ্যেই ফাঁসানো হচ্ছে। এটা বেশ মজার ব্যাপার। এই ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে দক্ষিণপন্থী পোঁ…মারানোরা সব দেশে একই ভূমিকা পালন করে”।
মহুয়াদেবী এই ঘটনায় ছাড় পেয়ে গেলেও আরেকটি তঞ্চকতার গল্প নিয়ে স্বয়ং লংম্যানের দেশে বিরাট হৈ চৈ হয়েছিল। এই ঘটনার কথা ড্যানিয়েল স্ক্যাটার তার বইয়ে বিস্তৃত লিখেছেন।
১৯৮০ সাল। রোনাল্ড রেগন তখন রিপাবলিকান পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে লড়ছেন। তিনি তার নির্বাচনী প্রচারসভায় একটা ঘটনার কথা অনেক জায়গায় উল্লেখ করতেনঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। একজন পাইলট যখন তার ফাইটার প্লেন শত্রুর বোমার আঘাতে প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তখন দলের সবাইকে বলেন প্যারাস্যুট পরে ঝাঁপ দিতে। কিন্তু একজন ‘বেলি গানার’ এত আহত হয়েছিল যে তার পক্ষে আর নামা সম্ভব হচ্ছিল না। (আপনারা হয়ত জেনে থাকবেন এই ‘বেলি গানার’ অসম্ভব বিপজ্জনক ও কষ্টকরভাবে ফাইটার প্লেনের পেটের কাছে ছোট্ট একটি জায়গায় কোনোমতে পা ভাঁজ করে বসে গুলি চালাতেন।) তখন সেই উইং ক্যাপটেন বলেন, ‘বেশ আমরা তাহলে সবাই নাহয় একসাথেই প্লেন নিয়ে নামার চেষ্টা করি’।
এই ঘটনার উল্লেখ করার সময় রেগনের চোখে জল চলে আসত। তিনি জনসমক্ষে চোখের জল মুছতেন। হলিউডি সিনেমার অভিনেতা রেগনের পক্ষে বক্তব্যের মাঝে চোখে জল নিয়ে আসা এমন কিছু মারাত্মক কঠিন ব্যাপার ছিল না। সম্ভবত তিনিও যেহেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই ঘটনার উল্লেখ করে তিনি জনসমক্ষে চিরকালীন জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যেমন কিছুদিন আগে আমাদের দেশের ‘একজন বড় মাপের নেতা’ বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় সত্যাগ্রহী হিসেবে তার জেলে যাবার কথা বলে বিতর্কিত হয়েছিলেন।
রেগনের বক্তব্যের পরেই সকলে বুঝতে পারে এই ঘটনাটি আসলে একটি জনপ্রিয় ইংরিজি ছবি ‘আ উইং অ্যান্ড আ প্রেয়ার’-এর অংশবিশেষ। রেগনের ডিমেনসিয়া শুরু হয় আশি বছর বয়সে এসে। সেইসময় তার এসবের প্রশ্নই নেই। যদিও তাতে আর কি এসে গেল? রেগন সেই বছরই পরপর দুবারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে যান। অনেকে বলেন রেগন তার সময়কালে বেশ কয়েকবারই এমন নাটকীয় মুহূর্তের সৃষ্টি করেছিলেন। যা সম্ভবত সিনেমার প্রাক্তন নায়ক হিসেবে তার অবচেতন স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলত।
তার ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে ফ্রয়েড এমন অনেক মনোরুগির সিটিং নিতেন যারা এসে দাবি করত তারা ছোটবেলায় অন্যের যৌন বিকৃতির শিকার। প্রথমে তিনি তা খুব গুরুত্ব দিয়ে বিচার করলেও পরে দেখলেন তারা অধিকাংশই ব্যাপারটা ‘কনফ্যাবুলেট’ করছে বা বানিয়ে বলছে। অথচ তারা যে সত্যি কথা বলছে না এটা তাদের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে না। স্যাকস বলেছেন এদের যদি ‘লাই ডিটেক্টরে’ বসানো যায় বা ‘ব্রেন ম্যাপিং’ করা যায় ‘এফ-এম আর আই মেশিনে’- মেশিনেরাও বলবে যে তারা সত্যি কথাই বলছে। বুঝে দেখুন। যারা ‘মিথ্যে’ বলছে তাদের ‘মিথ্যে’ ধরারও কোনো আইনি উপায় নেই।
এমনই এক মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হন অস্ট্রেলিয়ার মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড থমসন। তিনি সবেমাত্র আমেরিকার অন্য একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর সঙ্গে যৌথ গবেষণা করে সবে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেছেন, হঠাৎ করে একদিন পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় কারণ কোনো এক মহিলা নাকি তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন। ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান থমসন। যদিও তার এক জবরদস্ত অ্যালিবাই ছিল। মহিলাটি তাকে ধর্ষণের যে সময় উল্লেখ করেন সেই সময় তিনি টিভিতে ‘আমাদের স্মৃতির দূর্বলতা’ শীর্ষক লাইভ একটি আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখছিলেন। সুতরাং এই যুক্তিতে তিনি বেকসুর খালাস পেয়ে যান। পরে জানা যায় মহিলাটি যেসময় ধর্ষিতা হন তখন টিভিতে সেই অনুষ্ঠানটিতে থমসনের বক্তব্যই দেখাচ্ছিল। থমসনকে টিভিতে দেখে ওই মহিলাটির মন তাকেই ধর্ষকের ভূমিকায় বসিয়ে দেয়। সবাই কিন্তু তা বলে থমসনের মত ভাগ্যবান নাও হতে পারে।
কি সাঙ্ঘাতিক ভেবে দেখুন! আমাদের সার্জারির একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তার প্রৌঢ়ত্বে এসে এমনই একজন মহিলা যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনে। আমি মনের দিক থেকে ওই সদাচারি মানুষটির এহেন কাজের কোনো ব্যাখ্যাই পাই নি। আজ বুঝতে পারি এগুলো সম্ভবত এমন কারো অবচেতন মনের স্মৃতিবিভ্রম হলেও হতে পারে। সবটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা টাকার জন্য কাউকে ফাঁসানো নয়।
আপনারাও লক্ষ্য করে থাকবেন গত কয়েক বছর ধরেই এমন যৌন হেনস্থার অভিযোগ নিয়ে দেশে-বিদেশে অসম্ভব তোলপাড় হয়েছে। আমি কখনই বলছি না তারা সবগুলোই মিথ্যে। কিন্তু সেগুলো যে ‘কনফ্যাবুলেশন’ নয় তাও কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। স্ক্যাটার বলেছেন অভিযোগকারীর ‘ডি এন এ পরীক্ষা’ করে দেখা গেছে কিছু ক্ষেত্রে ৪০ জন অভিযুক্তের মধ্যে ৩৬ জনই নির্দোষ। ভেবে দেখুন। স্মৃতিকে আপনি কতটা বিশ্বাস করতে পারেন?
এই নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন এলিজাবেথ লফটাস। তিনি দেখিয়েছেন কায়দা করে ইচ্ছেমতো কোনো স্মৃতিকে অন্য কারো মাথায় ঢুকিয়েও দেয়া যায়। তিনি কিছু লোকদের নিয়ে পরীক্ষা করেন। তাদের সবাইকে একটা ভিডিও দেখান যেখানে একটি গাড়িকে ‘স্টপ সিগন্যালে’ দাঁড়াতে বলা হচ্ছে। কিন্তু বলার সময় কয়েকজনকে তিনি ‘স্টপ’ সিগন্যাল বললেও কয়েকজনকে ‘ইল্ড’ সিগন্যালের কথা বলেন। দেখা যায় যাদের ইল্ড সিগন্যালের কথা বলেন তাদের বেশিরভাগই পরে জিজ্ঞাসা করায় বলেন গাড়িটি ‘ইল্ড’ সিগন্যালেই দাঁড়িয়েছিল।
শুধু তাই নয় লোকেদের ওপর একই কথা বারবার বলে তিনি দেখেন তারা একদিন সেই কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে ফেলেছে। একজন কোনোদিন শপিং মলে যান নি। তাকে ‘আপনি অনেকবার মলে গেছেন’ এই কথা শোনাতে শোনাতে সে বিশ্বাসই করে ফেলেছে যে সে মলে গেছে। মলে যাওয়াটা তার স্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা, ধর্মীয় ধান্দাবাজ ও কট্টরবাদীরা বারবার এইসব মিথ্যে হিংসা ও যুক্তির উপস্থাপনা করে মানুষের মনে একে ‘সত্যি’ বলে রোপণ করে দ্যান। বিভিন্ন অপরাধীদের থেকে নিজেদের সুবিধেমত কথা আদায় করে নিতেও ভয়ঙ্কর অত্যাচার ও তার সাথে ‘ব্রেন ওয়াশ’ করে কার্যসিদ্ধি করা হয়। আবু ঘ্রায়েব-এ ইরাকিদের ওপর এমন অত্যাচারের অনেক তথ্য পরে সামনে এসেছে।
যাই হোক মোটের ওপর কিছু উদাহরণ বাদ দিলে আমাদের স্মৃতি কিন্তু খুব জম্পেশ ও মজবুত। আমরা সারাদিন এত কিছু মনে রাখি, সারাজীবন এত কিছু মনে রাখি যে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের স্মৃতি নিয়ে গর্ব করা উচিত। আবার ফিরে আসি কুম্ভিলকবৃত্তির কথায়। আমার এই লেখাটা স্বীকার না করে উপায় নেই প্রায় ৬০ শতাংশ অবিকল চুরি। ২০ শতাংশ আংশিক চুরি। ২০ শতাংশ আমার নিজের। আমার মনে হয় আমার মত মধ্যমেধার যারা প্রবন্ধ লেখেন তাদের প্রায় সকলের কাছেই ব্যাপারটা হয়ত এমনই। তাছাড়া যিনি যত বড় লেখক তার বিবলিওগ্রাফি তত লম্বা, এ তো আমরা আকছার দেখি। তাই ওসব নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। আমাকে কেউ দোষ দিলেও তাই আমি গায়ে মাখি না।
প্ল্যাজিয়ারিজমের গুরুগম্ভীর আলোচনা একটু হালকা চালেই বরং শেষ করা যাক। প্রখ্যাত কবি ও রসরাজ তারাপদ রায়কে একবার এক ইংরিজি ভাষায় উচ্চশিক্ষিতা যুবতী বলেন, স্যার আপনার বাংলায় লেখাগুলো এত জনপ্রিয়, আমি তাদের ইংরিজিতে অনুবাদ করতে চাই। তারাপদ রায় তাই শুনে রে রে করে ওঠেন। করেন কী! করেন কী! আমি আজ পর্যন্ত যা লিখেছি সবই তো ইংরিজি থেকে বাংলায় টুকে। এগুলোর ইংরিজি করা হলে তো পর্দাফাই হয়ে যাবে একেবারে।
এটাই সত্যি কথা। অন্যেরা স্বীকার করুন বা নাই করুন। আমি করে রাখলাম। আমায় পরে দোষ দেবেন না। দয়া করে আদালতে তুলবেন না। এটাই অনুরোধ।
আমার লেখা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এই লেখা লিখতে গিয়ে যতটা খাটলাম সেই তুলনায় খুব কম প্রতিক্রিয়া পেলাম। এমনই হয়। একজন লেখকের কাছে কিছু বিষয় বা কিছু রচনা অত্যন্ত প্রিয় হলেও বৃহৎ পাঠকসমাজে তার সামান্য কম্পনও হয় না। যা হোক, আমরা পরের পর্বে স্মৃতি নিয়ে একটা সামগ্রিক মূল্যায়ন করব। সেটিই হইবে আমার এই পর্যায়ের শেষ পর্ব।
(চলবে)