বিখ্যাত রোমান সেনেটর, লেখক, বক্তা সিসেরো তাঁর লেখায় একটি বিখ্যাত গল্প বলেছিলেন। তিনি সেসময় তাঁর ছাত্রদের রেটোরিক নিয়ে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। সিসেরো তাদের বললেন যে পাঁচটি রেটোরিকের মধ্যে অন্যতম হল স্মৃতি। সেই সময় গ্রিকদের দ্বারা ব্যবহৃত স্মৃতির কৌশল বোঝাতে তিনি সাইমোনিডেস-এর উদাহরণ দেন। ল্যাটিনে লেখা সিসেরোর কিছু মূল্যবান বই এখনো টিঁকে আছে। তাদের মধ্যে এটি একটি।
সাইমোনিডেস প্রাচীন গ্রিসের একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। স্কোপাস নামে একজন অভিজাত তাঁর স্তুতিতে কবিতা রচনার জন্য সাইমোনিডাসকে পারিশ্রমিক দেবেন বলে কথা দেন। নির্ধারিত দিনে স্কোপাসের বিরাট ব্যাঙ্কোয়েটে যখন তিনি কবিতাটা পাঠ করেন তখন ক্যাস্টর ও পোলাক্স নামে দুই দেবতা যারা কিনা ছিল আমাদের অশ্বিনীকুমারদের মতই যমজ ভাই তাদের নামেও কিছু স্তুতি বন্দনা করেন। চতুর স্কোপাস বলেন যেহেতু সাইমোনিডাস কিছুটা কবিতা উৎসর্গ করেছিলেন দুই দেবতাকে তাই তিনি তাঁকে অর্ধেক পারিশ্রমিক দেবেন। অর্ধেক দেবেন দুই দেবতাকে। নিরুপায় সাইমোনিডাস তাই মেনে নিলেন।
এমন সময় একজন এসে খবর দিল বাইরে দুজন যুবক সাইমোনিডাসের সাথে দেখা করতে এসেছে। যেই না সাইমোনিডাস তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বাইরে গেলেন তক্ষুনি ব্যাঙ্কোয়েটের ছাদ হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। ঘরের ভেতর স্কোপাস সহ যারা ছিল তারা সবাই পাথর চাপা পড়ে মারা গেল।
মৃতদের দেহ এমনভাবে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছিল যে তাদের আত্মীয়দের পক্ষেও সেগুলোকে পারলৌকিক ক্রিয়ার জন্য সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন সাইমোনিডাস তাঁর স্মৃতি থেকে কে কোথায় বসেছিল তা নির্ধারণ করে প্রত্যেকের দেহ আলাদাভাবে চিহ্নিত করেন। এই গল্প বলে সিসেরো তাঁর ছাত্রদের বলেন গ্রিকরা এইভাবে যে পদ্ধতিতে স্মৃতি গড়ে তুলত তাকে বলে loci বা স্থান, এবং imagines বা মানসিক ছবি। তারা স্থান এবং মানসিক ছবির মাধ্যমে কোন কিছু মনে রাখত। তাদের স্মৃতির ভাণ্ডার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এদের বিরাট ভূমিকা ছিল।
যদিও শুধু ‘লোকাই’ বা ‘ইমাজিনস’ নয় গ্রিকদের থেকে স্মৃতির ভান্ডার গড়ে তুলতে রোমানরা আরো অনেক কিছুর শিক্ষা নিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো আজ প্রায় সবই হারিয়ে গেছে। কিছু কিছু রয়ে গেছে সিসেরোর মত লেখকদের লেখার মাধ্যমে।
মনে রাখতে হবে আমরা এমন এক সময়ের কথা বলছি যে সময় কাগজ অসম্ভব মূল্যবান সামগ্রী। শুধু সাধারণ মানুষ নয় অভিজাতদের কাছেও তা দুর্লভ। তাই সকলকে অধিকাংশই শুনে শুনে মনে রাখতে হত। একজনের স্মৃতি অন্যজনে স্থানান্তরিত হত। সেনেটররা তাঁদের দীর্ঘ ভাষণ নানানরকম কায়দায় নির্ভুলভাবে মনে রাখতেন। বক্তব্যের মাঝে আটকে যাওয়া এক দুর্বলতা বলে গণ্য হত। সিসেরোর মত সেনেটর যিনি তাঁর বাগ্মীতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁর স্মৃতিশক্তিও ছিল অত্যন্ত প্রখর। এতটাই প্রখর যে আমরা হয়ত এখন কল্পনাও করতে পারব না।
স্থপতিরা বড় বড় স্থাপত্যের নকশা মুখস্থ রাখতেন। একচুল হিসেব এদিক-ওদিক হবার উপায় ছিল না। শুধু তাঁরাই নয় যাঁরা সাধারণ কর্মী তাঁরাও সব স্মৃতিনির্ভর কাজ করতেন। আমাদের প্রাচীনকালের ভারতবর্ষেও যে এর প্রচলন ছিল সে কথা তো আগেই বলেছি। ভারতীয়দের মধ্যে স্মৃতিশাস্ত্র একটি একটি অন্যতম পাঠের বিষয় ছিল।
অতীতের এক দীর্ঘ সময় পার হয়ে আমরা এমন এক সময়ে এসে পড়েছি যখন স্মৃতি একটি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। আমরা এখন একটি কি দুটির বেশি মোবাইল নম্বর মনে রাখতে পারি না। নাম-ঠিকানা, তারিখ মনে রাখতে পারি না। পারি না কারণ প্রয়োজন হয় না। সবকিছুই আমাদের মোবাইলে বা ‘গুগল ড্রাইভে’ সেভ করা আছে। আমাদের নিজস্ব স্মৃতি তাই এখন অনেকাংশেই যান্ত্রিক।
সেই কারণেই মনে হয় এখন আমরা সবকিছুই খুব সহজে ভুলে যাই। মাঝে মাঝে আমাকে রুগিরা এসে বলে ডাক্তারবাবু আপনারা খুব মেধাবী, না হয় এত এত ওষুধের নাম মনে রাখেন কীভাবে? সত্যিই সাধারণ মানুষের কাছে এটা বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও আমাদের কাছে তা প্রতিদিন ব্যবহার করায় সহজ হয়ে গেছে। দেখা গেছে একজন দাবার গ্র্যান্ড মাস্টার এক সেকেন্ডে দাবার বোর্ড দেখে সবকটি গুটি কোথায় আছে তা নির্ভুল মনে রাখতে পারেন এবং তা স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারেন। একজন শেয়ার মার্কেটের দালাল অনেক সংখ্যার শেয়ারের দর নির্ভুল বলে দিতে পারেন। অথচ দেখা গেছে তাঁরা কেউই কোনো অন্য স্মৃতি মনে রাখার ক্ষেত্রে সাধারণের চেয়ে বিরাট কিছু আলাদা নন।
আমি আমার নিজের সম্পর্কে বলতে পারি যত দিন যাচ্ছে আমি দেখছি আমার স্মৃতি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার একটি আর আমার বউয়ের একটি ছাড়া অন্য কোনো মোবাইল নম্বর মনেই রাখতে পারি না। অথচ বহু ওষুধের নাম অবিকল আমার মনে আছে। যেসব এখন আর দিই না বা চলে না তাদের নামও ভুলি নি। তাই স্মৃতির একটা প্রায়োগিক দিক আছে। আমরা সেসবই মনে রাখতে পারি যেগুলো আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।
আমরা যখন ছোট তখন মোবাইল ছিল না কম্পিউটার ছিল না। মনে আছে পরীক্ষায় কেমিস্ট্রির অঙ্ক করার সময় দশমিকের পর তিন-চার ঘর পরে অব্দি হিসেব করতে হত। আজ তো ক্যালকুলেটর নিয়ে ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে। কিছু কিছু ইউনিভার্সিটি এমন নিয়ম চালু করছে যে পরীক্ষা দেবার সময় দরকার হলে ছাত্ররা বই দেখে লিখতে পারে। তাই আমাদের স্মৃতি কমে আসছে বলে হাহাকার করে লাভ নেই। আমাদের স্মৃতির আর দরকার নেই তাই তার ব্যবহারও নেই।
উল্টে দেখি স্মৃতির দুর্বলতা একদিকে আমাদের কাছে আশীর্বাদ। অত্যন্ত শোকের ঘটনা আস্তে আস্তে ভুলে যেতে পারি বলেই আজো বেঁচে আছি। না হয় আমরা স্মৃতির দংশনে পাগল হয়ে যেতাম। প্রতি মুহূর্তে এত এত স্মৃতি ঘটে চলেছে জীবনে যে তাদের ভুলে যেতে পারি বলেই দরকারি স্মৃতিগুলো জেগে থাকতে পারে। অসম্ভব স্মৃতিধর লোকেদের কী সমস্যা তা বোর্হেস খুব সুন্দরভাবে তাঁর বহুল উল্লিখিত ‘ফুনেস দ্য মেমরিয়াস’ গল্পে ব্যক্ত করেছেন। স্মৃতির দুঃসহ ভারে বিকলাঙ্গ ফুনেস চেয়েছিল মৃত্যু।
আমার এক জেঠিমা সব সাল-তারিখ, জন্মদিন-মৃত্যুদিন, সবার চাকরিতে যোগ দেবার তারিখ আরো অনেক কিছু নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারেন। জেঠিমার এই নিউমেরিক্যাল স্মৃতির উত্তরাধিকার পেয়েছে তাঁর বড় মেয়ে। সেই জেঠিমার বড় জামাই অকস্মাৎ কোভিডে মারা যাবার পর জেঠিমার মত শক্ত মানুষও খুব ভেঙে পড়েছেন। সব সময় বলেন, আমি তো কিছু ভুলি না। জামাইবাবুর মৃত্যু, জন্মদিন, বিয়ের দিন, চাকরি চলে যাবার বছর, নতুন চাকরিতে যোগ দেবার বছর, এসব নানান স্মৃতিগুলো প্রায় প্রতিমাসে ক্যালেন্ডারে ঘুরে ঘুরে এসে তাঁর শোককে নতুন করে জাগিয়ে দিয়ে যায়। তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না।
তবে আগেও বলেছি আবার বলছি আমাদের অধিকাংশ লোকেদের স্মৃতি কিন্তু খুবই মজবুত। আমরা সারাদিন যত কিছু মনে রাখি তা এক কথায় বিস্ময়। আমাদের এই ওয়ার্কিং মেমারিই এক অর্থে এই কঠিন পৃথিবীতে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। সেটা আমাদের অগোচরে ঘটে যায় বলে আমরা তাকে পাত্তা দিই না কিন্তু সেটা যে কতটা ব্যপক তা যাঁদের বাড়ির কোনো বৃদ্ধ বাবা বা মা আলজাইমার্সে আক্রান্ত তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেন।
তবে স্মৃতিশক্তি একটি আশীর্বাদ। এটি চর্চায় বাড়ে তা প্রমাণিত। কিন্তু আমাদের যে স্মৃতি তা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। তা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। তাই অতীতের স্মৃতিকে পুরোপুরি বিশ্বাস না করাই ভালো।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় এই পৃথিবীতে ‘অরিজিনাল’ বলে কিছু হয় না। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে তো নয়ই। সকল ক্ষেত্রেই উত্তরাধিকার একটা বিরাট ব্যাপার। একজন মানুষ যিনি লেখেন বা ছবি আঁকেন সচেতন বা অচেতনভাবেই তাঁর মনে অন্য কারো সমমানসিকতার প্রতিফলন রয়ে যায়। এটি ঘটে যায়। এটি ঘটা বাধ্য। তবে যিনি নামধাম, বিষয়আশয় সহ সব টুকে দিয়েছেন তাঁকে আমি লেখক পর্যায়ে আনছি না। তিনি করণিক।
আমার ক্ষেত্রে আমি দেখেছি পড়াশুনো না হলে আমি লিখতেই পারি না। পড়তে পড়তেই আমার মনে লেখার উদ্দীপনা আসে। হয়ত একটি শব্দ, একটি ভাব তা থেকেই চেতনায় হিল্লোল চলে আসে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভারতীয় দর্শনের ওপর একটি বই পড়তে পড়তে এক জায়গায় তিনি যেখানে আত্মাকে মাকড়শার জালের সাথে তুলনা করেছেন, এটা পড়েই আমার মধ্যে একটা লেখার বীজ জন্ম নিল। আমি একটা গল্প লিখে ফেললাম। এটি তো অবশ্যই প্রভাব বা অনুকরণ। আমার মনের মধ্যে সেই সম্ভাবনা হয়ত অনেকদিন ধরেই ছিল বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ মানসিক অবস্থায় তারা একটি চেহারা নিয়ে নিল। সৃষ্টি এভাবেই হয়। তাই প্রভাবে আমি পাপ দেখি না।
তবে সেই প্রভাব নিয়ে যাঁরা তাকে নতুন ভাবে উপস্থাপিত করেন তাঁরাই শিল্পী। নতুনত্বই হল আর্ট। দেখার পার্থক্যই নান্দনিকতা। আর তা সবসময়ই অন্যের প্রভাবে প্রভাবিত। একটা সময় ছিল যখন মানুষ প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে শিল্পের সৃষ্টি করত। এখন একজন শিল্পী নিজের দিকে তাকান। তাঁর ভেতরে স্মৃতিতে ঠাসা। সেই স্মৃতির খবর তিনি নিজেও রাখেন না। আর রাখেন না বলেই জন্ম নেয় নতুনত্ব। জন্ম নেয় আর্ট।
স্মৃতি নিয়ে গবেষণা ‘পেট স্ক্যান’ বা ‘এফ-এম.আর.আই.’ আবিষ্কার হবার পরে অনেক উন্নত হয়েছে। তবুও স্বীকার করে লাভ নেই যে আমরা এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য পাই নি। স্মৃতির সাথে সাথে চলা আরেক গবেষণা হল চেতনা নিয়ে। যা নিয়ে এখনো শুধুই ধোঁয়াশা। অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা মনে করেন মানুষ কোনোদিনই চেতনার রহস্য উদ্ধার করতে পারবে না। তবুও বিজ্ঞান থেমে নেই। আমরাও উৎসুক হয়ে চেয়ে আছি সেই ফলাফলের দিকে।
গ্রন্থঋণঃ-
১। জীবনস্মৃতি- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
২। অক্ষয় মালবেরী- মণীন্দ্র গুপ্ত।
৩। Art Of Memory- F A Yates.
৪। In Search Of Memory: The Emergence Of A New Science Of Mind- Eric R. Kandel
৫। Searching For Memory- Daniel L. Schacter
৬। The River Of Consciousness- Oliver Sacks
৭। ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্য।