আমাদের সব রকমের স্মৃতির মধ্যে শৈশবের স্মৃতিই সবচেয়ে মধুর। আমরা সবাই সেই স্মৃতির দিকেই সবসময় ফিরে ফিরে তাকাই। আমাদের প্রত্যেকের স্মৃতি কত মজবুত তা ভাবতে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের শৈশবের স্মৃতির দিকে ফিরে তাকাতে পারি।
আমার জন্ম হয় রায়গঞ্জে। ১৯৭৭ সালে। আমার বাবা এয়ার ফোর্সে খুব ভালো পোস্টে কাজ করতেন। কোনো কারণে কর্তৃপক্ষের সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। সবাই বুঝিয়েছিল না ছাড়তে। আর দু বছর কাজ করলেই দশ বছর হত। বাবা সারা জীবন পেনশন পেতেন। কিন্তু মাথায় ভূত চেপেছিল। জেদি মানুষ। ব্যবসা করবেন বলে চাকরি ছেড়ে দিলেন।
পরবর্তীকালে তার এই সিদ্ধান্ত তার নিজের এবং আমাদের সকলের পক্ষেই মারাত্মক প্রতিপন্ন হয়েছিল।
ঘড়ির দোকান দিলেন। তারপর বিয়ে। আমরা পিঠোপিঠি দুই ভাই। রোজগার সীমিত। ভাড়াবাড়ির একটা ঘরে থাকা। এখান থেকেই আমার শৈশবের স্মৃতি গড়ে উঠেছে। বিষয় দীর্ঘ করব না। কারণ এটা আমার আত্মজীবনী নয়। আমার লেখার উদ্দেশ্যটুকু চরিতার্থ হলেই যথেষ্ট।
তিনটে পাশাপাশি ঘরে আমরা তিনটে পরিবার ভাড়া থাকি। আমাদের মাঝের ঘর। ডানদিকের ঘরটা সীমা কাকিমাদের। বাঁদিকের ঘরটা মনে হয় বাপিদের। নাম আমার ঠিক মনে পড়ছে না। বাপি দাদা। আর সীমা কাকিমার ছেলে প্রণব আমার ভাইয়ের বয়সী। সামনেই তিনটে রান্নাঘর। মাঝেরটা আমাদের। মাটির উনুন। মা খুব ভালো কিছু খেতে দিতে পারত না। সকালে কাপে করে ভাতের ফ্যান খেতে দিত। কারো কাছে শুনেছিল সেটি খেলে নাকি পুষ্টি হয়।
পাশেই ছিল বিরাট কুয়ো। মাঝে একটা টিনের পার্টিশন দেয়া। ওপারে যারা বাড়িওয়ালা, তারা ব্যবহার করত। এপারে আমরা তিনটে পরিবার। স্পষ্ট মনে আছে কুয়োর পাড়ে সিমেন্ট দু ভাগে ফেটে গিয়ে তিনটে প্রায় সমান ভাগ করে দিয়েছিল। যেন তিনটে ভাগ তিনঘর ভাড়াটেদের জন্য নির্দিষ্ট।
ছোটবেলা থেকেই গোলগাল, ফর্সা আর মিশুকে হবার জন্য আমি পাড়ার লোকের কাছেই বেশি থাকতাম। আমাদের বাড়িওয়ালা কোর্টে যেতেন। কী কাজ করতেন জানি না। সকালে যখন খেতে বসতেন আমি তার খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়াতাম। তার বউমাকে আমি মেজমা ডাকতাম। তিনি গোলগোল আলুভাজা করতেন। ওটি আমার খুব প্রিয় ছিল।
তাদের উঠোনে একটা বাতাপি লেবুর গাছ ছিল। সেই গাছটিতে পাক দিয়ে আমি তাদের নাতনির একটি তিন চাকার গাড়ি চালাতাম। মেয়েটি মনে হয় আমার সমবয়সী ছিল। ওর সঙ্গ আমার খুব ভালো লাগত। অল্প বয়স থেকেই পাড়ার মেয়েদের কোলে কোলে ঘুরে তখন থেকেই নারীদের প্রতি আমার অনুরাগ গড়ে উঠেছিল।
আমাদের পাড়ার আরেকটি বাড়ি সতী ও শিখাদিদের বাড়িতে আমার খুব যাতায়াত ছিল। তার ভাই খোকনদাকে আমি ‘গুরু’ ডাকতাম। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে বাইরে বাইরে বেশি ঘুরতাম বলে আমার মুখে সমবয়সীদের তুলনায় অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ মনে হয় বেশি ছিল। পাড়ার ছেলেরা এগুলো খুব উপভোগ করত।
তবে আমার প্রিয়তম অবস্থান ছিল আমার পিসির বাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই পিসিরা ভাড়া থাকত। আমার বাবারা ছিল সাত ভাই, আর তাদের এক দিদি চম্পা। সেই পিসি তার প্রিয়তম ছোটভাইয়ের আদরণীয় বড় ছেলেটিকে তার নয়নের মণির মতই স্নেহ করতেন। শুধু পিসিই নয় পিসির দুই অবিবিবাহিত মেয়ে ও তার দুই ছেলের কাছে আমি ছিলাম খেলার ও আনন্দের একটি পুতুল।
আমি আমার শৈশবে পিসির বাড়িতে যে পরিমাণ স্নেহ পেয়েছি আমার পিসতুতো দাদা ও দিদিদের কাছে আজো যেরকম ভালোবাসা পাই- এটা আমার জীবনের একটা বিরাট পাওয়া। পিসির বড়ছেলে মানে আমার বড়দা ডাক্তারি পড়ত। পিসেমশাই-এর ঘড়ির দোকান ছিল। রিক্সা ছিল কিছু। ভাড়া খাটাতেন। আসাম থেকে উৎখাত হয়ে এসে বড় পরিবার নিয়ে ধীরে ধীরে সংসারকে গড়ে তুলেছিলেন।
পিসিদের অবস্থা আমাদের থেকে ভালো ছিল। পিসির রান্না ছিল দারুন। ওদের বাড়িতে দুবেলা খেয়ে কখনো বাড়িতে খেলে সে ভাত আমার মুখে রুচত না। মাকে বলতাম, “তুমি পিসিমণিদের মত ভাত রান্না করতে পারো না?” মার অপারগতা বোঝার বয়স আমার ছিল না। বাইরের পৃথিবীর মধুরতায় আমি এতই বিভোর ছিলাম যে সংসারের মধ্যে জমে ওঠা মেঘের খবর আমি রাখতাম না।
ছোটবেলায় আমার বাবার কোন স্মৃতি নেই। শুধু নীলসাদা একটা বুটিদার জামা যাকে মা অনেকদিন ধরে তার একমাত্র সম্পত্তি একটি ট্রাঙ্কে রেখে দিয়েছিলেন সেটিই আমার বাবার একমাত্র স্মৃতি।
একদিন দুপুরে আমরা খেতে বসেছি। মা স্নান করে একমাত্র ঘরের একটি ছোট চৌকির পাশে ছোট্ট একটি জায়গা যেটি ছিল আমাদের খাবার জায়গা সেখানে আমাদের ভাত খেতে দিয়েছে এমন সময় খাবার মাঝপথে কে এসে মাকে ডেকে নিয়ে গেল। মা ছুটতে ছুটতে বাইরে এল। আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম বাড়ির বাইরে সিমেন্টের একটি বসার জায়গা ধরে। দেখলাম দূরে মা যেন কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বসে পড়ল।
তখন আমার বছর পাঁচেক বয়স। আমার ভাইয়ের সাড়ে তিন। এই গোটা স্মৃতিতে আমি আমার ভাইকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। যেন সে আমার কাছে অদৃশ্য। অথচ সেইসময় হয়ত সেও দাদার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
বাবার শ্রাদ্ধ হয়েছিল সেজ জেঠুর বাড়ি। সেদিন সেখানে রিক্সা করে যাবার কথা আমার মনে আছে। জেঠুর বাড়ির কলপাড়ে সম্ভবত বাবার শ্রাদ্ধ হয়। আমার শ্রাদ্ধের মন্ত্রোচ্চারণের কথা কিছু মনে পড়ে। সাদা পোষাক পরে থাকার কথা মনে পড়ে।
আমার এখন মনে হয় সেইদিন আমি খুব বিষণ্ণ ছিলাম। কিন্তু আমার ফুলজেঠু যার কাছে ব্যারাকপুরে এরপরে আমরা বড় হই- তিনি এখনো বলেন, সেদিন নাকি আমি খুব আনন্দে চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। অথচ সেই স্মৃতি আমার কাছে একেবারেই নেই। এখনকার তীব্র বিষণ্ণতাকে আমি সেইসময়ের স্মৃতির সাথে মিশিয়ে নিয়েছি। অথবা আমার এখনকার ভাবলোকের সাথে সেই স্মৃতি জড়িয়ে গেছে। তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না।
এরপর আমরা ব্যারাকপুর চলে আসি ফুলজেঠুর বাড়ি। স্কুলে ভর্তি হই। সে অন্য গল্প। বড় হয়ে ওঠার গল্প। তখন আমার বয়স সাড়ে পাঁচ। ভাইয়ের চার।
শৈশবের রায়গঞ্জের সেই স্মৃতি আমাকে সবসময় তাড়া করে বেড়াতো। মামার বাড়ি, পিসির বাড়ি এরপরেও আমি বেশ কয়েকবার এসেছিলাম। এখনো আমি রায়গঞ্জ গেলে আমাদের শৈশবের পাড়ায় একবার যাবই। আমাদের থাকার ঘরটা অনেকদিন ছিল। তার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে, মাঠের পাশে দুটো বিরাট গাছের নীচে বসে বসে আমার তীব্র কান্না ঠেলে উঠত।
আজো যখন সেই কথা ভাবছি এবং তার সামান্য কিছুই লিখছি সেই তীব্র স্মৃতিতে আমার গলা ভারী হয়ে আসছে। শৈশবের একটা নির্লিপ্ত বেদনা আমার বুকের ভেতর ঠেলে ওঠে। মাও পরে কিছুতেই আর রায়গঞ্জে যেতে চাইত না। মা বলে ওখানে গেলেই মার মন খারাপ লাগে।
সেই মন খারাপের আর আনন্দময় শৈশবে ফিরে গিয়ে কিছু চিন্তা না করেই যেসব কথা আমার মনে এল তা খুবই বিক্ষিপ্ত। এদের সময়কালের ধারাবাহিকতা নেই। সবচেয়ে বড় কথা তারা প্রক্ষিপ্ত। এ নিয়ে কোনই সন্দেহ নেই যে তারা অনেক কিছুই আমার এখনকার আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে নির্মিত।
স্মৃতি ব্যাপারটাই তাই। তবু তার একটা ত্রিমাত্রিক চিত্র, রং, গন্ধ ও আবেগের জগৎ আছে। সেই রং এখনো দেখা যায়। সেই গন্ধ নাকে আসে। আর আবেগ তো সবসময় ক্ষত ও আনন্দ সৃষ্টি করে। আমি এখনো আমার পিসির বাড়ির সেই বোয়াল মাছের ঝোলের স্বাদ পাই। মার হাতের ভাত আর মিষ্টি কুমড়ো সেদ্ধর গন্ধ নাকে আসে। মাঠের পাশের দুটো বিরাট গাছের ছায়া আর পাড়ার প্রতিটি বাড়ির অলৌকিকতা অনুভব করতে পারি।
এই যে শৈশবচেতনা এটা প্রত্যেকেরই থাকে। প্রতিটি মানুষের জীবনে তার শৈশব লুকিয়ে আছে স্মৃতিতে। সেই স্মৃতি কেমন ও কতটা বিশ্বাসযোগ্য- তাই নিয়েই এবার আমরা আলোচনা করব। (চলবে)
### নিচের ছবিটি আমার বাবার চাকরি করার সময়কালীন। সময় ও অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছিল। আমি ফটোশপে ওটিকে কিছুটা পুনর্জীবিত করেছি ###