হামাসের সাম্প্রতিক ভূমিকাকে নিশ্চয়ই সমালোচনা করছে পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ। আমরাও দ্বিধাগ্রস্ত হামাস ঠিক কি চাইছে? এ ভাবে কি সত্যিই সমস্যার সমাধান সম্ভব? হামাসের কার্যকলাপ কি প্যালেস্তাইন জনগণের জন্য আরও বড় বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসছে না? Ultimately, এটা কি একটা self defeating পদক্ষেপ নয়??
হ্যাঁ, এটা ঠিক সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গীতে হামাসের কার্যপদ্ধতিকে সন্ত্রাসবাদী বা হঠকারী ছাড়া অন্য কোনও বিশেষণে অভিহিত করা মুশকিল আছে। কিন্তু, অসাধারণ অবস্থায় সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী কতটা কার্যকরী সেটাতেই তো প্রশ্ন আছে। ইস্রায়েলের রাষ্ট্রের জন্মের ঠিক আগে ঐ অঞ্চলে আরবজাতির মানুষ ছিল প্রায় ১২ লক্ষ আর খেপে খেপে জমি কিনে এবং ইঙ্গ মার্কিন সহযোগিতায় এই অঞ্চলে আগত ইহুদী সম্প্রদায়ের সম্মিলিত জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ লক্ষের কিছু কম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ইংরাজ অধিকৃত প্যালেস্তাইন অঞ্চলে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ছিল তুরস্কের অধীনে) ব্যাপক হারে ইহুদী অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের বিক্ষোভ মোকাবিলা করা হয় তিন বছর (১৯৩৬-৩৯) ধরে।অসম্ভব দমন পীড়নে, যুবদের একটা বিরাট অংশকে নিষ্ক্রিয় করা হয় লাগাতর হত্যা, জেল ও নির্বাসনের মাধ্যমে। ফলতঃ, স্থানীয় আরব প্রতিরোধ অনেকাংশেই শক্তিহীন হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালের মধ্যে সাত লক্ষের বেশি আরবকে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়। কিছু আশ্রয় নেয় সেই সময়ের জর্ডান অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে (জর্ডন নদীর পশ্চিম পাড়ে), কিছু তৎকালীন মিশর অধিকৃত গাজা অঞ্চলে, আর বাকিরা জর্ডন, সিরিয়া, লেবানন ইত্যাদি আশেপাশের দেশে এমনকি সুদূর বিদেশে। বর্তমানে প্যালেস্তেনীয়দের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ, তার মধ্যে উদ্বাস্তু হিসাবে রেজিস্ট্রিকৃতদের সংখ্যা প্রায় ৫৯ লক্ষ আর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা মোট ৫৮ টি ক্যাম্পে বাস করেন ১৫ লক্ষের বেশি মানুষ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। ইস্রায়লে আরব নাগরিকের সংখ্যা দেড় লক্ষের কিছু বেশি। নাগরিক হলেও এদের উপরে নানা বাধানিষেধ রয়েছে। IDF( Israel Defense Force)-এ এরা ব্রাত্যই ধরে নেওয়া যেতে পারে। ফলে, কম খরচে উচ্চশিক্ষা, সস্তায় বাড়ি তৈরি ও স্বাস্থ্যবীমা ইত্যাদি বিবিধ সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিতই থাকতে হয়। পূর্ব জেরুজালেমের প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ নাগরিক নয়, স্থায়ী বাসিন্দা (Parmanent resident) মাত্র, স্থায়ী বাসিন্দাদেরও কিন্তু প্রায়শই উৎখাতের সম্মুখীন হতে হয়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জনসংখ্যা প্রায় ২৭ লক্ষ যারা বর্তমানে ‘প্যালেস্তাইন অথরিটি’-র অধীনে। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে ইস্রায়েল সামরিক বাহিনীর ‘raid’ প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। গাজা একটি ছোট ফালি জায়গা ৪০ কিমি লম্বা ও ৬-১০ কিমি চওড়া মোট ৩৬৫ বর্গকিমি অঞ্চল, অথচ জনসংখ্যা প্রায় ২৩ লক্ষ। ২০০৭ সাল থেকেই অবরুদ্ধ যা এখন অবশ্যই অনেকাংশে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, প্রায় নিশ্ছিদ্রই বলা যেতে পারে। এলাকার বাইরে গিয়ে কাজের সুবিধা ভীষণভাবে সীমিত এমনকি পার্শ্ববর্তী মিশর দেশেও। প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ ক্যাম্পের বাসিন্দা, পানীয় জলের অবস্থা খুব খারাপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বেকারীর হার, প্রায় ৪৬ শতাংশ (১৮ থেকে ২৯ বয়স্কদের মধ্যে যে সংখ্যাটা প্রায় ৭০ শতাংশ)।
এর বাইরে যাঁরা আছেন তাঁদের প্রায় চল্লিশ শতাংশ আছেন জর্ডনে, ত্রিশ লক্ষের কিছু বেশি যাঁদের প্রায় তিন চতুর্থাংশ জর্ডনের নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তবে গাজার বাস্তুচ্যুতরা সেখানেও অপাংক্তেয়। সিরিয়া ও লেবাননে মোট ১০ লক্ষ প্যালেস্তেনীয় আছেন, তাঁদের অবস্থা খুব খারাপ। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বহু মানুষকে অন্যত্র পালাতে হয়েছে।সৌদি অরবে আছেন প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে দেড় লক্ষের কিছু বেশি প্যালেস্তেনীয়। এর বাইরে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি হলো দক্ষিণ আমেরিকায় চিলিতে প্রায় পাঁচ লক্ষের!!
প্যালেস্তাইন উদ্বাস্তুরা কিন্তু UNHCR (United Nation High Commissioner for Refugees)-এর আওতায় পড়েন না। ফলে বেশ কিছু অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়, যেমন নিজেদের ফেলে আসা ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার। তাব পরিবর্তে UNRWA (United Nation Relief and Works Agency for Palestine Refugees) কাজ করে এদের মধ্যে শিক্ষা স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে। গাজার প্রায় শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষের প্রধান উপার্জন হলো UNRWA-এর সাহায্য। UNRWA-এর আবার সর্ববৃহৎ contibutory state হলো USA, ট্রাম্প জমানায় যে fund অনেকটাই সীমিত করা হয় (এখনও যে বেশিদিন চালু থাকবে এমন কোনও গ্যারান্টি নেই)।
সারা পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মতে এই মুহূর্তে গৃহচ্যুত মানুষের সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এত গভীরভাবে বিপন্ন উদ্বাস্তু সমস্যা যেখানে প্রায় একটা গোটা জাতিকে শুধু বছরের পর বছর নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাটাতে হয় এক অতি অসহনীয় অবস্থা ও পরিবেশকে মেনে নিয়ে, যেখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনা সত্যিই খুব কম, এমন উদাহরণ অর কোথায় পাওয়া যাবে কিনা ঘোরতর সন্দেহ আছে। কী মনে হয় এই অতি অস্বাভাবিক অবস্থা মধ্যেও মানুষ টিকিয়ে রাখতে পারবে তার সুকোমল মানবিক বৃত্তিগুলিকে, কিংবা ধরে রাখতে পারবে ন্যায় অন্যায় বোধের চিরন্তন বিচারবুদ্ধিকে?? চিরকাল মার খেতে খেতে সারা জীবনে যদি একবারও প্রত্যাঘাত করা যায়, সেটাই যেন গোটা জীবনের পরমপ্রাপ্তি হিসাবে গণ্য হবে !! Intifada কোনও সোচ্চার কৃতিত্ব নয়, চরম সঙ্কটে অস্তিত্বের প্রমাণ মাত্র!!
ইস্রায়েল যদি তার সৈন্যবাহিনীকে বলতে পারে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রীতিনীতি মানা optional মাত্র obligatory বা বাধ্যতামূলক নয়, তাহলে অপরপক্ষের কাছে অন্য কিছু আশা করাটাই সম্ভবতঃ বাহুল্য হয়ে যায়। ‘হামাস’-এর আক্রমণে আহত নিহতরা সকলেই নিরীহ মানুষ বললে ভুল হবে, কারণ এদের অনেকেই বলপূর্বক জবরদখলকারী অন্যের জমি ও এলাকার।
‘হামাস’কে সমর্থন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। ‘হামাস’ কেন কোনও ধর্মীয় মতাবলম্বী সংঘটন বা সম্প্রদায়কে সমর্থন করার কোনও অভীপ্সা আমার নেই, সে ধর্মের নাম যাই হোক না কেন !! আর, ‘হামাস’ বা PA (ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক) কেউই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নিয়ে খুব সিরিয়স বলে মনে হয় না, সর্বশেষ নির্বাচন করা হয়েছিল ২০০৫-২০০৬ সালে। আর ফাতহার সঙ্গে দ্বন্দ্বে হামাসকে মদত দিয়ে মহম্মদ আব্বাস প্রসাশনকে গাজাছাড়া করার পিছনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানইয়াহুর ভূমিকা তো অবশ্যই ব্যাপক ও প্রায় সর্বজনবিদিত !!
কিন্তু এই জিনিসটা খুব পরিষ্কার করে বুঝতে হবে, মানুষকে দমনপীড়নের সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়ার একটাই বিপদ, ফলশ্রুতি হিসাবে যে বিস্ফোরণ ঘটবে তা হবে অতি মারাত্মক আর ফলাফল হতেই পারে অতীব বিপর্যয়কর। তুলনামূলকভাবে নিশ্চিন্ত শান্ত পরিবেশে বসে তার বিশ্লেষণ, ঠিক বেঠিক নির্ধারণ করা শুধু অসম্ভব নয়, সম্পূর্ণরূপে বাতুলতামাত্র।
বিস্ময়ের জিনিস হলো, হাজার বছরের বেশি ধরে ইহুদীদের উপর অত্যাচার, segregation এবং পরিশেষে ‘হলোকাস্ট’, এ সবই তো ঘটেছে ইউরোপে, এর মধ্যে তো আরবদের কোনও ভূমিকাই ছিল না। কিন্তু বৃটিশ মার্কিনী তৎপরতায় ইউরোপের দোষক্ষালন হলো সম্পূর্ণ নিরীহ নিরপরাধ আরবদের উৎখাত করে বিশেষতঃ আমেরিকার অতি শক্তিশালী ইহুদী লবির চাপে। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো সারা পৃথিবীর সমস্ত ইহুদীদের শতকরা ৮২ শতাংশ থাকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইস্রায়েলে, প্রায় সমান সংখ্যায় ৭০ লক্ষের কিছু বেশি করে !! ইস্রায়েল প্রযুক্তিতে যতই উন্নত হোক, আমেরিকার সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় টিকে থাকা কোনও দিন সম্ভবপর ছিল না, আর আজও নেই। সমস্যা হলো, মধ্য প্রাচ্যে আমেরিকা যেখানে হস্তক্ষেপ করেছে সেখানেই চরম সর্বনাশ ঘটেছে..ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া একের পর দেশ প্রায় ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে।
বেথেলহেমের যীশু কি ফিলিস্তিনি ছিলেন? জন্মের পর তাঁকে অত্যাচারী শাসক হেরদ-এর ভয়ে মা বাবার সঙ্গে মিশরে পালিয়ে যেতে হয়। পরবর্তী কালেও ১২ বছর বয়সের পর দীর্ঘদিন তাঁর অবস্থান ছিল অজ্ঞাত। তাহলে কি উনিও ছিলেন উদ্বাস্তু ? আর, আজ তাঁর উত্তরসূরীরাও ভিটেছাড়া, আশ্রয়হীন, দেশ থেকে বিতারিত !!!
হয়তো, এটাই নিয়তি যে যীশুদের উপরেই বারবার নেমে আসবে নিপীড়নের সুতীব্র কশাঘাত, আর বাকিরা থাকবে মূক দর্শকের ভূমিকায়……………..