১) কোন প্রাণীর কামড়ে আমাদের দেশে জলাতঙ্ক রোগ ছড়ানোর প্রমাণ আছে ?
উঃ যে যে প্রাণী থেকে এই রোগ ছড়ানোর ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে সেগুলি হল:
(ক) গৃহপালিত- কুকুর, বেড়াল;
(খ) গৃহের আশেপাশে- গরু, মহিষ, গাধা, ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল, শুয়োর, উট;
(গ) বন্যজন্তু- শেয়াল, খেঁকশিয়াল, ভালুক, নেউল।
যাদের থেকে ছড়িয়েছে বলে নথিভুক্ত হয় নি:
বাদুর, ইঁদুর জাতীয় রোডেন্ট, কাঠবেড়ালি, খরগোশ, পাখি।
২) কি ভাবে এই রোগ ছড়ায়?
উঃ সাধারণত যে যে পথে এই রোগ ছড়ায় সেগুলি হল- (ক) জন্তুর কামড়,
(খ) মিউকাস মেমব্রেন বা ছড়ে যাওয়া ত্বকে চেটে দেওয়া,
(গ) আঁচড়ে দেয়া।
বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে অন্যভাবে রোগ ছড়াতে পারে যেমন- (ক) এরোসল (রেসপিরেটারি);
(খ) অঙ্গ প্রতিস্থাপন;
(গ) গিলে খাওয়ার মাধ্যমে।
তাত্ত্বিক ভাবে যদিও মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে এই ধরণের সংক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত নেই তেমন ভাবে।
৩) শরীরে রোগজীবাণুটি বিস্তারের রাস্তাটি কি ?
উঃ এই রেবিস ভাইরাসটি অনেকগুলি স্পাইকসহএনভেলাপ যুক্ত একটি নিউরোট্রপিক ভাইরাস। স্থানীয়ভাবে কামড়ের জায়গায় মাংসপেশিতে এরা সংখ্যায় বাড়ে এবং তারপরে নার্ভ বেয়ে সুষুম্নাকাণ্ডের মধ্যে পৌঁছায়। তাই বেয়ে এরা মস্তিষ্কে চলে যায়। সেখান থেকে লালাগ্রন্থীগুলিতে পৌঁছে যায়। মনে রাখা প্রয়োজন যে এই ভাইরাস রক্তের মাধ্যমে ছড়ায় না ফলে অন্য ভাইরাস ঘটিত রোগের মতো রক্ত পরীক্ষা করে বিশেষ লাভ হয় না।
৪) কামড়ানো আঁচড়ানোর কত দিন বাদে এই রোগ হতে পারে ?
উঃ এই নিয়ে নানান রকম মিথ বা অতিকথন চালু আছে। শরীরে ভাইরাস ঢোকার ছয় দিন থেকে ছয় বছরের মধ্যে রোগ হতে পারে। গড় ইনকিউবেশন পিরিয়ড হল ৩০-৯০ দিন। মুখে কামড়ালে ইনকিউবেশন পিরিয়ড অল্প হয়, হাতে-পায়ে কামড়ালে একটু বেশি সময় লাগে।
৫) এই রোগের চিকিৎসা কি ?
উঃ রোগ একবার হয়ে গেলে সেই অর্থে কোনও চিকিৎসা নেই। মৃত্যু অনিবার্য। দুভাবে ব্যবস্থা।নেয়া হয়। একটি হল পোস্ট এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস বা কামড়ানোর পরে প্রতিষেধক আরেকটি হল প্রি এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস।
৬) পোস্ট এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস কিভাবে নেয়া হয় ?
উঃ এক্সপোজার বা কামড়ানো আঁচড়ানোর ধরণ বুঝে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়:-
(ক) ক্যাটাগরি এক- জন্তুটিকে কেবলমাত্র স্পর্শ করা হয়েছে বা খাওয়ানো হয়েছে, বা অবিকৃত ত্বকে জন্তুটি চেটে দিয়েছে – এক্ষেত্রে কোনও ধরণের চিকিৎসার প্রয়োজন নেই;
(খ) ক্যাটাগরি দুই – জন্তুটি ত্বকে হালকা করে দাঁত বসিয়েছে বা আঁচড়ে দিয়েছে কিন্তু রক্ত বেরোয় নি – এক্ষেত্রে ক্ষতস্থানের পরিচর্যা এবং সঙ্গে এন্টি রেবিজ ভ্যাকসিন নেয়া;
(গ) ক্যাটাগরি তিন – জন্তুটি এমন ভাবে দাঁত বসিয়েছে বা আঁচড়ে দিয়েছে যে রক্ত বেরিয়ে গেছে, অথবা ছড়ে যাওয়া ত্বকে চেটে দিয়েছে, অথবা মিউকাস মেমব্রেন এর সাথে লালা লেগে গেছে (যেমন মুখে মুখ দিয়ে চুমু খাওয়ার সময়) – এ ক্ষেত্রে ক্ষতস্থানের পরিচর্যা সঙ্গে এন্টি রেবিজ ভ্যাকসিন নেয়ার সাথে রেবিজ ইমিউনোগ্লোবুলিন ইনজেকশন নিতে হবে।
৭) কামড়ানোর সময় জন্তুটির কি অবস্থা ছিল তা বিবেচনা করে কি চিকিৎসার হেরফের হবে ? ধরুন যদি জন্তুটির ভ্যাকসিন নেওয়া থাকে ?
উঃ ভ্যাকসিন নেয়া জন্তু হলে যদিও রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে নানান কারণে জন্তুটির ভ্যাকসিন পর্ব সফল নাও হতে পারে। তাই ভ্যাকসিন দেয়া আছে কি নেই সেটি চিকিৎসকের বিবেচনার মধ্যে আসে না। আরেকটি চালু সমস্যা হল “খেপে গিয়ে কামড়”। খেপে গিয়ে কামড় না কি না খেপে গিয়ে কামড় এই বিষয়টি আদৌ ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কামড় কামড়ই। সবটাই সমান বিপজ্জনক হিসেবেই বিবেচিত হবে।
৮) চিকিৎসা চলাকালীন জন্তুটিকে নজরে রাখা কতটা প্রয়োজনীয় ?
উঃ জন্তুটির কামড় বা আঁচড়ের পরেই একদম সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা শুরু করা দরকার। জন্তুটিকে নজরে রাখলে একটাই সুবিধা। যদি দশদিন বাদেও জন্তুটি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে তাহলে বাকি ডোজগুলির সবটা আর নিতে হবে না।
৯) কি কি ধাপে চিকিৎসা হবে ?
উঃ তিনটি ধাপে চিকিৎসা হবে। প্রথমে ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করা। দ্বিতীয় ধাপে ভ্যাকসিন এবং তৃতীয় ধাপে ইমিউনোগ্লোবুলিন। প্রথম ধাপে ধারা বেয়ে জল পড়ছে এমন ভাবে কল খুলে তার নিচে ক্ষত স্থানকে ধুয়ে নিতে হবে এর সাথে সাবান দিয়ে ধুতে পারলে আরো ভালো। কমপক্ষে ১০ মিনিট। একেবারে খালি হাতে স্বাস্থ্যকর্মীর ক্ষতস্থান স্পর্শ না করাই ভালো। রুগী দেরী করে চিকিৎসা করতে এলেও ওই ধোয়া ব্যাপারটি যেন হয়। ক্ষত স্থানটি ভালো করে ধোয়ার পরে তাতে লোকাল এন্টিবায়োটিক বা এন্টি সেপটিক লাগানো যেতে পারে। ক্ষতস্থানটি সেলাই করা থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। ক্ষতস্থানে আর কিছু না করাই ভালো।
১০) বর্তমানে বাজারে চালু ভ্যাকসিনগুলি কতটা নিরাপদ ?
উঃ বর্তমানে বাজারে চালু ভ্যাক্সিনগুলি খুবই কার্যকর ও নিরাপদ। আগেকার ভ্যাকসিন এর মতো এলার্জি রিএকশন হয় না। খেয়াল রাখা দরকার যে বিশেষ অসুবিধে না হলে ব্র্যান্ড পরিবর্তন কাম্য নয়। যে ব্র্যান্ডের ভ্যাকসিন শুরু করেছেন সেটা দিয়েই বাকি ডোজগুলি নেয়া উচিত। আজকাল চামড়ার মধ্যে (ইন্ট্রাডার্মাল পথে) ভ্যাকসিন দেয়া হয় ফলে ব্যথা কম লাগে পরিমানেও কম দিতে হয়। গর্ভবতী মা, স্তন্যদায়ী মা, বয়স্ক, শিশু সবাই নিতে পারেন।
১১) ভ্যাকসিন এর ডোজ কি ?
উঃ আপডেটেড থাই রেডক্রস সূচি অনুযায়ী ২-২-২-০-২ রীতি মানা হয় (০- তিন- সাত- চোদ্দ- আঠাশ দিন)। দুই পুরবাহুর মাংসপেশির (ডেলটয়েড) ওপরের চামড়ায় ০.১ মিলি করে ইনজেকশন দেয়া হয়। ইনজেকশন এর পরে জায়গাটি দলাইমলাই করা উচিত নয়। খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে কোনো বিধি নিষেধ নেই কেবল মদ্যপান ও স্টেরয়েড/ক্লোরোকুইন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার বন্ধ থাকবে।
১২) প্রি এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস কিভাবে নেয়া হয় ?
উঃ যাদের জীবজন্তুর কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি তেমন মানুষজন চাইলে কামড়ের আগেই এই ভ্যাকসিন নিতে পারেন। ডোজ একই। কেবল তিনটি ডোজ (০-৭- ২১ অথবা ২৮ দিনের মাথায়) নিতে হবে। ছয়মাস অন্তর শরীরে এন্টিবডির পরিমান মাপতে হবে। সে ক্ষেত্রে কম থাকলে একটি বুস্টার ডোজ নিতে হবে। এই ভ্যাকসিন নেয়া হয়েছে এমন মানুষদের জন্তু কামড়ালে কেবলমাত্র দুটি ডোজ (০ এবং ৩) নিলেই কাজ হবে।
১৩) কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে কি কি বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে ?
উঃ কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হল-
৹ পোষা বাঁদর কামড়ে দিয়েছে – এক্ষেত্রে ওই দশ দিনের নজর রাখা নিয়মটি খাটবে না।
৹ সাতদিনের মাথায় তিন নম্বর ডোজ নেয়ায় অনুপস্থিত থেকে নদিনের মাথায় রুগী আবার এলো- সেদিন তিন নং ডোজটি দিয়ে দিতে হবে আর পরের ডোজ টি নিয়ম মেনে ২৮ দিনের মাথায় হবে। প্রথম দুটি ডোজ সময়ে নেয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৹ তিনটি ডোজ নেয়ার পরে রুগীকে আবার কোনো জন্তু কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছে – রুগী নিয়ম মেনে চতুর্থ ডোজ নেবে। যেহেতু তার তিনটি ডোজ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে তাই ইমিউনোগ্লবুলিন দিতে লাগবে না।
৹ কামড়ে রক্ত বেরিয়ে গেছিল এমন রুগী কোনকারণে কেবল ভ্যাকসিন নিয়েছে তার দশ দিন পরে ইমিউনোগ্লবুলিন পাওয়া গেল – ৭ দিনের পরে আর নিয়ে লাভ নেই।
৹ গরুর দুধ কাঁচা অবস্থায় পান করা হয়ে গেছে, গরুটি মারা গেছে – গরুর দুধ পান করে জলাতঙ্ক হয়েছে এমন ঘটনা আজ অবধি নথিভুক্ত হয় নি।
১৪) কোথায় এই রোগের চিকিৎসা পাওয়া যাবে ?
উঃ সরকারি ব্যবস্থায় কেবল বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে জলাতঙ্ক রুগীর ভর্তির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থা প্রতিটি জেলা মহকুমা ও ব্লক হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
জলাতঙ্ক একটি একশভাগ প্রতিরোধযোগ্য রোগ। পশুবাহিত রোগ দিবস (জুনোসিস ডে) উপলক্ষে সর্বসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে লিখিত।