ফ্র্যাঙ্কলি, এই রামমন্দির ইস্যু নিয়ে এক শ্রেণীর বামপন্থীদের অবস্থান দেখে আমি রীতিমতো হকচকিয়ে গেছি।
বাবরি মসজিদ প্রাথমিকভাবে মন্দির ভেঙে তৈরি হোক বা না হোক, সেটা ভাঙা অনুচিত। ইতিহাসের অমন করে রেক্টিফিকেশন হয় না। ইতিহাস-টাস ছেড়ে একেবারে গোদা উদাহরণ দিই। শুনেছি, আমার বাস আপাতত যে অঞ্চলে, যা কিনা আজকাল প্রায় কলকাতা-ই হয়ে গিয়েছে, কয়েকশো বছর আগেও তা জলাজঙ্গল ছিল, প্রায় সুন্দরবনেরই মতো। আজ যদি আমাদের এবং আশেপাশের ফ্ল্যাটবাড়ি ইত্যাদি ভেঙে রাস্তাটাস্তা বন্ধ করে জঙ্গলের পুনর্নির্মাণ হয়, সেটা খুব কাজের কাজ হয় না। কাজেই…
রামমন্দির উদ্বোধন ও তৎসংক্রান্ত আমন্ত্রণ (প্রত্যাখ্যান) নিয়ে বামেদের দলগত অবস্থানটিই, দেশের বাকি সব রাজনৈতিক দলের তুলনায়, স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ। এবং সেটিই, আমার মতে, সবচাইতে উপযুক্ত – আমার এই মত শুধু আমার বামপ্রীতির কারণেই নয়, কারণটা হলো, বামেদের অবস্থানটি নো-ননসেন্স টাইপের, কোনও ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি টাইপের ধ্যাষ্টামো তাতে নেই।
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কিছু বাম-মনস্ক গ্রুপে আমি আছি, যেখানে ফরোয়ার্ড করা মেসেজপত্র বা আলোচনার গতিপ্রকৃতি দেখলে সত্যিই বিহ্বল বোধ হয়।
যেমন ধরুন, বেশ কিছু বাবাজি আচার্যরা নাকি এই রামমন্দির উদ্বোধন বয়কট করছেন, যা দেখে এক শ্রেণীর বাম-সমর্থক উচ্ছ্বসিত। কিন্তু তাঁদের বয়কট তো নিছক টেকনিক্যাল কারণে – মন্দির নাকি অসম্পূর্ণ, তাই উদ্বোধন অনুচিত, এই তাঁদের যুক্তি – নির্মাণ সম্পূর্ণ করে যথোপযুক্ত উদ্বোধন হলেই তাঁদের আপত্তি থাকত না। বয়কটে যে বাম-সমর্থকরা উচ্ছ্বসিত, তাঁরা তখনও খুশি হতেন কি?
আবার কারও যুক্তি, মন্দিরটি তো রামলালার ওরিজিনাল জায়গা থেকে দূরে নির্মিত। তাহলে কি এটা আদতেই সেই মন্দির? বেশ। তাহলে ‘ওরিজিনাল জায়গায়’ মন্দির হলেই আর আপত্তির প্রশ্ন থাকত না?
এত সফল ইনসাফ যাত্রা, এবং তার পর এমন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের ব্রিগেড – কথা ছিল ধর্মের ইস্যু সরিয়ে বামেরা ফিরবেন মূল জায়গায়। মানুষের অধিকারের প্রশ্নগুলো আবার ফিরিয়ে আনবেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকার। সবার জন্য শিক্ষার অধিকার, শিক্ষাশেষে সবার জন্য উপযুক্ত কাজের অধিকার। সবার সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য-চিকিৎসার অধিকার। হ্যাঁ, অধিকার। কোনও দয়ার দান বা ভাতা নয়। এই দাবিগুলো নির্বাচনী ইস্যু থেকে বেশ কিছু বছর ধরেই হারিয়ে গিয়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাগামছাড়া। বেকারত্বের হার আকাশ ছুঁয়েছে। কাজ যাঁদের রয়েছে, তাঁরাও কাজ হারানোর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন – কর্মক্ষেত্রে প্রাপ্য দাবি তুলতে ভয় পাচ্ছেন। অথচ এর কোনোটিই যেন ভোট দেওয়ার মুহূর্তে ভোটারদের মাথায় থাকছে না – কোনও প্রার্থীই নির্বাচনী প্রচারের মুহূর্তে এই ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলছেন না। কথা হচ্ছে শুধুই ধর্ম নিয়ে, পাকিস্তান নিয়ে, গরু নিয়ে।
ইনসাফ যাত্রার মাধ্যমে নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রান্তিক শক্তি হয়ে পড়া বামেরা এই ভরসা দিচ্ছিলেন – বা এই সাহস দেখাচ্ছিলেন – মানুষের মূল চাহিদার দিকে নজর ফিরিয়ে আনা হবে। কেননা, ধর্ম ভাত জোগায় না, খিদে-তৃষ্ণা মেটায় না – যাঁরা ধর্ম-কেই প্রাথমিক ইস্যু হিসেবে তুলে ধরে রাজনীতি করেন, তাঁরা সেই ধর্মের আড়ালে আরও হাজারটা ইস্যু লুকোতে চান।
এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে চাইলে ওই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের দাবি নিয়েই লড়তে হবে – ব্রিগেডে গীতাপাঠের রাজনীতির মোকাবিলা আর পাঁচটা জায়গায় গীতাপাঠের আয়োজন বা দীঘায় জগন্নাথমন্দির বা জেলায় রামমন্দিরের উদ্বোধন দিয়ে হবে না, হওয়া সম্ভবই নয় – মোকাবিলা করতে হবে হাজারও মানুষের মুখে মূল চাহিদাগুলোর দাবি তোলানোর মাধ্যমে।
ইনসাফ যাত্রা সেই লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নিঃসন্দেহে।
কিন্তু দিনের শেষে, তথাকথিত শিক্ষিত বামমনস্ক-দের একাংশও যদি ইনসাফ যাত্রা ও ব্রিগেডের ভিডিও/ছবি/সেলফি পোস্ট করার বাইরে মূল বার্তাটিই আত্মস্থ করতে অক্ষম হন, তাহলে আর কোন আশার আলোটা দেখব!!
মিডিয়ার একাংশ – বা বড় অংশ – রামমন্দিরের উচিত-অনুচিত ইস্যু নিয়ে তর্কের বাইরে বেরোচ্ছেন না। অর্থাৎ তাঁদের আলোচনার অভিমুখ ওই রামমন্দিরই।
এক বাম নেতা, নাম না হয় না-ই করলাম, বাবরি মসজিদ কে বানিয়েছিলেন সেই প্রশ্নের উত্তরে দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়েছেন – ভারতের শ্রমজীবী জনগণ! খুবই সঠিক উত্তর, নিঃসন্দেহে। কিন্তু ওই একই যুক্তিক্রমে বাবরি মসজিদ ভেঙেছেন ওই ‘ভারতের শ্রমজীবী জনগণ’-ই, কেননা নেতারা তো উসকানি দেওয়া ও ঘটনার মুহূর্তে ‘আবেগমথিত’ হওয়ার বেশি কিছুই নিজহাতে করেন না। এবং রামমন্দির নির্মাণের কাজটাও ওই ‘ভারতের শ্রমজীবী জনগণ’-এর দ্বারাই ঘটল।
কিন্তু এ দিয়ে কোন্ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল? বা কোনও প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া গেল কি?
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অধিকার, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থানের অধিকারের দাবি তাহলে কি আবারও ‘ও নিয়ে পরে ভাবা যাবে’ হয়ে যেতে চলেছে?
যদি তা-ই হয়, তাহলে কিন্তু ‘ইয়ে তো পহেলা ঝাঁকি হ্যায়, কাশি-মথুরা বাকি হ্যায়’ – আরও কিছু মন্দির-মসজিদের উচিত-অনুচিত নিয়ে আলোচনার করার সম্ভাবনা খুলে যাবে। অবশ্য ততদিন যদি আলোচনা করার মতো কোনও প্ল্যাটফর্ম খোলা থাকে, তবেই।