“আজ আমি সারা নিশি থাকব জেগে,
ঘরের আলো সব আঁধার করে।
তৈরি রাখব আতর গোলাপ
এদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে।
ওরা আসবে চুপি চুপি যাঁরা দেশটাকে – “
প্রথমেই পুলিশ মিলিটারির গুলিতে যে দেড় শতাধিক আন্দোলনকারী ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে, ছাত্র আন্দোলনকে সামনে রেখে দুই ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি – বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামে – হেফাজতে ইসলাম জোট ও আওয়ামী লীগের ভয়ানক যুদ্ধে যাদের মৃত্যু হয়েছে এবং যেসমস্ত সাধারণ মানুষের দুপক্ষের যুদ্ধের মধ্যে পড়ে মৃত্যু হয়েছে তাদের প্রতি আমাদের গভীর শোক জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলন বললাম আরও বেশি করে এই জন্যে যে বাংলাদেশ জঙ্গী ছাত্র আন্দোলনের জন্যে প্রসিদ্ধ। ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তি যুদ্ধ (১৯৬৯ – ‘৭১) থেকে স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলন (১৯৯০) থেকে শাহবাগ আন্দোলন (২০১৩) থেকে বর্তমান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন (২০২৪) – প্রতিটিতেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলির ছাত্ররা ছিলেন পুরোভাগে। তারা অত্যন্ত স্পর্শ কাতর। আর বাংলাদেশে ছাত্র সমাজ যে মর্যাদা পান ওখানে গিয়ে নিজের চোখে দেখা এবং সেটা সারা বিশ্বে বিরল। তাই বর্তমান আন্তর্জাতিক – জাতীয় রাজনৈতিক – অর্থনৈতিক টালমাটালে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের মধ্যে থেকেই আলোড়নটি ঘটল।
বাহ্যিকভাবে এটি কর্মক্ষেত্রে ৫৬% কোটার বিরুদ্ধে। ১৯৭২ সালে চালু হওয়া এই সংরক্ষণ নীতিতে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চাকরি ক্ষেত্রে ৩০% সংরক্ষণ ছিল মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের পরিবার ও বংশধর দের জন্য। ১০% সংরক্ষণ ছিল মহিলাদের জন্য, ১০% ছিল পশ্চাদপদ জেলাগুলির জন্য, ৫% জনজাতিদের এবং ১% প্রতিবন্ধীদের জন্য।
এর বিরুদ্ধে ২০১৩ ও ২০১৮ তে শক্তিশালী আন্দোলন হয়। হাসিনা সরকার ২০১৮ তে সংরক্ষণ তুলে নিয়েও হাই কোর্টের নির্দেশে সংরক্ষণ পুনর্বহাল করে। যাইহোক, এতদিন শাসক দল নানা কায়দায় এই ক্ষোভটি সামলে আসতে পারলেও সাম্প্রতিক বিফল চিন সফর থেকে ফিরেই বিরোধীদের সমর্থনে ছাত্রদের সরকারবিরোধী জঙ্গী আন্দোলন ও দেশজোড়া অবরোধ দেখে মেজাজ হারিয়ে শেখ হাসিনার একটি উক্তি আন্দোলনটিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। আন্দোলনের অন্যতম শ্লোগান হয়ে ওঠে “চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার।” শেষে গুলি চালিয়ে, কার্ফু জারি করে, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, মিলিটারি নামিয়ে, হিংসা দিয়ে দমন করতে হয়।
১০ জুলাই থেকে বিএনপি র ছাত্র সংগঠন ছাত্র দলের নেতৃত্বে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়। এদের এবং জামায়েতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির, আনসারুল্লা বাংলা টিম প্রমুখের সঙ্গে শাসক আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের সংঘর্ষ বেধে যায়। দেশজুড়ে হিংসাত্মক ঘটনা, শাসক দলের সমর্থকদের আক্রমণ, সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদি চলতে থাকে। নরসিংদী-তে জেল ভেঙ্গে কয়েদিদের সাথে জেহাদীদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়। বিপরীতে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চলে। দেশকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়ে, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখে, আন্দোলনকারীদের হত্যা ও গ্রেফতার করা হয়। ফাঁকা রাস্তায় ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়িকে টহল দিতে দেখা যায়। একদিকে যখন বিরোধীদের ব্যারিকেড ভাঙ্গা ও গ্রেফতারি চলতে থাকে, পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের একাংশের সাথে সমঝোতার আলোচনা শুরু হয়।
তীব্রতা কমলেও আন্দোলন এখনও চলছে, সুপ্রিম কোর্টকে দিয়ে সমগ্র কোটা ৫৬% থেকে ৪৯% কমিয়ে ৭% করে দিলেও বাংলাদেশ এখনও ফুটছে। নতুন ব্যবস্থায় মুক্তি যোদ্ধাদের কোটা ৩০% থেকে কমে ৫% হয়েছে, মহিলা ও পশ্চাদপদ জেলার সংরক্ষণ উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং জনজাতিদের কোটা ৫% এর থেকে ১% এরও কম হয়েছে এবং এটির মধ্যেই প্রতিবন্ধী ও রূপান্তরকামীদেরও ধরা হয়েছে। থমথমে বাংলাদেশ হয়তো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ জীবনে থেকে যাওয়া প্রবল অস্থিরতা আগামী দিনে কোন ইস্যুতে আবার বিস্ফোরণ ঘটাবে না এমনটা বলার কোন জায়গা নেই। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের মোদীর মত বাংলাদেশে হাসিনার ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তাপূর্ণ হয়ে উঠল।
এই আন্দোলনতটি ঘটার বহুমাত্রিক দিক আছে। সময়াভাবে সংক্ষেপে কয়েকটিমাত্র দিক ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে এখানে:
(১) সমাজের আর্থিক সংকট এবং যুবসমাজের কর্ম সংস্থানের অভাব বাংলাদেশ কে গ্রাস করেছে। ভারতের মতই ঢাকা- চট্টগ্রাম মহানগরী কেন্দ্রিক কিছু অতি ধনী পারিবারিক পুঁজিবাদী ব্যবসায়ী – দালাল (Crony Capitalist) বাংলাদেশের মূল ক্ষমতাধারী, সব সম্পদ ও বিদেশী সাহায্য লুটেপুটে নিচ্ছে এবং পাশ্চাত্যে, আরব দেশগুলিতে, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে বিপুল বিত্ত ও সম্পদের এক বড় অংশ পাচার করে চলেছে। ফলে সমাজে ভারতের মত আর্থিক বৈষম্য প্রকট এবং দেশ সংকটে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই প্রভাবশালী ক্রনি দের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আর এদের অনুগত মাফিয়া – অপরাধীদেরও দলে স্থান দিয়েছেন যাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ নাজেহাল।
২) ২০ বছর প্রধানমন্ত্রী এবং টানা চারবার ক্ষমতায় থেকে হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগের সমাজের প্রতি অবহেলা, বিচ্ছিন্নতা ও ঔদ্ধত্য বেড়ে গেছে। বিপরীতে বহু বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি ক্ষমতায় আসার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে এবং দেশব্যাপী তীব্র সরকার বিরোধিতাকে কাজে লাগাচ্ছে।
৩) আন্তর্জাতিক ভূ রাজনৈতিক কৌশলের অঙ্গ হিসেবে সমালোচনা সহ পাশ্চাত্য হাসিনাকে ঘুরপথে সমর্থন করছে। তিন দিক ঘিরে থাকা ভারত হাসিনাকে প্রথম থেকে সমর্থন করে আসছে। চিন ঘুরপথে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটকে সমর্থন করছে। পাকিস্তান ও আরব দেশগুলি সরাসরি বা প্রচ্ছন্নভাবে বিরোধীদের সমর্থন করছে। তাই সরকার বিরোধীদের এত ভারত বিদ্বেষ। কেন্দ্রে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি আসায় আরও ভারত বিরোধিতা বেড়েছে। চিন ও পাকিস্তান তাতে যতটা পারে ইন্ধন যোগাচ্ছে।
৪) নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলি শুকিয়ে আসায় এবং গঙ্গা, তিস্তা, মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা, দুধকুমার ও কুশিয়ারা নদীর জল বিবাদকে নিয়ে ভারতকে দায়ী ও হাসিনাকে ব্যর্থ বলার প্রচার তুঙ্গে। এর সঙ্গে ভারত থেকে কম ফলনের জন্য পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধকে কেন্দ্র করে ভারত বিদ্বেষ বাড়ানো হয়েছে।
৫) ধর্ম নির্দিষ্ট ভাবে ইসলাম ধর্ম। এটি একটি প্রধান বিষয়। বাংলাদেশে ফরাজি, সালাফী, ওয়াহাবী সুন্নী ইসলামের আধিক্য। এরা কট্টর এবং এদের ভুবনে অন্য ধর্ম তো বটেই ইসলামের উদারপন্থাগুলিরও স্থান নেই। তাই সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং জনজাতি, বাউল – ফকির, আহমদিয়া, সুফি প্রমুখরা আক্রান্ত ও অত্যাচারিত। আগেই দেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করে ফেলা হয়েছে। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’-য় যেরকম আছে একদম শিশু বয়েস থেকে গরীব ঘর থেকে নিয়ে গিয়ে মৌলবাদী করে তোলা হয়। পরের পর্ব জেহাদী তৈরি করা। এর জন্যে আরবের অর্থের অভাব নেই। এই অগণ্য মৌলবাদী ও জেহাদী জনসংখ্যা অন্ধ বিএনপি – জামায়েতে – হেফাজতে সমর্থক এবং উদারপন্থা, হিন্দু, আওয়ামী লীগ ও ভারত বিদ্বেষী।
৬) দেশভাগ ও স্বাধীনতার সময় রক্ত বন্যার মধ্যে পাঞ্জাব থেকে শিখ ও হিন্দু পাঞ্জাবিরা ভারতের পাঞ্জাবে এবং পাকিস্তানের পাঞ্জাবে মুসলমান পাঞ্জাবিরা চলে যান। ফলে বর্তমান ভারতের ও পাকিস্তানের পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িকতা প্রধান সমস্যা নয়।
বিপরীতে বাংলায় রক্তবন্যার মধ্যে বিপুল দেশান্তরণের মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গে থেকে যান এবং পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশে হিন্দুদের একটি বড় অংশ মূলত গরীব কৃষক দলিত সম্প্রদায়ের হিন্দু বাঙালিরা থেকে যান। তাই বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা একটি প্রধান বিষয়।
৭) এর উপর মুসলিম লীগের বড় জমিদার ও বড় ব্যবসায়ী নেতৃত্ব দাঙ্গা করার জন্য এবং অন্যান্য দৈহিক পরিশ্রমের কাজের জন্যে বিহার, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি জায়গা থেকে যে পশ্চিমী মুসলমান দের অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলায় নিয়ে এসেছিল তারা ও তাদের বংশধররা ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলা ও বাঙ্গালী বিদ্বেষী। তারা ৪৬ সহ বিভিন্ন দাঙ্গায়, ভাষা আন্দোলনে এবং মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল। এদের একাংশ রাজাকার, আল বদর, আল সাম ইত্যাদি। বর্তমানেও এরা চরম ভারত বিদ্বেষী, পাকিস্তান সমর্থক এবং বিরোধী জোটের সমর্থনে।
৮) ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের মত বাংলাদেশেও কোন প্রগতিশীল গণ আন্দোলনের অনুপস্থিতি যা কয়েক দশক আগেও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের (১৯২৯ – ১৯৯৪) নেতৃত্বে পরিচালিত ছিল। ‘ ঘাতক – দালাল নির্মূল কমিটি ‘ খুবই সক্রিয় ছিল একসময়। দুই দেশেই প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট ও সমাজবাদী পার্টি গুলি শত বিভক্ত এবং খুবই দূর্বল ও প্রান্তিক হয়ে পড়েছে।
৯) গণ ক্ষোভের বিরাট কারণ। দেশ জুড়ে ভয়ানক দুর্নীতি। কোটার ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের ৩০% কোটা থেকে সামান্যই মুক্তিযুদ্ধের পরিবার রা সুবিধা পেতো। বেশিটা চড়া দামে বিক্রি হয়ে যেত। নকল মুক্তি যোদ্ধা সাজিয়ে ক্রনি দের লোকজনও আকছার ঢুকতো। …….
১০) কোভিড অতিমারী পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতি আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ এবং বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর চাপে ধ্বস্ত। তার উপর প্রধান অর্থকরী বস্ত্র শিল্প (Ready made garments বা RMG) চিন, ভিয়েতনাম, তুরস্ক দের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন।
“সব কটা জানালা, খুলে দাওনা
আমি গাইবো বিজয়েরই গান –
ওরা আসবে চুপি চুপি
যাঁরা এই দেশটাকে ভালবেসে
দিয়ে গেছে প্রাণ।”
২৩.০৭.২০২৪










