শিশুদের জন্য ক্ষতিকারক দুটো ভিডিও সম্পর্কে আজ বলব| বলাটা আমার দায়— দীর্ঘ পঁচিশ বছর বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের আন্টি হিসেবে কাজ করার দায়| ভিডিও দুটো ফেসবুকে প্রচারিত| দুটোই audio visual এবং musical, ফেসবুক এবং musical audio visual input — দুইয়ের প্রতি শিশুর টান অপ্রতিরোধ্য| তফাৎ — প্রথমটির প্রতি টান অনাবশ্যক যা আমরা চাইলেই রোধ করতে পারতাম| পারিনি| উল্টে শিশুর হাতে মোবাইল গুঁজে দোকানে দোকানে শাড়ি ভ্যানিটিব্যাগ মার্কেটিং করেছি| পার্লারে গিয়ে ফাটা নখ মেরামত করেছি আর বাচ্চাটা পাশে বসে পাবজি খেলেছে এবং মানুষ মারার direction শিখেছে| দ্বিতীয়টি অর্থাৎ musical audio visual – এর প্রতি শিশুর টানটা অনিবার্য এবং সেহেতুই বোধহয় জরুরি | জরুরি শিক্ষার জন্য| জটিল বিষয়কে সহজ করার জন্য|
শিশুর এই অস্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক দুই প্রবণতাই উল্টোপাল্টা প্রয়োগে কী ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে তারই উদাহরণ আমার আজকের আলোচিত দুটো ভিডিও| প্রথমে ভিডিওর কন্টেন্ট বলব| তারপর বলব নির্দিষ্ট ভিডিও নিয়ে আমার অনেকগুলো আশঙ্কার কথা|
প্রথম ভিডিও — ওপরে ইংরেজিতে লেখা–“Tamil Group”| ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি চমৎকার হিন্দি গান চলছে–“মন ডোলে রে –“| সেই গানের ছন্দে একটি ছোট্ট বাচ্চা নেচে চলেছে| সামনে একই ছন্দে মাথা দোলাচ্ছে একটি সাপ| বুঝলাম বিষধর– কেন না থেকে থেকেই মানে গান উচ্চ হলেই সে দ্বিগুণ তিনগুণ মাথা তুলছে| বাচ্চাটির মা সিঁদুর মেখে থালাভর্তি ফল দুধ সব এগিয়ে দিচ্ছে সাপটির লকলকে জিভের কাছে| ভাবতে পারেন এরপর কী দেখানো হল? সাপ খাচ্ছে না দেখে মা বাচ্চার হাতে থালাটা দিয়ে সাপের মুখে এগিয়ে দিচ্ছে| গানের তালে বাচ্চা, মা, সাপ সব লাফাচ্ছে| আনন্দে লাফাচ্ছে রে, ভাই| শুধু আমারই ফালতু ভয় হচ্ছে| আচ্ছা — ভিডিওটি দেখে আপনার বাচ্চা যদি ভেবে বসে সাপ হেব্বি মজার প্রাণী? তার সঙ্গে ডান্স করা যায়! তার চেরা জিভ চুলকে দেয়া যায়– ফল খাওয়ানো যায়! আর তারপর একদিন?– আপনার বাচ্চা বারান্দা থেকে উঠোনে গেল| উঠোন দিয়ে বাগানে| সাপ এগোলো গুটি গুটি| বাচ্চাটার মনোজগতে তখন পূর্বশ্রুত গান– মন ডোলে রে| ঠিক করে ফেলল তৎক্ষণাৎ– ঐরকম একটা ভিডিও শো করবে তার হঠাৎ দেখতে পাওয়া সাপটার সাথে! লাফ শুরু হল বাচ্চার| তখন দশখানা চোখ নিয়েও আপনার মনসা বাঁচাতে পারবেন তো বাচ্চাটাকে? সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে আপনি নিজেও কি– ? কী? চুপ হয়ে গেলেন যে! ও, আমার রাক্ষস মা|
দুই নম্বর ভিডিও– মেমসাহেবের একপাশে বাচ্চা, অন্য পাশে ফর্সা কুত্তা| মেম এবার বাচ্চাটাকে বসিয়ে দিল কুত্তার কোলে| কুত্তা চারপায়ে জড়িয়ে নিল বাচ্চাটাকে| সরু জিভ ঢুকিয়ে দিল ছ’মাসের বাচ্চার নাকের ভেতরে| এখানেও সেই এক– এক| বাচ্চা তালি দিচ্ছে , মেম হেসে মরছে আর কুত্তা “খকঘ্যাক” টাইপ কিছু একটা আওয়াজ করছে| পুরো ঘেউ করছে না| করতে পারছেও না| কারণ ততক্ষণে বাচ্চার হাত তার মুখে| এবার মেম মামনির Teaching —” jimi — he is ur brother”। বিশ্বভ্রাতৃত্বের কী অপূর্ব নমুনা| শুধু মানুষের বদলে কুত্ত | সাদা বাচ্চাটাকে কুত্তাকে ভাই বলে ডাকানো হল অথচ দরিদ্র কালো মায়ের কালো সন্তান সুদূরে রইল|
ফের ভয় লাগছে আমার| মেমসাহেবের টিচিং যদি সাহেবপ্রেমী বাপ মায়েরা দৈবওষুধের মত গেলে? আর কুত্তাকেই ভাই ডাকতে শেখে আমাদের দেশের বাচ্চাগুলো? মানুষ ভাইগুলো কোথায় যাবে রে? তারা যে বড় গরীব| কে তাদের হাত ধরে তুলবে? কুত্তাপ্রেমে খ্যাত মানুষ? কুকুরের গালে হাত ঢোকানোয় বাচ্চার কী অসুখ হতে পারে বা পারে কিনা সে প্রসঙ্গ আর তুললামই না| আপনাদের আধপাগলা দিদিমনির একটি বিনীত পরামর্শ– বাচ্চার বাবা মায়েরা, আপনারা please মোবাইলের জ্ঞানভান্ডার ত্যাগ করে রবীন্দ্রনাথ-জ্ঞানদানন্দিনীর “বালক” এবং শিবনাথ শাস্ত্রীর “মুকুল”, এই দুটো শিশু পত্রিকা পাঠ করুন| পাঠ করান| এখনই| দেখুন তাঁরা কীভাবে শিশুর কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন কাফরি দাসদের মুক্তিদাতা থিওডোর পারকারের কথা– সারা বিশ্বের কৃষক শ্রমিক আন্দোলনের কথা| মানুষের প্রতি আন্দোলিত রাখুন আপনার শিশুকে| শিশুই তো সবার আগে ভালোবাসবে মানুষকে| মানুষকে ভালোবাসায় শিশুর যে বিকাশ তা কিন্তু অপরিমেয়– My Dear Guardians, ওদের গাইতে শেখান মানুষের জয়গান। সে গানের প্রথম সা রে গা|
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাচ্চার মা-বাবা নিজেরা এখনও বাচ্চা হয়েই থাকতে চান। নিজেদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হোক, তারপর তো নিজেদের বাচ্চাদের শিক্ষা দেবেন। এটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। ভুল বুঝবেন না, আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রের কথা বলছি।
অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ময়ূরী। মিডিয়া তা কিছু পরিবেশন করে তাতে আমাদের অন্ধ বিশ্বাস। তার ভালো মন্দ বিচার করার দরকার নেই। সেইসঙ্গে আরেকটা কথাও বলেছেন উনি। খারাপ লাগে ভাবতে, যে কুকুরকে কিছু মানুষের চেয়ে বেশি আপন মনে করি আমরা। জানি না এই collective insanity কবে যাবে।
শিশুমনের ওপর কিভাবে নানান পারিপার্শ্বিক দৃশ্য প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কে বাবা মায়েরা ততখানি সচেতন থাকেন না যতখানি হওয়া উচিত।বিশেষজ্ঞের এ সম্পর্কে আলোকপাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।লেখাটি খুবই আগ্রহের সঙ্গে পড়তে শুরু করে ছিলাম।কিন্তু একটি বিষয় না বলে পারছি না।লেখিকা অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষ এবং special educator হিসেবে অন্যদের তুলনায় বেশী সংবেদনশীল হবেন এটিই ভেবেছিলাম।কিন্তু একজন সংবেদনশীল মানুষ অন্য মানুষের মত অন্য প্রানীদের প্রতিও সংবেদনশীল হবেন এটিই আমার বিশ্বাস ছিল।কুকুর কে কুত্তা বললে সেটা তাদের প্রতি অসম্মান বলে আমি মনে করি।কারন এতে প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য স্পষ্ট।একটি বাচ্চা যেমন মানুষকে ভালোবাসতে শিখবে তেমনি অন্য প্রানী দেরও ভালোবাসতে শিখবে সেটাই বোধহয় শুভ হবে তার ও পৃথিবীর আগামীর জন্য।সে প্রাণী কুকুর,বিড়াল গরু থেকে ফড়িং বা ব্যাঙ ও হতে পারে।আমার বাবা মা আমায় ছেলেদের ব্যাঙের ওপর ঢিল ছুড়ে আনন্দের গল্পটি খুব ছোট বেলায় পড়িয়ে ছিলেন।সেই শিক্ষা আমি আজীবন বহন করছি …অন্য প্রানীর প্রতি মমত্ববোধ ও সম্মান শিশুকে গভীরভাবে সংবেদনশীল করে তোলে ।সেই শিশু অন্য মানুষের প্রতিও ভালোবাসা ও সম্মানের ভাষা শিখবে এ আমার অনুভব।
ড.ময়ূরী মিত্র যাদের অন্তর্জগৎ নিয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষিকার কাজ করছেন,তারা অতিরিক্ত চাহিদাসম্পন্ন শিশু।তিনি তো শুধু শিক্ষিকা নন,একজন অনুভবী অভিনেত্রী।শিশু পালন বিষয়ে পারিবারিক অসচেতনতা দিনে দিনে যেভাবে উন্নতির নামে অবনতি হচ্ছে,লেখিকা সে বিষয়ে যথার্থ দিকনির্দেশ করেছেন।একদিকে বাবা মায়ের ধর্মীয় অন্ধত্ব শিশুর মনোজগৎ ক্ষতি করছে।অন্যদিকে শহর বা মফস্বলি কুকুর প্রেমে গদ গদ পরিবারগুলির শিশুরা আত্মীয় স্বজন ভুলে,সমাজের বাস্তবতা ভুলে পশুর সংগে আত্মীয়তা শিখছে। রোগব্যাধির কথা ছেড়ে দিলাম।পরিবারের বা সমাজের মানুষদের ভুলে কুকুরকে ভাই বলতে শেখানোর মধ্যে কোন মহত্ব নেই।কুকুর নির্ভেজাল আনুগত্য দেয়।কথা শোনে। কিন্তু বাড়ির কর্তা বা কর্ত্রী অসুস্থ হলে কুকুর হাসপাতালে নিয়ে যাবে না।শ্মশানেও না।নিয়ে যাবে বেপাড়ার কালো কালো ছেলে-মেয়েরা।তাই সমাজ ভুলিয়ে কুকুরকে ভাই বলতে শেখানো, এটা আসলে একটি সামাজিক অসুখ।মনস্তাত্ত্বিক গভীর বোধের মধ্যে যার উত্তর আছে।ড,ময়ূরীর মতকে আমি সমর্থন করি।
শিশু মনের সুস্থ বিকাশ বা চেতনা জাগিয়ে দেবার মতো শিক্ষা নেই তথাকথিত এই শ্রেণীর মানুষদের । শ্রেণী শব্দটি ব্যবহার করতে বাধ্য হলাম । তারা এখনো বিশ্বাস করেন মাতৃ দুগ্ধ পান করালে মায়ের বুকের সৌন্দর্য কমে যায় । পশু পাখিদের প্রতি ভালোবাসা থাকার প্রয়োজন আছে,তবে অবৈজ্ঞানিক অন্ধ বিশ্বাস ঠিক নয় । নেটে ছড়িয়ে থাকা কুসংস্কার ও হিংসাত্মক ভিডিও গেম থেকে শিশুদের রক্ষা করবে কে ? অভিভাবক যদি না সচেতন না হন ভবিষ্যতে এই শিশুরাই হাতে AK47 নিয়ে ফুর্তি করবে । আমাদের শিশুকালে একটা তালপাতার ভেঁপু উপহার পেলে খুব আনন্দ হতো । মেলায় গিয়ে বার্গার খেতাম না । তোমার লেখা পড়ে যদি কিছু মানুষের বিন্দুমাত্র উপকার হয় তাহলে খুব খুশি হবো
Apni ekebare 100%satto kotha likhechen amar atyonto pochonder godyokarMouri Mitra@ Mayurbahar .
অনেক ধন্যবাদ এই দুটি অডিও ভিসুয়াল কে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরার জন্যে।
আমরা শিশুদের সূস্থ স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ কে বিকৃত করে তুলছি তাদের কাছে নানান ভিডিও, গান এসব দেখিয়ে বা শুনিয়ে। শুধু তাই নয়, খেলনা হিসেবে বাচ্চাদের হাতে বন্দুক বা এধরনের অন্যকিছু তুলে দেবার সময় ও ভাবিনা যে শিশু মনে তার সুদূরপ্রসারি ও ক্ষতিকারক কোন প্রভাব পড়তে পারে কি না।
লেখা ভীষণ রকম সময়োপযোগী। শিশুর হাতে এমন কিছু সামগ্রী তুলে দেওয়া হচ্ছে তা শিশুর মনে ও শরীরে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পশুপ্রেমীরা শুধু কুকুর বিড়াল নয় পাখির উপরো সমান ভাবে প্রেম থাকে। কিন্তু আজ গুটিকয়েক লোক বাদে বেশীরভাগ পশুপ্রেমীরা রাস্তায় কোন কুকুরগুলোকে খেতে দিচ্ছে ?শিশুকে শেখানো হয়না গ্রীষ্মের দাবদাহে জলের পাত্র রাখা উচিত পশু ও পক্ষীর জন্য। শিশুকে শেখানো উচিত কোন পশু থেকে বিপদ আসতে পারে। মানুষকেও ভালো বাসতে হবে। লেখা আমার খুব ভালো লেগেছে। পরবর্তী লেখার আশায় রইলাম।
সহমত। ভীষণ জরুরী এক সমস্যা বাচ্চার মায়েদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছো।
মানুষের থেকেও পশুদের দাম অনেক বেশি এদের কাছে।অথচ মানুষ পায় না একমুঠো খেতে।সেখানে টমি,পপি, উইনিদের জায়গা হয়ে যায় খাটের মধ্যে।
বাচ্চাদের উপর প্রভাব পড়ে জেনে অবাক হলাম-আমরা তাহলে কি শিক্ষা দিচ্ছি আগামী প্রজন্ম কে?