আমি যে অঞ্চলে প্র্যাকটিস করি সেখানে দুইধরণের রোগী আসে। একদল শহুরে, সফিস্টিকেটেড রোগী। আর এক দল একেবারে মাটি থেকে উঠে আসা মানুষ। তারা অনেক সময়ই আমার জন্য পুকুরের মাছ, বাড়ির গরুর দুধ, ভোরবেলা গাছ থেকে পাওয়া খেজুর রস নিয়ে আসে। সেগুলো না নিলে রাগ করে। মোটা গ্রাম নামের একটা গ্রাম আছে, সেখানকার নতুন বরবৌ বিয়ের পর আমাকে প্রণাম করে যায়। সেখানকার কেউ আমাকে “আপনি আজ্ঞে” সম্বোধন করে না, সবাই আমাকে ‘তুমি’ বলে। কিন্তু তার মধ্যে স্নেহ, ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা জড়িয়ে থাকে। একবার রাস্তায় সস্ত্রীক বেরিয়েছিলাম। (খুব কমই একসাথে বেরনো হয়, এরকম খুঁতযুক্ত আনস্মার্ট স্বামীকে সাথে নিয়ে কেউ বেরোয় নাকি?) রাস্তায় এক অল্পবয়সী মহিলা হঠাৎ করে সামনে এসে বলে- “কিগো, আজ ওষুধের দোকানে বসোনি? আমি কোন ভোরবেলা থেকে তোমার জন্য এসে বসে আছি।”
তাকে পরে দেখে দেবো আশ্বাস দিয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে ঘন মেঘ। সন্দেহের বিদ্যুৎ চোখের কোন দিয়ে ঝিলিক মারছে। তারপর যে ঝড় উঠেছিল সেটা বুঝতে পাঠক পাঠিকার কোনো আবহাওয়া অফিসের বড়কর্তা হবার প্রয়োজন নেই।
মোটকথা, আমার এমন অনেক পেশেন্ট আছে যারা আমাকে তাদের ঘরের মানুষ ভাবে। তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার বেহদ্দ গরীব। সেইসব রোগীদের জন্য আমি সপ্তাহে একদিন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে বসি।
সেই অফিসেই আমার সেলিমবাবুর সঙ্গে দেখা। সেলিম যেদিন আমাকে দেখাতে এসেছিল সেদিন আবার ওখানে অফিস টাইমের শিয়ালদা স্টেশনের মতো ভিড়। অথচ সেলিম কিছু গোপন কথা আমায় বলতে চায়। একটু কথা বলে বুঝতে পারলাম যে মানুষটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। বিড়বিড় করে বলছে ‘সুইসাইড করা ছাড়া গতি নেই।’ আমি সংস্থার সেক্রেটারিকে ডেকে বললাম যে সেলিমের সঙ্গে আধঘন্টা কথা বলতে চাই। আর এরপর থেকে মোটেই কুড়িটার বেশি রোগী দেখবো না। যারা সেরকম সিরিয়াস পেশেন্ট নয় তারা অনায়াসে বাড়ি চলে যেতে পারে। পরেরদিন তাদের দেখে দেবো। সেক্রেটারিও বুঝলেন। সবাইকে ফিরে যেতে বললেন।
এরপর দুখুরি চা এলো। প্রতি সপ্তাহে একবার করে এই চা আমি খাই। এই চা খেলে কোনোদিন আপনার সুগার হবেনা এবং জীবনের যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে ভয় পাবেননা। সেলিমবাবু একটু করে চা খায় আর দুঃখের ঝুলি খুলে বসে।
সেলিমবাবুর বিশাল এক থাইরয়েড গ্ল্যান্ড আছে। বাংলায় গলগণ্ড বলে বোধহয়। আমি আমার পিতৃদেবের জন্মে ওরকম বড়ো থাইরয়েড সোয়েলিং দেখিনি। আক্ষরিক অর্থে ওপর পেট পর্যন্ত জিনিসটা ঝুলে আছে। সংসার পরিজন সেলিমের ভয়াবহ রূপের জন্য তাকে ত্যাগ করেছে। কলকাতা এবং সাউথ ইন্ডিয়ায় প্রচুর খরচ করে ফিরে এসেছে। সাউথ ইন্ডিয়ায় অপারেশন করবে বলেছিল। কিন্তু অতটা অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই সেলিমবাবুর।
কলকাতার দুটি মেডিক্যাল কলেজে অনেকগুলো অল্পবয়সী ডাক্তার ওর গলা টেপাটেপি করে দেখেছিল বটে কিন্তু প্রতিবারই বড়ো ডাক্তারবাবুরা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কলকাতা এবং চেন্নাই মিলে একটা বিশাল কাগজের স্তুপ তৈরি হয়েছে। সেগুলো ঠিকঠাক সাজালে অনায়াসে ব্যাসদেবের মহাভারতের সাথে সাইজের দিক দিয়ে পাঙ্গা নিতে পারে।
কিছুটা ওলট-পালট করে বোঝা গেল ডায়াগনসিস নিয়ে সবাই একটু দ্বিধায় আছে। নডিউলার গয়টারের সঙ্গে কিছুটা লাইপোমাও আছে। দুটো রোগ মেলামেশা করে সবাইকে বিভ্রান্ত করেছে। এর সঙ্গে আছে অ্যানাস্থেসিয়া নিয়ে ভয়। গলাটিপে ধরা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে সেলিমবাবু শুদ্ধ ট্রাকিওমালেসিয়া শব্দটা শিখে নিয়েছে। অর্থাৎ অপারেশনের পরে শ্বাসনালীটি চুপসে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে গলায় টিউব ঢুকিয়ে না রাখলে সেলিমবাবু মারা যেতে পারে।
রিস্কি অপারেশন। তবে করাই যায়। হাসপাতালে অ্যানাস্থেটিস্ট অলোকদার সঙ্গে কথা বললাম। অলোকদা জানিয়ে দিলেন যে অজ্ঞান করতে উনি রাজি আছেন। তবে মারা গেলে পাবলিক যে সম্বর্ধনা দেবে তাতে তিনি অংশগ্রহণ করবেন না। বরং “আমি তোমাদেরই লোক” প্রমাণ করতে দু’চার ঘা আমার ওপর বসিয়ে দিতে পারেন।
উৎসাহ দিলেন আমার সিএমওএইচ স্যার। ডাক্তার তাপস রায় আমাদের কলেজেরই সিনিয়র। নিজে সিসিইউতে ফোন করে নির্দেশ দিলেন যে একটা বেড ফাঁকা করে রাখতে।
কি আশ্চর্য, অপারেশন ভালো হল। অলোকদা অ্যানাস্থেশিয়ার টিউব খুলে কনশাসনেস দেখার জন্য সেলিমবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন ‘ঠিক আছেন?’ সেলিমবাবু ‘বাপি বাড়ি যা’ স্টাইলে জবাব দেয় “আগে বলো, তুমি ভালো আছো?” অপারেশন থিয়েটারে হাসির হল্লা বয়ে যায়।
রাতে সাংবাদিকের ফোন – আপনি কোন দুঃসাহসে এই অপারেশন করলেন? রোগী যদি মারা যেতো? আমিও সেলিমের মতো স্টেপ আউট করে খেললাম- সে তো ফোঁড়া কাটতে গেলেও মানুষ মারা যেতে পারে।
পরে জেনেছিলাম সিএমওএইচ স্যার রিপোর্টারকে আমার ফোন নাম্বার দিয়েছেন। না পড়লে পিছিয়ে পড়ার সংবাদপত্রে জেলার পাতায় সিস্টার আর সেলিমের ছবিসহ বিরাট খবর দুদিন পর। মূল কাগজেও খবরটা ছাপা হয়েছিল। পরে সাংবাদিক ছেলেটির সাথে আমার বেশ ভালো রকম দোস্তি হয়ে যায়।
আর আমৃত্যু বন্ধুত্ব ছিল সেলিমের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে মাছ- মুরগী নিয়ে বাড়িতে হাজির হতো। আমার অর্ধাঙ্গিনীকে বলতো- “তুমি একটু সরে যাও। আমি জিনিসটা কেটে-কুটে সাইজ করে যাই। বড়োলোকের মেয়ে তো- কাজকর্ম কিছুই শেখোনি।”
আমার স্ত্রী এখন জানে যে মানুষগুলো এরকমই, একেবারে খাঁটি সোনা। এদের ‘তুমি’ ধরতে নেই।
অপারেশনের দশ বছর পর হঠাৎ করে হার্টের সমস্যায় সেলিম মারা যায়। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আমার নাম ধরে খুব ডাকাডাকি করেছিল। আমি তখন মেঘালয়ে বেড়াতে গেছি। একজন ফোন করে দুঃসংবাদটা জানায়। সেদিন মেঘালয়ের আকাশ থেকে যেটুকু বৃষ্টি ঝরেছিল সবটাই সেলিমের জন্য।
এই আখ্যানে দুজন চরিত্রের আসল নাম বদলালাম না। ডক্টর অলোক রায়চৌধুরী এবং ডক্টর তাপস রায়। ওই মানুষটার আরও দশবছর লজ্জার আবরণ ছেড়ে বেঁচে থাকাটা ওই দুটি মানুষের সাহায্য ছাড়া সম্ভব হতো না যে।
খুব ভালো লাগলো
Great Sir……🙏
Excellent!!
দারুন