সে এক ভয়ংকর সময়। আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরিয়েছে। যে পুলিশ খবরটা নিয়ে এসেছে সে প্রহ্লাদ গ্রুপের লোক। মানে সব প্রফেশনেই তো দৈত্যকুল থাকে। আলাদা করে পুলিশদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমার ভেঙে পড়া অবস্থা দেখে যথাসম্ভব স্বান্তনা দিচ্ছিলেন ভদ্রলোক। “এতো ভয় পাবেন না। আপনাকে তো আমি গ্রেফতার করতে আসিনি। রাণাঘাটে অমুক অফিসার আছে। কোনও অসুবিধে হলে তাকে গিয়ে আমার নাম বলবেন।”
“নাম মনে থাকলে হয়।” আমি কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম। পিতৃদেবের নামটাই ঠিকঠাক মনে আসছে না।
পুলিশ কাগজপত্র ধরিয়ে চলে যেতে আমার স্ত্রী মৃদু আওয়াজ করে কেঁদে উঠলেন। মেয়েটা একেবারে গুটলি, আমার হাঁটুর কাছটা জড়িয়ে ধরে সেও কেঁদে ওঠে। তার সীমিত জ্ঞানে বোঝে যে পুলিশকাকুরা খুব মারধর করে এবং আইসক্রিম, চকোলেট জেলখানায় নিষিদ্ধ।
পারিবারিক হাই ভোল্টেজ ড্রামা শেষ হতেই ছুটলাম সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফিসে। নষ্টের গোড়া সুপারস্যারের সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। সার্জনদের প্রায়শই কোর্টে যেতে হয়। জেলা হাসপাতালে আদ্ধেক রোগীই ভর্তি হয় মারপিট করে। কখনো বিশেষজ্ঞর মতামত দিতে বা কখনো সাক্ষী হিসেবে সেইসব কেসে কোর্ট ডেকে পাঠায়। আমি সাধারণত প্রচন্ড নিষ্ঠা সহকারে সেইসব কেসে সাক্ষী দিই।
কিন্তু রাণাঘাট কোর্টের ঘটনাটা অন্যরকম। সেই প্রথমবার ওখান থেকে সমন পেয়েছিলাম। নির্দিষ্ট সময় গাড়ি নিয়ে বেরিয়েও পড়েছিলাম। মাঝরাস্তায় সুপার স্যারের ফোন। এখনই ফিরে এসো। বড়ো একটা বাস অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। অন ডিউটি সার্জন একা সামলাতে পারবেনা। কিন্তু সমন? তার কি হবে?
“গুলি মারো সমনকে।” সুপার স্যার উত্তেজিত। “মানুষের জীবন আগে না সমন আগে? তোমার দিকে কতো অসহায় মানুষ তাকিয়ে আছে।”
বাঙালি গ্যাস খেতেও পারে এবং গ্যাস অম্বলে আইঢাইও করতে পারে। সেই মুহূর্তে আমি প্রথম ধরনের বাঙালি হয়ে গেলাম। সমনকে গুলি মারা যে দণ্ডনীয় অপরাধ সেটা তখন মাথার বাইরে। আর একজন সার্জন জানে এরকম পরিস্থিতি কতো চ্যালেঞ্জিং। মনে হয় ঠিক এই কারণে সার্জারি সাবজেক্টটার সাথে আমার ডাক্তারি পড়তে এসে প্রথম প্রেম হয়েছিল। অসংখ্য সেলাই, প্লাস্টার, চেস্ট ড্রেন দিতে দিতে বিকেল। হাসপাতালের গেটের মুখের দোকানে যখন পড়ন্ত বিকেলে চা খাচ্ছি তখন অদ্ভুত একটা তৃপ্তি।
কিন্তু সাক্ষী দিতে যাইনি বলে একেবারে গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরিয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। সুপারসাহেব আমাকে আশ্বস্ত করে – “কিছু হবেনা। ঠিক ছাড়া পেয়ে যাবে।”
আমি আশ্বস্ত না হয়ে জেলা জজকোর্টে কাজ করা এক চেনা উকিলসাহেবের শরণাপন্ন হই। তিনি রাণাঘাট কোর্টে তাঁর বন্ধুকে বলে দিলেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার, পরের দিন ব্যাপারটা খুব সহজে মিটেও গেল। শুধু বাড়ি ফেরার পর স্ত্রী একটু সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। জেল ভেঙে পালিয়ে আসা কিন্তু বিপজ্জনক কাজ। পরে ঝগড়ার সময় অস্ত্র হিসেবে বলেন “জেলের লোক পর্যন্ত আধবেলা তোমার সঙ্গে ঘর করতে পারেনি।”
সে যাইহোক, সার্জারিতে অধিকাংশ রোগীই ভর্তি হয় মারপিট করে। আমি যে জেলায় বাস করি সেখানে মারপিট করাটা অন্যতম প্রধান বিনোদন। মানুষ হাতে কোনও কাজ না থাকলে একটু মারপিট করে নেয়। এবং পরে সেইসব মারপিটগুলো থেকে বিচিত্র বিচিত্র মামলার উৎপত্তি হয়। মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে- এখানকার মানুষ মামলা করার জন্য মারপিট করে নাকি মারপিট করার জন্য মামলা করে। মোটকথা এমন আক্রান্তও হাসপাতালে ভর্তি হয় যার দেহে কোনো আঘাত লাগেনি। একদিন ফিমেল ওয়ার্ডে এক মহিলা তার অন্তর্বাস হাতে ঝুলিয়ে প্রচন্ড চেঁচামেচি করছে- “দেখুন, আমার জামাটাকে কিভাবে ছিঁড়ে দিয়েছে।” আমি বিব্রত। আমার থেকে বেশি বিব্রত সঙ্গে রাউন্ডে আসা সিস্টার। আমি নিরুপায় হয়ে জানালাম যে আমি দর্জি নই। একটু-আধটু মুচির কাজ জানি। সে মামলাতেও আমাকে সাক্ষী দিতে যেতে হয়েছিল।
আবার খুব খারাপ কেসও ভর্তি হয়। মানে মামলা হওয়ার জন্য একেবারে তৈরি কেস। দুটি পাঁচ ও সাত বছরের বাচ্চাকে তাদের মদ্যপ, দুশ্চরিত্র বাবা দড়ি দিয়ে বেঁধে পুড়িয়ে দেয়। বাচ্চা দুটোর মা নেই। এতটাই পুড়ে গিয়েছিল যে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে শিরা কেটে (ভেনিসেকশন) স্যালাইন চালিয়ে ছিলাম। সারারাত জেগে একটু একটু করে বাচ্চা দুটোকে মৃত্যুর মুখ থেকে বার করে আনা হয়েছিল। তিন-চার দিন পরে গুছিয়ে বসে ক্যাডবেরি ঘুষ দিয়ে জবানবন্দি লিখে নিয়েছিলাম। জানি, মামলাটা কোর্টে উঠবে। হুঁ হুঁ বাবা, ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি। ওদের বাবাটাকে জেলের ঘানি না টানিয়ে ছাড়বোনা।
পক্সো কোর্টে মামলা উঠলো। কিন্তু আসামি পক্ষের আইনজীবীর সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন। “তিনদিন বাদে জবানবন্দি নিলেন, অথচ প্রাথমিক অবস্থায় ওরা কথা বলতে পারার অবস্থায় নেই -সে ব্যাপারে কোনও নোট নেই।”
আমি বললাম যে ওরা সেইসময় মানসিক এবং শারীরিক ভাবে হিস্ট্রি দেবার অবস্থায় ছিলনা।
“ওরা মানসিক ভাবে ঠিক না থাকলে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টকে রেফার করেননি কেন? আপনাদের হাসপাতালে তো সাইকিয়াট্রিস্ট আছে।
”কি মুশকিল! সেটা তো মানবিকতার প্রশ্ন। ওদেরকে সুস্থ করে তবে প্রশ্ন করবো। এরমধ্যে সাইকিয়াট্রিস্ট আসে কি করে?”
“জবানবন্দিতে ওদের সই নিয়েছিলেন?” এরপরের ঘোরানো প্রশ্নগুলোতে আমি ডাহা ফেল। তারপর ভয়ংকর অ্যালিগেশন- “আপনি ওদের মামাবাড়ির লোকেদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনদিন পর একসাথে বসে রিপোর্ট লিখেছেন।”
জেরা শেষ হতে থমথমে মুখ নিয়ে এজলাস থেকে নেমে এলাম। জজসাহেব ইশারায় উকিলসাহেবকে কিছু বললেন মনে হলো। কোর্ট থেকে বেরোতেই সেই উকিল আমাকে ধরলেন। কিছু মনে করবেন না। এই প্রশ্নগুলো পেশার স্বার্থে করা। একসাথে চা খেলাম।
যাতায়াত করতে করতে জেলা জজকোর্টের অধিকাংশ উকিল এবং জজসাহেবের সঙ্গে বেশ পরিচয় হয়ে গিয়েছে। বেশ কিছু প্রতিভাবান মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে। একজন অল্পবয়সী জজসাহেব দারুণ কবিতা লেখেন। তাঁর চেম্বারে বেশ কয়েকবার কবিতা শুনেছি। একজন প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে বেশ ভালো কাজ করছেন। কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে গেলেও যোগাযোগ আছে। সানন্দায় প্রকাশিত ‘দুই বান্ধবী আর ওথেলো সিনড্রোম’ গল্পটার জন্য একজন জজসাহেবা ম্যাডামকে তো খুব বিরক্ত করেছি। উনি খুশি মনে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। একজন আইনজীবী দারুণ গান করেন।
কালো কোট পরা মানুষগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা আসল মুখগুলো দেখে কখন যেন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।
আমার ক্লাসমেট ডাক্তার সন্দীপ পাড়ি এক সাবডিভিশন হাসপাতালে আছে। একদিন রাত্রে তার ভয়ার্ত গলায় ফোন- “তোদের শহরের কোর্ট থেকে আমার গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরিয়েছে। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা।”
ওর পাবলিক প্রসিকিউটরের নাম জেনে নিলাম। তারপর সরাসরি দরদামে চলে গেলাম – “তোর মুক্তির ব্যবস্থা আমি করে দেবো। কিন্তু কি খাওয়াবি বল।”
দারুন স্যার