খারাপ মানুষ বলে কিছু হয় নাকি? বা নিপাট ভালো মানুষের আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে? মনে হয়না। মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কখনো ভালো, কখনো খারাপ। বেশির ভাগটাই ধূসর একটা অস্তিত্ব। মানুষের মনের ভেতরের রঙও পাল্টায়। কখনও রোদ ঝলমলে সকাল তো কখনও মনখারাপের মেঘলা আকাশ। কেউ মনের দরজা খুলে রাখে সবার রঙে রঙ মিশাবে বলে। কেউ আবার বাইরের আকাশকে ঢুকতে দেয়না কোনো ছিদ্র দিয়েই। নেশার বা ঘুমের ওষুধের চাদরে আপাদমস্তক মুড়ে রাখে নিজেকে। শুধু কারো খোলা দরজা আচমকা ঝড়ে বন্ধ হয় মাঝেমাঝে, কারো নেশার চাদর ভেদ করে উঁকি মারে একটুকরো আলো।
মনজিতের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল হাসপাতালে। যারা ওকে ভর্তি করেছিল তাদের ভাষায় মনজিত নেশার জন্য পদ্মভূষণ পেতে পারে। প্রতিদিন সকালে নর্দমার ভেতর, রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে কিংবা ঝোপঝাড়ের খাঁজ থেকে ওর বাড়ির লোক ওকে কুড়িয়ে নিয়ে যায়। মোটামুটি খোঁয়াড়ি ভাঙলে সবাইকে লুকিয়ে আবার ও নেশার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। ওরা বিরাট সম্পত্তির মালিক ছিল। এখন ছোট্ট একটা ঘরে থাকে। ইদানীং নাকি মহাবিদ্যায় দীক্ষিত হয়েছে। দুএকবার ধরা পড়ে সরকারি পোষাঘরের সম্মানিত অতিথিও হয়েছে। হাসপাতালে আসাটা এই প্রথম। সাইকেল চুরির অপরাধে জনসাধারণের সম্বর্ধনাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল।
দুচার জায়গায় সেলাই দিয়ে চেহারাটা একটু ভদ্রস্থ করতে পারলেও ছুটি দেবার মতো অবস্থায় ছিলনা মনজিত। আর চুপিচুপি জানিয়ে রাখি, ওকে রাখার পেছনে আমারও একটা স্বার্থ ছিল। ‘আমার তো গল্প বলা কাজ।’ তখন একটা ছোটগল্প লিখছিলাম। গল্পে একজন ড্রাগ পেডলারের চরিত্র ছিল। ওরা কি ভাষায় কথা বলে, কোড ল্যাঙ্গুয়েজ আছে কিনা বা নেশার ঘোরে কোনো কুকাজ করে ফেলে কিনা এসব অতি প্রয়োজনীয় তথ্য আমার জানার ছিল। সেই রাতে অবশ্য মনজিতের তথ্য ও সম্প্রচার বিভাগ খুলে রাখার মতো অবস্থা ছিলনা।
পরদিন স্যালাইন খোলার পরেই প্রথম আবদার বিড়ি খাবার। স্যালাইন খোলার পরে সাধারণত অল্প জল দেওয়া হয়। গেট কিপার আর নার্সদের কড়া করে চোখেচোখে রাখার কথা বলে এলাম। ভাগ্যিস বলেছিলাম। ইভনিং রাউন্ডে এসে জানলাম লোকটা নাকি তিনবার পালানোর চেষ্টা করেছিল। একবার ওর বাড়ির লোক ফেরত দিয়ে গেছে। শেষবার নাকি রীতিমত হিন্দি সিনেমার চেজ সিন হয়েছিল।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমার সঙ্গে মনজিতের বেশ দোস্তি হয়ে গেল। ওকে এক তাড়া বিড়ি দিয়েছিলাম। তারপর সার্জনস’ রুমে নিয়ে গিয়ে গল্প জুড়লাম। অন্ধকার জগতের জানাঅজানা কাহিনী। নেশা করার সঙ্গে আর কি কি কুকর্ম করে জিজ্ঞেস করায় মনজিত বিড়িতে টান দিয়ে চেয়ারের ওপর একটা পা ভাঁজ করে বসে। চোখটা সরু করে বলে “একটা খুনও করেছি”। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করি যে পুলিশ জানে কিনা। জানেনা।
ভেতর ভেতর একটু গুটিয়ে যাই আমি। ” কাকে খুন করেছো?”
“শম্পাকে। শি ওয়াজ আ হোর। বিপ্লব বলে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে আশনাই ছিল। অথচ বিয়েটা করেছিল আমাকে।”
“তারপর?” শিহরিত হয়ে প্রশ্ন করি।
“তারপর আবার কি? একদিন সন্ধ্যাবেলায় ঢিঁসকাও। বডিটা পুকুরে ফেলে দিলাম।”
পুলিশকে জানানো উচিত কি উচিত নয় এই চিন্তায় সে রাতে আমার আর ঘুম হলোনা। ঠিক করলাম যে ওর বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে এখনই পুলিশকে কিছু জানাবো না। তবে মনজিতকে পরামর্শ দেবো আত্মসমর্পণ করার।
পরদিন ডিসচার্জের সময় ওর বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে মনজিতের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার ডিটেইলসে নিয়ে নিলাম। এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা এসেছিলেন। ভদ্রতার খাতিরে তাঁদের নাম জিজ্ঞেস করি। ভদ্রলোকের নাম বিপ্লব। আর মহিলার নাম শম্পা। “আমি মনজিতের স্ত্রী।” শম্পা বলেন।
“জানি আমি।” হেসে উত্তর দিই। “আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে মনজিত।”
বুক থেকে বড়ো একটা বোঝা নেমে যায়। মনে মনে বলি ‘ওথেলো সিনড্রোম।”
গল্পটা আমার সানন্দায় ছাপা হয়েছিল। আলো-আঁধারির মধ্যে বাস করা মনজিতকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। সৎ পথে ফিরে এসো মনজিত।
(নামগুলি বদলে দেওয়া হয়েছে।)
😀অসাধারণ sir