No longer mourn for me when I am dead
Than you shall hear the surly sullen bell
Give warning to the world that I am fled
From this vile world, with vilest worms to dwell:
Sonnet 71, William Shakespeare
প্রতিদিন আমি মৃত্যু দেখি। স্নায়ুগুলোকে কর্কশ বাস্তবের মাটিতে ঘষতে ঘষতে চেষ্টা করি নিজেকে বেদনাহীন করে দেবার। তবুও প্রতিদিন আমি কাঁদি। ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হই। নিজেকে বোঝাই “ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্/নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ ।/অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো/ ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।” একবার শেকসপিয়ারকে আঁকড়ে ধরি তো একবার রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করি-“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।”
গল্পটা আমি আমার এক সাহিত্যিক বন্ধুকে বলেছিলাম। সে বহুল প্রচারিত একটি বাংলা মাসিক পত্রিকায় সেটি লিখেছিল। গল্পের আকারে। হয়তো কেউ সেই গল্পটার সঙ্গে আজকের আমার লেখার মিল পেতে পারেন। আমি আগেই তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। যদিও গল্পটা পড়ার পরে মনে হয়েছিল যে আসল ‘শোভনা’ আমার কাছেই রয়ে গেছে। গল্পের শোভনা অন্য মেয়ে। সেটাই তো সাহিত্যিকের কৃতিত্ব। নতুন চরিত্রের জন্ম দেওয়া।
ডাক্তারি পাস করার পর প্রথমে ইন্টার্নশিপ করতে হয়। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে ঘুরে ঘুরে ডিউটি। আমার প্রথমে পড়েছিল সার্জারি, আমার প্রিয় সাবজেক্ট। ইন্টার্ন মানে জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে খুদেতম সংস্করণ। আমার ওপরে হাউসসার্জন, তার ওপরে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি। একটা ইউনিটে এরা হলো জুনিয়র ডাক্তার। এদের মাথার ওপরে থাকেন আরএস, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং ইউনিট হেড। মোট কথা, ইউনিট হেডের খুব একটা হেডেক থাকে না ইন্টার্নদের নিয়ে। কিন্তু কোনো দুর্বোধ্য কারণে আমি স্যারের চোখে পড়ে গেলাম। বড়ো অপারেশনে থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে ছুরি কাঁচি এগিয়ে দেবার মতো গর্বের কাজে স্যার আমাকে নামালেন। আমি তখন আহ্লাদে আট পিস। স্যার ওটি-র পর আমাকে ডেকে বললেন যে আমাদের ইউনিটে তিনটে বার্ন পেশেন্টের ড্রেসিং যেন আমি নিজে হাতে করি। তারপর রমা বোস, শোভনা চৌধুরী আর ওয়াহাব মির আমার পরম আত্মীয় হয়ে গেল।
শোভনার বয়স মেরেকেটে পনেরো। পুতুলের বিয়ে দেবার বয়সও যায়নি। অথচ হোমিসাইডাল অ্যাসিড বার্নের ভিকটিম। ওর পুড়ে যাওয়ার ঘটনাটা বলার সময় একটুও কাঁদেনি। চোখের মধ্যে একটা শূন্যতা ছিল শুধু। ওর কথা শুনতে শুনতে পুরুষ হিসেবে লজ্জায় মাটিতে মিশেছি। মানুষ হিসেবে ঘেন্নায় বিবমিষা জেগেছে। এতো নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ? খুব দরদ দিয়ে ড্রেসিং করেছি। মনে হয়েছিল অন্য কারোর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার দায়ভার আমার। পুরুষ যে মানুষও হতে পারে সেটা ‘বিশ্বাস হারানো’ একটা মেয়ের কাছে প্রমাণ তো করতেই হবে। সেরে উঠছিল শোভনা -খুব দ্রুত।
ওর জন্য সপ্তাহে অন্তত দুদিন কিছু না কিছু কিনে আনতাম। ফিতে, মাথার ক্লিপ অথবা নীল সবুজ টিপের পাতা। ঝলমল করে উঠতো ওর মুখ। একবার দুদিনের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। শোভনার মুখ ভার। সকালে রাউন্ডের সময় পুরো ইউনিটের সামনে চোটপাট। কেন না বলে গিয়েছি। স্যার পর্যন্ত হতভম্ব। আমার সহপাঠিনী ইন্টার্নের মুখে ফিচেল হাসি। তারপর তার ব্ল্যাকমেল সামলানোর জন্য শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে গোলবাড়ির লাঞ্চ কবুল করে রক্ষা পাওয়া।
এরপরে একবেলা অ্যাবসেন্ট থাকলেও শোভনাকে বলে যেতাম। মাঝখানে পড়লো বিয়ের মরশুম। একদিনের জন্য আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে আটকা পড়ে গেলাম পাঁচদিন। যেদিন সন্ধ্যায় ফিরলাম সেদিন আবার আমাদের ইউনিটের সব জুনিয়র ডাক্তাররা একসঙ্গে নিমন্ত্রণে যাবে। হাউসসার্জন দাদা বললো “রাতের মতো কলবুক এলে সামলে দিস।” বুঝলাম যেখানে যাচ্ছে সেখানে খাদ্যের থেকে পানীয়র আয়োজনটা বেশি আকর্ষণীয়। আমি ইউনিটের রাত পাহারায় রয়ে গেলাম।
রাত এগারোটা নাগাদ বার্ন ওয়ার্ড থেকে কলবুক পেলাম। বুকটা ধড়াস করে উঠলো। ফিরে এসেই শোভনার মুখোমুখি হওয়ার সাহস পাইনি। এখন জেগে থাকলে নির্ঘাৎ একপ্রস্ত বকুনি খাবো। হাসপাতালে ঢুকে সিস্টারের টেবিলে গিয়ে খোঁজ নিলাম শোভনা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা। আমাকে অবাক করে দিয়ে অন ডিউটি সিস্টার জানান যে কলবুকটা শোভনার জন্যই। শোভনা নাকি সাড়া দিচ্ছে না। ছুট্টে গেলাম ওয়ার্ডে। দুবার ডাকলাম ওকে। কোনো সাড়া নেই। পালসে হাত দিয়ে কোনো স্পন্দন অনুভব করলাম না। বুকে স্টেথো বসালাম। হার্ট সাউন্ডের বদলে ঝর্ণার জলের শব্দ। পাশের বেড থেকে রমা মাসিমা বললো যে আমি চলে যাওয়ার পর থেকে ও কাউকে ড্রেসিং করতে দেয়নি। ইঞ্জেকশন নেয়নি, ওষুধও খায়নি। আগেরদিন রাত থেকে তুমুল জ্বর।
সিস্টার বেশ বয়স্কা। আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আমি কিছু না বলে হোস্টেলে ফিরে গেলাম।
আমি এর আগে যতগুলো হার্ট সাউন্ড শুনেছি সবগুলোরই নির্দিষ্ট রিদম আছে। রোগগ্রস্ত হার্টের শব্দ ছাত্রজীবনে বিশ্লেষণ করেছি। কিন্তু কোথাও ঝর্ণার জলের আওয়াজ পাইনি। মেডিসিন বইয়ে কার্ডিওলজির চ্যাপ্টার খুলে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে বসে ছিলাম। রাত দুটোর সময় বার্ন ওয়ার্ডের সিস্টার আবারও কলবুক পাঠালেন।
ওয়ার্ডে যাবার পর সেই সিস্টার আমাকে তাঁর সামনে একটা চেয়ার দিয়ে বসালেন। এখনই পেশেন্টের কাছে যেতে হবে না। তাঁর ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে আমার সামনে রাখলেন -“মনে হয় আগে কখনো ডেথ কনফার্ম করেননি। শোভনা অনেক আগে মারা গেছে।” আমি প্রতিবাদ করে উঠি, আমি যে পরিষ্কার ওর বুকে ঝর্ণার শব্দ শুনেছি।
সিস্টার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর ডাক্তারি ব্যাখ্যা দেন। বার্ন পেশেন্টের প্রোটিন কমে যাওয়ার জন্য ইডিমা। সেই ফ্লুইডগুলো গড়িয়ে নিচে নেমে আসে। তার একটা শব্দ। “মেয়েটা আপনাকে বড্ড ভালবাসতো।”
টিকিটে নোট দিয়ে পালিয়ে আসি। হোস্টেলে না ঢুকে উত্তর কলকাতার রাস্তায় পাগলের মতো হাঁটতে থাকি আমি। শোভনার বুক থেকে ঝর্ণাটা কখন আমার দুচোখের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তারপর থেকে কষ্ট পেলে রবীন্দ্রনাথকে ভাবি। পুত্রের মৃত্যুর পরে লেখেন -“শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাত্রে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্চে, কোথাও কিছু কম পড়েচে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি—-সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারই মধ্যে। সমস্তর জন্যে আমার কাজও বাকি রইল । যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে।”
Sabas Anirban!!!!
Thank you didi
অসাধারণ লাগল গল্প টি। চোখে জল চলে এসেছে।।
ধন্যবাদ রিয়াঙ্কা😊😊😊