“আপনি কি জানেন, প্রতিবন্ধী হওয়া কতো যন্ত্রণার?” চাবুকের মতো মাস্টারমশাইয়ের ভর্ৎসনাগুলো আমাকে আঘাত করছিল। আমি কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিলাম না যে এইভাবে অপারেশন হবার পর সাময়িকভাবে রোগীর নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে থাকে। প্রদ্যুম্নবাবু যে শিক্ষক হিসেবে খুব বিখ্যাত সেটা অপারেশনের সকালে বুঝে গিয়েছিলাম। বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র নার্সিংহোমে ভিড় করেছিল। আর অসংখ্য ফোনও আসছিল। আমার কৃষ্ণনগরের বন্ধু মিঠুনও আমাকে জানিয়েছিল যে প্রদ্যুম্নবাবু কিন্তু খুব রাগী মানুষ। সমাজের বিভিন্ন স্তরে ওনার ছাত্ররা ছড়িয়ে আছেন। “আপনি কিন্তু বুঝেশুনে কেসটা হাতে নিন।”
আমি মিঠুনের চেম্বারে বসি। সমবয়সী এবং ভালো বন্ধু বলে ওর কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনি। কিন্তু সাধারণ একটা হার্নিয়া অপারেশনের জন্য তাঁকে কলকাতায় রেফার করি কিভাবে? মিঠুন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল “শত্রু সিনেমার রঞ্জিত মল্লিককে দেখে কি মনে হয়েছিল?” আমি বলেছিলাম খুব সৎ এবং রাগী পুলিশ অফিসার। “আর শোলের গব্বর সিং?” খুব নিষ্ঠুর আর রাগী ডাকাত সর্দার। “এবার এই দুজনকে ভালো করে গুলে একশো পার্সেন্ট সততা মিশিয়ে একটা শিক্ষকের ছাঁচে ঢেলে দিন। এরপর ভারী আঁচে কিছুক্ষণ গরম করে যেটা তৈরি হবে সেটাই প্রদ্যুম্নবাবু।” এখনো নাকি মধ্য চল্লিশের ছাত্ররা তাঁর নাম শুনলে লন্ড্রিতে নিম্নাঙ্গের পরিধান পাঠাতে বাধ্য হয়।
খুব হেসেছিলাম। আর সত্যি বলতে কি চেম্বারে প্রদ্যুম্নবাবুকে দেখে সেরকম ভয়ংকর কিছু মনে হয়নি। দিব্যি স্নেহশীল মানুষ। আমার নিজের স্কুলের বড়ো মহারাজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আপাত গাম্ভীর্যের আড়ালে আপাদমস্তক নরম একটা মানুষ। না না, এরকম একটা মানুষকে ফেরানোর কোনও যুক্তি নেই। এই অপারেশনটা আমি করে দেবো।
হার্নিয়া অপারেশন সাধারণত স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়া দিয়ে করা হয়। মেরুদণ্ডে খুব সরু একটা নিডল ফুটিয়ে ড্রাগটা ইঞ্জেক্ট করে দিতে হয়। ধীরে ধীরে রোগীর শরীরের নিম্নভাগ অবশ হয়ে যায়। তখন আমরা, সার্জনরা অপারেশন করে দিই। স্পাইনাল দেওয়া এবং তার পরবর্তী যে পরিবর্তন সেগুলো ম্যানেজ করেন অ্যানাস্থেটিস্ট বা অজ্ঞান করার ডাক্তারবাবু। অ্যানাস্থেটিস্ট ডাক্তারবাবুদের নিয়ে সাধারণ মানুষের একটা ভুল ধারণা আছে। অ্যানাস্থেটিস্টরা নাকি ডাক্তার নয়। আসল সত্যিটা হলো অ্যানাস্থেসিয়া একটা কঠিন সাবজেক্ট এবং ডাক্তারিতে বেশ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রছাত্রীরা এটাকে নিজের প্রফেশন হিসেবে বেছে নেয়। প্রদ্যুম্নবাবুকে যিনি অ্যানাস্থেসিয়া দিয়েছিলেন তিনি অভিজ্ঞ এক ডাক্তার।
সব ধরনের অ্যানাস্থেসিয়ারই কিছুনা কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়ার মাথার যন্ত্রণা, বমি, প্রেশার কমে যাওয়া ইত্যাদি খুব কমন কমপ্লিকেশন। পায়ের ওপর দিকে অবশ ভাব অথবা ইঞ্জেকশনের জায়গায় রক্ত জমে যাওয়াও খুব একটা কম দেখা যায় না। এগুলো সবই সময়ের সাথে সেরে যায়। এর বাইরে কিছু কমপ্লিকেশন আছে সেগুলোর বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে আমার পাঠক পাঠিকার প্রেশারের তারতম্য ঘটাতে চাইনা। শুধু এই আখ্যানের স্বার্থে জানিয়ে রাখি যে স্পাইনাল অ্যানাস্থেসিয়ার জন্য নিম্নাঙ্গ একেবারে অচল হয়ে যাওয়ার পুঁথিগত সম্ভাবনা আছে।
প্রদ্যুম্নবাবুর অপারেশন খুব ভালো হলো। বিকেলবেলায় রাউন্ডে গিয়ে দেখি তখনও স্যারের পায়ের দিকের অবশ ভাবটা কাটেনি। সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলেন যে আদৌ পাটা ঠিক হবে কিনা। আমি ডাক্তার হিসেবে আশ্বস্ত করলাম। রাউন্ড দিয়ে বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে নার্সিংহোম থেকে আবার ফোন। স্যার আমাকে ডাকছেন। আবারও গেলাম। এবার পুলিশি জেরা। খুঁটিয়ে অপারেশনের পদ্ধতি জানলেন। কিভাবে অ্যানাস্থেসিয়ার ওষুধ কাজ করে তা জানাও বাদ গেলো না। এবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে পড়লেন। যেগুলো ওনার জানলে ক্ষতি নেই, সেগুলো জানালাম। কিন্তু দুঁদে শিক্ষক। আমার উত্তরের ফাঁকগুলো থেকে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। এমএস-এর ফাইনাল পরীক্ষার হাড় হিম করা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমার এক্সটারনাল ছিলেন এইএমসের প্রফেসর। ঠিক যেন তিনি কোন যাদুবলে প্রদ্যুম্ন স্যার হয়ে সামনে শুয়ে আছেন। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে আমার অ্যানাস্থেটিস্টকে ডেকে পাঠালাম। কুন্ডুদা খুব ভালো বোঝাতে পারেন। আমি কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ডক্টরস’ রুমে এককাপ কফি নিয়ে বসেছিলাম। প্রায় আধঘন্টা বাদে কুন্ডুদা বেরিয়ে এলেন। ফর্সা মুখ অপমানে গোলাপি। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন যে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তবে আমি যেন ওনাকে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিই।
এরপরে দুদিন প্রদ্যুম্নবাবু নার্সিংহোমে ছিলেন। পরেরদিন সকালে দেখি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছেন। আমার সঙ্গে কথা তো বললেনই না, এমনকি খুব একটা তাকালেনও না। সিস্টারের কাছ থেকে ওনার খোঁজখবর নিতাম। ভালো আছেন, তবে সিস্টাররা ওনার ভয়ে একেবারে জড়োসড়ো।
দেখা হলো মাসদেড়েক পর। চেক-আপ করতে এসেছেন। প্রণাম করতে যেতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। “তোমার বড়ো মহারাজকে আমার ধন্যবাদ জানিয়ো, তোমার মতো ছেলেকে তৈরি করেছেন বলে।” মহারাজের কথা ওনাকে আগেই বলেছিলাম। এবার কিছুটা ওনার চরিত্রবিরোধী নরম সুরে বলেন- “আমাকে একবার ডক্টর কুন্ডুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারো? ওনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”
কুন্ডুদাকে বলেছিলাম। কুন্ডুদা রাজি হননি। “তুমি কি আমাকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় যে লোকটি বাঘের গলায় মালা পরিয়েছিল তার মতো ভেবেছো নাকি?” উনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন যে লোককে অজ্ঞান করা তাঁর কাজ, নিজে অজ্ঞান হওয়া নয়।
এরপর প্রদ্যুম্নবাবু অনেকবার আমার চেম্বারে এসেছেন। কলকাতায় চলে যাবার পরে কৃষ্ণনগরে এলে আমার চেম্বারে একবার আসতেনই। গল্প করতে ভালোবাসতেন। কথায় কথায় জানিয়েছিলেন যে তাঁর একটি প্রতিবন্ধী নাতি আছে।
“অনির্বাণ, শারীরিক বা মানসিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষদের পাশে থেকো।”
প্রদ্যুম্ন স্যার আজ আর নেই। কিন্তু তাঁর জীবন-দর্শন আজও আমার চলার পথে আলো জ্বালিয়ে রাখে।
অসাধারণ লেখা, পড়ে খুব ভালো লাগলো।
সব্বাইকে শ্রদ্ধা ও আপনাকে প্রণাম 🙏
You are excellent . So nice writing skill .
খুব ভালো লাগলো, অবির্বান আরও অনেক কিছু চাই তোমার কাছে
আবার অসাধারণ।