“এবারে বৃষ্টি নিয়ে লিখতে হবে”- সম্পাদকের ফোন পেয়ে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। আমার তো মানুষ নিয়ে লেখার কথা! আর সত্যিই বেশ কয়েকটা বর্ণময় চরিত্রের কাছাকাছি আসার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেই পনেরো – কুড়িটা মানুষকে গল্পের আকারে মনের মধ্যে সাজিয়েও ফেলেছি। এখন এ কিরকম বায়নাক্কা?
ফোনটা যখন পেয়েছিলাম তখন অবশ্য আমি মেঘের দেশে বেড়াতে গিয়েছি। হাসপাতালের সাথে দড়ি টানাটানি খেলে ঠিক পাঁচদিনের ছুটি ম্যানেজ হয়েছিল। শোঁ করে মেঘালয় -চেরাপুঞ্জি। কিন্তু সেই সময় চেরাপুঞ্জি ‘একখানা মেঘ ধার’ দিয়েছিল গোবি সাহারার বুকে। ফলে সেখানেও বৃষ্টি নেই। “বর্ষা নামে আমার এক ভাইঝি আছে বটে। কিন্তু তাকে নিয়ে লেখার মতো কোনো ঘটনা তৈরি হয়নি। আর মানুষ নিয়ে লিখতে বসে বৃষ্টির কথাই বা লিখবো কেন?” আমি ফোনেই প্রতিবাদ জানালাম।
পরিষ্কার বুঝতে পারলাম ফোনের ওপারে দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে উনি মুচকি হাসছেন -“ভাবো, ভাবো- ভাবা প্র্যাকটিস করো।” বুঝলাম সম্পাদক মশাই এখন ঋত্বিক ঘটক মোডে রয়েছেন। তাঁকে বেশি না ঘাঁটিয়ে ফোন কাটার পরে ভাবনাতেই পড়ে গেলাম আমি।
চেরাপুঞ্জিতে একটা হোম স্টেতে সপরিবারে ছিলাম আমরা। হোম স্টের মালকিন এক খাসী মহিলা। বয়স দেখে মনে হয় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। কিন্তু মহিলাদের বয়স ব্যাপারটাই গোলমেলে। শুনেছি জিজ্ঞেস করাও অসভ্যতা। চাকরি জীবনের প্রথমদিকে আমার এক মহিলা স্টাফকে তার মায়ের আগে রিটায়ার করতে দেখেছি। পাজল্ সলভ করার জন্য মাকে কারণটা জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম। সে উত্তর দিয়েছিল “জয়েন করার সময় সাহেব যা বুঝেছিলেন সেই বয়সই দিয়েছিলেন।” ভয়ে আর চাকরিদাতা সাহেবের নাম জিজ্ঞেস করিনি। আমি তো আর ইডি বা সিবিআই নই যে অন্যের ঘোটালা নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করতে বসে যাবো!
যাহোক, হোম স্টেটা কিন্তু থাকার জন্য খুব ভালো। রাঁধুনি ছোকরাটাও বেশ চটপটে। যা অর্ডার করা হচ্ছিল তাই টুক করে বানিয়ে ফেলছিল। সন্ধ্যাবেলায় একপ্রস্ত চিকেন পকোড়া আর কফি করেছিল। লাঞ্চটাও মন্দ বানায়নি। রাতের জন্য ঝালঝাল মুরগীর মাংস আর সরু রুটি। মেয়ে হলে নির্ঘাত ছেলেটার প্রেমে পড়ে যেতাম। বেশ মিষ্টি নিষ্পাপ দেখতে।
রাতে খাবার পর মৌরি চিবোতে চিবোতে মালকিনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। আবহাওয়ার খবরটবর নিচ্ছিলাম। আমরা ওখানে যাবার আগে নাকি বৃষ্টি হয়েছিল। উনি বললেন যে এইসময় টানা দুদিন বৃষ্টি না হওয়াটা বেশ আশ্চর্যের। তবে বিকেলের দিকে আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ভাসছিল। হিসাব অনুযায়ী রাতে বৃষ্টি হবে।
“বৃষ্টি হলেও তো আপত্তির কিছু নেই। আপনার পুত্রটির রান্নার হাত খুব ভালো। চুটিয়ে খাবোদাবো আর গুছিয়ে আড্ডা মারবো।” আগেই শুনে নিয়েছিলাম এই হোম স্টেতে কেউ বাইরের লোক কাজ করেনা। ফ্যামিলি মেম্বারদের কেউ রাঁধুনি, কেউ ঝাড়ুদার তো কেউ ম্যানেজার।
ভদ্রমহিলা আমার কথায় কোনো কারণে বিরক্ত হলেন। একটু ঝাঁঝিয়ে বললেন যে তাঁর ছেলে শিলং-এ পড়াশোনা করে। যে রান্না করে সে তাঁর ছেলে নয়। মালকিনের পাশে একজন বসেছিল। এই একটা মাত্র লোককে এসে পর্যন্ত কোনো কাজ করতে দেখিনি। কোনো না-কোনো চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগের সাথে শুধু ধূমপান করে যায়। মালকিন চোখের ইশারায় তাকে উঠে যেতে বলেন।
ভদ্রলোক দেখলাম বেশ বাধ্য। মোটা একটা চুরুট মুখে দিয়ে স্মোক-টেস্ট না করা গাড়ির মতো ভকভক করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাইরে রাখা বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলো।
ভদ্রমহিলা গলা নামিয়ে যে কথা বললেন তা শুনে আমার ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা। রাঁধুনি ছেলেটি তাঁর স্বামী। হাজব্যান্ড কথাটার অর্থ তো স্বামীই হয়। নিজের ইংরেজি বিদ্যায় আস্থা হারিয়ে গুগল করবো কিনা ভাবছি তখনও। এই প্রত্যন্ত জায়গায় ডিকশনারি পাওয়ারও আশা নেই। ফিরে গিয়েই কানটা একটা ভালো ইএনটি স্পেশালিষ্টকে দেখাতে হবে ঠিক করে নিয়ে ঘরে চলে এলাম। আর কথা বাড়াইনি।
আমার ঘুম পাতলা ধরনের। গভীর রাতে পুরুষের আর্তচিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। মিসেস বারণ করা সত্বেও একটা চাদর জড়িয়ে বাইরে এলাম। দেখলাম সম্পূর্ণ মত্ত অবস্থায় মালকিন ভদ্রমহিলা অনর্গল চুরুট খাওয়া লোকটাকে একটা লাঠি নিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছেন। আমাকে দেখে গজগজ করতে করতে সামনের একটা ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ভদ্রলোকের ভালোই চোট লেগেছিল। আমার ফার্স্টএইড বক্স থেকে কিছু ওষুধপত্র বার করে দিলাম। কাটা জায়গাগুলো ড্রেসিং করে দিয়ে ভদ্রলোককে তার ঘরে নিয়ে গেলাম। হোম স্টের পেছন দিকে একটা ঘুপচি ঘর। বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। দুদিনের বৃষ্টি না হওয়াটা যেন সুদে-আসলে পুষিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। ভদ্রলোক তখনও থরথর করে কাঁপছিল। “কেয়া হুয়া থা?” আমি ওর পিঠে হাত রেখে প্রশ্ন করি।
বাইরে একটানা বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভদ্রলোক কথাগুলো বলছিল। মাঝেমধ্যে হেঁচকির মতো একটা আওয়াজও করছিল। আধা হিন্দি, কিছুটা ইংরেজি আর কিছুটা না-জানা স্থানীয় ভাষায় ভদ্রলোক যা বললো তাতে আমার পিলে যে চমকে পেটের বাইরে চলে আসেনি তাই আমার উর্ধতন চোদ্দ পুরুষের সৌভাগ্য।
এই ভদ্রলোক মালকিনের প্রথম স্বামী। দ্বিতীয় স্বামী আছে মালকিনের দেশের বাড়িতে। সেখানকার বাড়িঘর সামলায়। সে নাকি বোতল ছাড়া থাকতে পারেনা। মেঘালয়ের ডাক্তাররা বলেছে যে তার লিভারটা মৃত্যুর পর মিউজিয়ামে রেখে দেবে। দেশের বাড়িতে থাকলে মালকিন তার ওপরেই লাঠি খেলা প্র্যাকটিস করেন। ছোট স্বামী বছর দুই-তিন স্বামীত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। গতবছর বর্ষাকালে সে পালিয়েছিল। আসাম থেকে তাকে পরে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল।
বড় স্বামী নিজের মতো ব্যাখ্যা দেয়- আসলে বর্ষাকালটা ডাল সিজন। কাস্টমার থাকেনা। তাই ও পালিয়ে যায়। আসামে গিয়ে তো একটা হোটেলে কাজ ধরেছিল। একটা অল্পবয়সী মেয়ের সাথে আশনাইও হয়েছিল। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-বাঝিয়ে তাকে ফেরত আনা হয়েছে।
আজ রাত বাড়তেই তুমুল বৃষ্টি। ছেলেটাকেও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। মালকিন গাড়ি নিয়ে এদিক-ওদিক খুঁজে এসেছে। না পেয়ে ফিরে মদ্যপান এবং বড় স্বামীকে মারধর। আমার মাঝে মাঝে গুঁজে দেওয়া প্রশ্ন থেকে জানতে পারলাম যে খাসী মহিলারা এখনও দুতিনটে বিয়ে করে। ওদের সমাজে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
পরদিন সকালে চেক আউট করলাম। এই পরিবেশে আমরা আর কেউ থাকতে চাইছিলাম না। মালকিন একাই ছিলেন চেক আউটের সময়। যে চারপাঁচ জন স্টাফ থাকতো তাদের কাউকে দেখলাম না। ভদ্রমহিলা আমাদের লাগেজগুলো গাড়িতে তুলে দিলেন। আমাদের বারণ শুনলেন না।
আমাদের গাড়ি শিলং পেরিয়ে যখন গুয়াহাটির দিকে দৌড়চ্ছিল তখনও বেশ বৃষ্টি। জানালা দিয়ে আমি পালিয়ে যাওয়া ছেলেটাকে খুঁজছিলাম। কেনই বা বাপু বিয়ে করলি আর কেনই বা পালিয়ে বেড়াচ্ছিস? ‘স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম দেবা না জানন্তি’- একদম ভুল কথা। পুরুষের চরিত্রও ক্ষেত্র বিশেষে বোঝা দুষ্কর। আসলে কাউকে বেশি জোরে বাঁধতে নেই। সে নারীই হোক বা পুরুষ।
সবাই বোধহয় কিছুটা স্পেস চায়। একদম নিজের জন্য।
Nice as usual
ধন্যবাদ দিদি 😊😊😊
Oh lovely! Fantastic .
Thank you 😊😊😊
Moral of the story টা একদম ঠিক sir.আরও একই সুন্দর গল্প।