রবিন কুকের একটা উপন্যাস আছে। গডপ্লেয়ার নাম। গড প্লেয়ারের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছে এক কার্ডিয়াক সার্জন। নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। এমনকি খুন পর্যন্ত। হাড় হিম করা থ্রিলার। শেষ পর্যন্ত- ‘সত্যমেব জয়তে’।
সমাজের সব পেশায় সফল মানুষরা কি জীবনের কোনো একটা সময় নিজেকে সর্বশক্তিমান ভাবতে শুরু করে? একটা আলগা মন্তব্য করেই ফেলি। রবীন্দ্রনাথও কি বলেননি- আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে/ যাব আমি চলে। কবিতার আড়ালে কি সেটি কবির মনের কথা ছিলনা? অবশ্য বিশ্বকবির কথা আলাদা -মৃত্যু তাঁর কাছে সত্যিই মাথা নিচু করে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল।
আর নেতা-মন্ত্রীদের কথা বাদ দিন। তারা ভোটে জেতার পরদিন থেকে রজনীকান্ত মোডে চলে যায়। কথায় কথায় এক বলে ছটা ছক্কা হাঁকায়। ছুটে আসা বন্দুকের গুলিকে দাঁতে কামড়ে ফুঁ দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। তারা বাঁটুল দি গ্রেট, ফ্যানটম আর স্পাইডার ম্যানের ককটেল। তারা যথার্থই সর্বশক্তিমান।
আমি আমজনতার কথা বলছি। সেখানে বিভিন্ন পেশার মানুষের হামবড়াই বড্ড চোখে লাগে। নিজে বড়ো প্রমাণ করতে অনেককে অহেতুক কলিগদের নিন্দা করতে শুনেছি। নিজেকে দুভাবে বড়ো প্রমাণ করা যায়, এক নিজেকে সত্যি বড়ো করে। দুনম্বর রাস্তাটা বেশ সোজা- অন্যকে ছোট করে। সহজ রাস্তাই বেশি মানুষ বেছে নেয়। আর এই হামবড়াইটা যখন ডিজঅর্ডারের দিকে বাঁক নেয় তখন তার ডাক্তারি নাম হয়ে যায় নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার। গড কমপ্লেক্স। গড কমপ্লেক্স অবশ্য ডাক্তারি টার্ম নয়। সৃজিত মুখার্জি তাঁর ‘দশম অবতার’ সিনেমায় এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। গড কমপ্লেক্স আর এনপিডি ঠিক এক নয়।
ভেবেছিলাম একজন সিনিয়র ডাক্তারের কথা লিখবো। তাঁর আকর্ষণীয় চরিত্র এবং কথাবার্তা ‘অনেক মানুষ’এর গল্প হওয়ার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু এইধরনের লেখার একটা বিপদও আছে। মানুষটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তাঁর দোষ গুলো শব্দে বাঁধবার আগে দেখে নিতে হয় আসল পরিচয় ঠিকঠাক আড়াল করা গেল কিনা। দুনম্বর জিনিস যেটা দেখতে হয় সেটা আরও বিপজ্জনক -আমিও একই দোষে দুষ্ট নই তো? কোন পরিস্থিতি তাঁকে এরকম একটা মানসিক ফানুস তৈরি করার দিকে টেনে নিয়ে গেল?
সেটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেলাম। নিজের ওপর একটা বার্ডস আই ভিউ নিতে গিয়ে চমকে উঠলাম। আরে, আমারও তো কিছুটা হাম সবসে বড়া ভাব আছে। কিন্তু হলো কিকরে?
ঘটনার সূত্রপাত একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলার ব্রেস্ট ক্যান্সার অপারেশন করার পর। এফএনএসি বা সূচ ফুটিয়ে পরীক্ষার রিপোর্টে টিউমারটা সন্দেহজনক বলেছিল।তাই অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিই। অপারেশন করার পর বায়োপসি রিপোর্ট বললো ক্যান্সার। কিছুটা স্বান্তনা দেবার জন্য আর কিছুটা সত্যিই আমার মনে হয়েছিল বলে জানালাম যে স্লাইড রিভিউ করাতে হবে। মনে হয়না ক্যান্সার হয়েছে। ভালো জায়গার রিপোর্ট বললো যে ক্যান্সার নয়। রোগীর বাড়ির লোক অধরের সরপুরিয়া আর রিপোর্ট নিয়ে চেম্বারে হাজির। তারপর ভদ্রমহিলা যতবার চেম্বারে আসতেন তাঁর বাড়ির লোকজন অপেক্ষারত রোগীদের কাছে আমার ভগবানত্ব বর্ণনা করতেন। আমার চেম্বারের ছেলেমেয়েরা আমাকে সেগুলো জানাতো। শার্টের ওপর দিকের বোতামে চাপ পড়তো।
দ্বিতীয় ঘটনাটা একটা গরীব রোগীকে নিয়ে। তার কৃতিত্ব অবশ্য একজন কোয়াক ডাক্তারকে দেওয়া যায়। অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস বা পিত্তরস আটকে জন্ডিস হয়েছিল পেশেন্টের। আলট্রাসাউন্ড যে ডাক্তারবাবু করেছিলেন তিনি পিত্তনালীতে কোনো পাথর খুঁজে পাননি। প্রদাহজনিত কারণে হতে পারে আবার ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ থেকেও হতে পারে। মেডিকোলিগাল কারণে (সেটা যে কি ভয়ানক ‘বাঁশ’ কারণ তা একটা ডাক্তারই জানে) তিনি ব্রাশ সাইটোলজি করার কথা লিখেছিলেন। সেটি পড়ে সেই কোয়াক ডাক্তার রোগী এবং তার বাড়ির লোকজনের মাথায় ক্যান্সার কথাটা এমন ভয়ংকর ভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে জগতের কোনও নিউরোসার্জনের ক্ষমতা নেই তা বার করে।
মানুষ শেষ অবস্থায় হাসপাতালে দিয়ে দেয় রোগীকে। শেষ নিশ্বাস চেখের আড়ালে ফেলুক। অল্পবয়সী মেয়ে, ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে। একশো একটা কারণ আছে অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস হওয়ার। সব শেষ কারণ ক্যান্সার। সেটাকে এক নম্বরে রাখতে আমার চিকিৎসা বিদ্যা ভয়ানক প্রতিবাদ করছিল। বাড়ির লোককে সেকথা জানাতে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল- একেবারে মুখ্যু ডাক্তার জেলা হাসপাতালে এসেছে গো। এতো খরচ করে করা রিপোর্টেও ভরসা নেই। আমি আলট্রাসোনোগ্রাফির ডাক্তারকে ফোন করি। ওদের আড়ালে। আমার সন্দেহই ঠিক। মেডিকোলিগাল কারণে লেখা – তারও ধারণা ইনফ্ল্যামেটরি কারণ। হদ্দ গরীব রোগী। আমি আর বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা করালাম না। জন্ডিস সারিয়ে গলব্লাডার অপারেশন করে রোগী বাড়ি গেল।
“গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে-“। এরপরের গল্পগুলো সাংঘাতিক। শেষ অবস্থার পেশেন্টদের আমার কাছে এনে অনুরোধ -‘আপনি শুধু মুখে বলুন যে ভালো হয়ে যাবে।’
গড কমপ্লেক্স। বেশ কয়েকদিন আমি দশম অবতার। বেলুন ফুটো হলো দুটো রোগী খারাপ হতে। মাটিতে পা ঠেকতে সময় লাগলো না। খারাপ হয়ে যাওয়া দুটো রোগীর গল্প পরে লিখবো।
এ গল্প শুধু আমার নয়- আমার মতো অনেক ডাক্তারের। অন্য পেশার মানুষদেরও।
দারুন অনির্বাণ, তোর লেখা যত পড়ছি, তত মুগ্ধ হচ্ছি, পড়া শুরু করলে, একটা হালকা নেশা অনুভব করছি, শেষ না হওয়া পর্যন্ত নেশাটা তাড়া করছে। ক্লাস মেট অনির্বাণ কে চিনতাম, নতুন করে লেখক অনির্বাণ কে চিনছি, ভাল লাগছে।
🙏❤️