যা-ই বলুন, অর্ণব গোস্বামীর টক শো-গুলো কিন্তু দিব্যি হতো। যদিও অনেকদিন দেখা হয় না, কিন্তু যেটুকু দেখেছি তাতেই স্মৃতির মণিকোঠায় একেবারে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
অত্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অর্ণববাবুর বিরোধীপক্ষের বক্তারাও ডাক পেতেন। বলার সুযোগও পেতেন। চোখা চোখা প্রশ্ন থাকত তাঁদের উদ্দেশে। কিন্তু মজাটা তারপরই। খানিক বাদেই তাঁদের উত্তর দেবার সময় মাইক্রোফোন অফ করে দেওয়া হতো। আমরা দেখতে পেতাম সেই বক্তাকে – হাত-পা ছুঁড়ে প্রাণপণে কিছু বলার চেষ্টা করছেন তিনি – কিন্তু আমরা তাঁর বক্তব্য শুনতে পাচ্ছি না। এই সাইলেন্ট মোড-এ বক্তব্য প্রকাশের চেষ্টা মানুষটাকে প্রায় হাস্যকর করে তুলত। ওদিকে সাইলেন্ট মোড-এ রাখতে পারার সুযোগে, দৃপ্ত কণ্ঠে চৌকস ইংরেজিতে, মহামহিম অর্ণব গোস্বামী নিজের বক্তব্যের যথার্থতা প্রতিষ্ঠা করে ফেলতেন।
তখন মাঝেমধ্যে আমোদ পেলেও মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে, সেই টক শো-য় হাজির বক্তাদের মতো, প্রায় একই ধরনের অনুভূতি টের পাচ্ছি।
আমি ক্লজ জি-র প্রার্থী। অর্থাৎ মেডিকেল শিক্ষক-চিকিৎসক হিসেবে প্রার্থী। আমাকে ভোট দিতে (এবং আমাকে ব্যালটে অপছন্দ করতে) পারবেন শুধুমাত্র মেডিকেল শিক্ষক-চিকিৎসকরাই। বাকি ডাক্তারদের ব্যালট ডাকযোগে বাড়িতে এলেও এই ক্লজ জি-র ব্যালট আসবে কলেজ অফিসে। প্রিন্সিপালের কাছে। সেই অফিস থেকেই শিক্ষক-চিকিৎসকদের কাজ ব্যালট সংগ্রহ করা।
কিন্তু এবারে দুই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা প্রার্থী না হলেও একদল চিকিৎসক দাঁড়িয়েছেন সরাসরি ‘তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে। অনেকসময় তাঁরা আবার নিজেদের ‘সরকারপন্থী’ হিসেবেও পরিচয় দিচ্ছেন। দ্বিতীয় কথাটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেছি। কেননা, আদতে আমি সরকারি কর্মচারী। সরকারে থাকা দলটিকে অপছন্দ করলেও সরকারি কর্মী হয়ে সরকার-বিরোধী হতে পারব কী করে!!
কিন্তু সে কূট প্রশ্ন থাক।
কথাটা হলো, এই -পন্থী চিকিৎসক প্রার্থীদের সমর্থনে মেডিকেল কলেজগুলোর প্রশাসককুল একেবারে মুক্তকচ্ছ হয়ে নেমে পড়েছেন। প্রশাসনিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সরাসরি তাঁদের জেতানোর আহ্বান জানাচ্ছেন। কলেজ চলাকালীন, ভরপুর অফিস আওয়ারে, -পন্থী চিকিৎসক প্রার্থীদের সমর্থনে সভা আয়োজিত হচ্ছে – অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা সেই সভায় যাতে সকলে উপস্থিত থাকেন, সে বিষয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধানদের ‘অনুরোধ’ করছেন। আরেকটু সাবধানী অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা অনুরোধটা মেসেজে না পাঠিয়ে ফোনের মারফত করছেন। সভাতেও অনুরোধ আসছে ভোট দেওয়ার নয় – ফাঁকা ব্যালট হাতে তুলে দেবার বা ব্যালট নিজে ভরলেও খামের মুখ খোলা রেখে বিশ্বাসভাজনদের হাতে তুলে দেবার। -পন্থী চিকিৎসক প্রার্থীরা, যথার্থ কারণেই, আত্মবিশ্বাসী – কেননা তাঁরা জানেন, সভায় হাজির চিকিৎসকরাও (বা হাজির থাকতে বাধ্য হওয়া চিকিৎসকরা) যদি ‘নিজের ভোট নিজে দেন’, তাহলে হিসেবনিকেশ মিলিয়ে ওঠা যাবে না।
আগামী সপ্তাহ থেকে ব্যালট আসবে। সেই ব্যালটের বণ্টনে কলেজ প্রশাসকরা যে খুবই যথাযথ ভূমিকা পালন করতে চলেছেন, তা মোটামুটি এখন থেকেই নিশ্চিত।
তো যেকথা বলছিলাম, অর্ণব গোস্বামীর টক শো-য় হাজির থাকা বিরোধী বক্তার অভিজ্ঞতা।
ভোটে দাঁড়িয়েছি। ব্যালটে নামও থাকছে। কিন্তু সেই ব্যালটের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত।
উপরিউক্ত টক শো-র বক্তাদের মতোই মিউট মাইক্রোফোনের সামনে প্রাণপণে বক্তব্য রাখছি। রেখে চলেছি। স্বরহীন সেই বক্তব্যের আস্ফালন দেখে হয়ত কেউ কেউ আমোদও পাচ্ছেন।
কে জানে, সেই আমোদিত জনগণের মধ্যে আমাদেরই সহকর্মীরাও রয়েছেন।
না, ‘কে জানে’ নয়, নিশ্চিতভাবেই রয়েছেন।
তাঁদের উদ্দেশে কী-ই বা বলার আছে আর! এই মাগ্যিগণ্ডার বাজারে আপাতত তাঁদের আমোদ জোগাতে পারছি, সে-ই বা কম কী!!