বিগত ১২ দিন ধরে মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের অনশন আন্দোলন সম্পর্কে আপনারা অবগত।
২২ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হবার পরেও, কোনোরকম লিখিত নোটিশ ছাড়াই শুধুমাত্র মৌখিক ভাবে নির্বাচন বাতিল করে যে অগণতন্ত্র মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ওপর আজ আসীন – তার ন্যায়বিচার, তার সমাধান খুঁজতেই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। অগণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচন বাতিলের বিরুদ্ধে অবস্থান আন্দোলনে কী পেল তারা?? যে অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের এতদিন সম্মানের সাথে, শ্রদ্ধার চোখে দেখত তারা, যে অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের দায়িত্ব ছিল সমাজসচেতন চিকিৎসক তৈরীর দিশা দেখানোর – তারাই শারীরিক ভাবে হেনস্থা করলেন ছাত্রছাত্রীদের। আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ভাবে ব্যাহত করা হল স্বাস্থ্যপরিষেবা। তবু মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সরে আসেনি ন্যায্য দাবির লড়াই থেকে। অগণতন্ত্রের প্রতিকার চেয়ে অনশন আন্দোলনে উপনীত হয়েছিলাম আমরা। একাধিকবার উত্তর চেয়েও কর্তৃপক্ষের থেকে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। যে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে মৌখিক ভাবে বাতিল করা হল নির্বাচন – সেই উর্ধতন কর্তৃপক্ষও আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব থেকেছে সদুত্তরের প্রশ্নে । গতকাল সংবাদমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পেরেছি মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল, MSVP নাকি ‘মানসিক চাপের’ জন্য আর মেডিকেল কলেজে আসতে পারবেন না। স্বাস্থ্যভবন থেকেই আপাতত তাঁরা কলেজ ও হাসপাতালের কাজ চালাবেন। আমরা বিস্মিত। আমাদের বন্ধুরা, আমাদের ভাইরা গত এগারোদিন না খেয়ে অনশনমঞ্চে আসীন। এই লড়াই কোনো আকাশকুসুম দাবির জন্য নয়। ২২শে ডিসেম্বর ছাত্রছাত্রীসংসদ নির্বাচনের তারিখ দিয়েও কেন অগণতান্ত্রিক ভাবে তা বাতিল করা হলো- তার সহজ উত্তর চেয়েছিলাম আমরা । আমাদের এই অনশন আন্দোলন পশ্চিমবাংলার গণতন্ত্র ভূলুন্ঠিত হওয়ার বিরুদ্ধে! তার জন্য ‘মানসিক চাপ’ হচ্ছে কিনা কলেজ অধ্যক্ষ ও MSVP-র! যেখানে অনশনমঞ্চের কাছে কোনো ওয়ার্ড নেই এবং অনশনকারী ও আন্দোলনকারীরা চিকিৎসা পরিষেবার সাথে সরাসরি যুক্ত নয় ।বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এই পরোক্ষ মানসিক চাপ আসলে উপরমহল প্রসূত ।
প্রশ্ন ওঠে গত ১২ দিনের অনশন আন্দোলনে কী পেয়েছি আমরা? পেয়েছি অগণিত সমর্থন। অপ্রত্যাশিত ভাবে সমর্থন এসেছে মেডিকেলের কলেজের পরিষেবাপ্রাপ্ত রোগীদের থেকে। ছাত্রছাত্রীদের থেকে। আপামর নাগরিক সমাজ থেকে। সামগ্রিক ভাবে সাধারণ জনগণের থেকে৷ সমর্থনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সী, যাদবপুর, বিশ্বভারতী সহ অগুনতি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ১৩ ডিসেম্বর এবং আজকের ছাত্রছাত্রী নাগরিক মিছিলে রাজপথ দেখেছে সেই সমর্থন। পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সমাজের বিশিষ্টজনেরা৷ সংহতিবার্তায়, ভিডিওবার্তায়, সামাজিক মাধ্যম থেকে অনশনমঞ্চ – এই সমর্থনে আমরা বিস্মিত, আপ্লুত, কৃতজ্ঞ। ১৭ ই ডিসেম্ভর গণকনভেনশনে মেডিকেল কলেযে আমরা সেই সমর্থনকে পাশে পেয়েছি।
আজকে মেডিকেল কলেজের এই আন্দোলন ৮৮ কলেজস্ট্রীটের সীমানায় আবদ্ধ নেই। রাজপথ পেরিয়ে মেডিকেলের ন্যায্য দাবির আন্দোলন আজ ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে৷ শিক্ষার্থীদের কাছে, যুবকযুবতীদের কাছে, সাধারণ মানুষের কাছে। আজ এই লড়াই আপামর ছাত্রছাত্রীদের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই। বিগত ছয় বছর ধরে প্রায় সমস্ত কলেজেই ছাত্রছাত্রী সংসদ নির্বাচন বন্ধ। শাসকদল পরিকল্পিত ভাবে খর্ব করেছে ছাত্রছাত্রী সহ আপামর নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকার। আমরা মনে করছি আজ আমাদের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে ব্যাপক সমর্থন সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
গত ৩০ শে নভেম্বর কলেজ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২২ ডিসেম্বর মেডিকেল কলেজ ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছিল। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করলেও তার কোনো লিখিত নোটিশ আমরা পাইনি। আন্দোলন চলাকালীন পরিকল্পিত চক্রান্ত করে যেভাবে রোগী পরিষেবা ব্যাহত করা হয়েছে, যেভাবে ছাত্রছাত্রীরা শিকাকার হয়েছে অগণতন্ত্রের, কর্তৃপক্ষের উদাসীন ব্যবহার – আমরা মনে করি মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সামগ্রিক ভাবে ছাত্রছাত্রী এবং রোগীদের দায়িত্ব নিতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।
মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ১৮৮ বছরের ঐতিহ্য আমাদের শিখিয়েছে কলেজে দায়িত্ব শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের নয়, ছাত্রছাত্রীদেরও বটে। কলেজের সামগ্রিক গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব একটি সর্বাঙ্গীণ প্রক্রিয়া যেখানে দায়িত্ব বর্তায় কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্রছাত্রীসহ সমস্ত জনসাধারণের। ২২ ডিসেম্বরের নির্বাচনের যে দিন ঘোষণা করা হয়েছিল – তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্রছাত্রীরা। শাসক দলের হস্তক্ষেপে সেই নির্বাচনের সমস্ত দায় অস্বীকার করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সরকারী হস্তক্ষেপে কলেজ কর্তৃপক্ষের এই নতিস্বীকার লজ্জার। আজ মেডিকেল কলেজে গণতন্ত্রর অধিকার রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর ওপর। সাধারণ ছাত্রছাত্রী হিসেবে মেডিকেল কলেজ সমস্ত সমাজের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ গণতন্ত্র রক্ষার এই লড়াইকে আরো উচ্চতর পর্যায়ে সঙ্ঘবদ্ধ করতে। আজকে সেই অঙ্গীকারকে মাথায় রেখেই ছাত্রছাত্রীরা সমাবেত হয়েছিল সাধারণ সভায়। সেখানে একত্র হয়ে ছাত্রছাত্রীরা স্থির করেন আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী করে,উচ্চতর পর্যায়ে লড়াই সঙ্ঘটিত করতে কলেজ কর্তৃপক্ষের পূর্বনির্ধারিত ২২ ডিসেম্বর তারিখেই মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের দায়িত্বে নিজেরাই গড়বে মেডিকেল কলেজ ছাত্রছাত্রী সংসদ । ঐতিহাসিক সাধারণ সভায় ছাত্রছাত্রীরা অঙ্গীকারবদ্ধ হোন নিজেদের দাবিতে নিজেদের ইউনিয়ন গড়ে তুলবে মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। এই ইতিহাস আজকের নতুন নয়। ১৯২৮ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন বৃটিশ সরকার যখন অস্বীকার করেছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অধিকারকে, ছাত্রছাত্রীদের সংসদ নির্বাচন করতে অস্বীকার করেছিল – সেখানেও দৃষ্টান্তমূলক ভাবে নিজেদের ইউনিয়ন নিজেরা গড়ে তুলেছিল মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। সেই ইউনিয়ন সক্রিয় ভাবে জারি থেকেছে মেডিকেলের অধিকারের লড়াইয়ে, স্বাধীনতার লড়াইয়ে, সমাজে ঘটে চলা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। ২০ বছর ধরে সেই ইউনিয়ন জারি থেকেছে স্বঘোষিত ভাবে।সেই ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করে আজকেও গণতন্ত্র রক্ষার এই কঠিন দায়িত্ব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মাথা পেতে নিচ্ছে মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা।
আমরা আশা রাখি মেডিকেল কলেজের দৃষ্টান্ত অনুপ্রাণিত করবে সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়কে । বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাবে শাসক দল ছলে বলে কৌশলে দমন করেছে গণতন্ত্রের বাতাবরণকে – তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশের লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দিকে দিকে সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গড়ে উঠবে স্বাধীন ছাত্রছাত্রী ইউনিয়ন। নিজেদের দাবিকে, নিজেদের অধিকারের লড়াইকে ছড়িয়ে দেবে দিকে দিকে,সমাজের বুকে। এভাবেই গণতন্ত্রের লড়াই, ন্যায্য দাবির লড়াই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে সমাজের আপামর জনগণের চেতনায়। গণতন্ত্র রক্ষার সেই লড়াইয়ে পা মেলাবে মেডিকেলের আপামর ছাত্রছাত্রীরা – এই প্রতিশ্রুতি আজ রইল সমাজের কাছে।
সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীসংসদ নির্বাচনের লড়াইয়ে সামিল হোন। গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে সংগঠিত হোন।