গ্রামীণ এক হাসপাতালের চিকিৎসক তখন। শ্রাবণের এলোপাথাড়ি হাওয়া চলছে বাইরে। বৃষ্টি নেই। আকাশে মেঘের ভ্রূকুটি। লম্বা সাদা দাড়িওলা এক বৃদ্ধকে নিয়ে এক যুবক ঢুকলো হাসপাতালের ইমারজেন্সী রুমটায়। প্রবল শ্বাসকষ্ট। বুকের শ্বাসবায়ু যেন চোখের কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। মুখে কথা বলবার জো নেই। আমাকে দেখে চোখের কোন থেকে দু ফোঁটা জল বেরিয়ে এলো বৃদ্ধের।
হাত নেড়ে কিছু বলবার উপক্রম করতেই হাতখানা টেনে পালস পরীক্ষা করে স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুকের পেছন দিকটা পরীক্ষা করে বুঝলাম, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারী ডিজিজে আক্রান্ত। এই রোগের অ্যাকিউট সিম্পটম নিয়ে এসেছেন উনি।
চোখের ঈশারায় সিস্টার দিদিমনি নেবুলাইজেশানের ব্যবস্থা করলেন। ফটাফট প্রয়োজনীয় ইঞ্জেকশনগুলো দেওয়া হলো। মিনিট দশেকের অপেক্ষা। কষ্ট কমলো খানিক।
হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে কাছে টেনে নিলেন বৃদ্ধ। আমার হাতদুটো বুকে চেপে ধরে কি যেন বিড়বিড় করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন পরম স্নেহে। প্রান্তিক হাসপাতালে কাজ করার সুবাদে এ স্নেহের পরশ এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। এখন আর অপ্রস্তুত হইনা মোটেই।
বৃদ্ধের সাথে আসা যুবক আমার দিকে তাকিয়ে বলল – “ওসমান চাচাকে আপনি নিজের ব্যাগ থেকে একটা ইনহেলার দিয়েছিলেন গত মাসে। সেই নিয়ে সুস্থই ছিলেন। গত সাত দিন ইনহেলার শেষ। কেনার পয়সাও নেই। চাচা অন্য কাউকে দেখাবেও না। জেদ, শুধু আপনার কাছেই দেখাবেন। তাই এই আবহাওয়ায়ও এত কষ্টে বাসে চেপে এত্তদূর এসেছেন আপনার কাছে”।
কথাগুলো সেদিন সত্যিই কোনো দাগ কাটেনি আমার মনে। ডাক্তারের মন যোগাতে কত লোকেই তো কত কিছু বলে। তাতে গা ভাসালে কি আর চলে? আর রিপ্রেজেনটেটিভ বন্ধুদের দেওয়া কত স্যাম্পেল ওষুধই তো কত কত রোগীকে দিয়ে দিই। কিছু পাওয়ার আশায় তো দেওয়া নয়। তাই মনে রাখাও অসম্ভব।
এর পর কাঁসাইয়ের বুকে অনেক জল গড়িয়েছে। ওসমান চাচা নিয়ম করে প্রতিমাসে চেম্বারে ভিড় ঠেলে এসেছেন আমার কাছে তাঁর অধিকারের ইনহেলারটুকু সংগ্রহ করতে। রিপ্রেজেনটেটিভ বন্ধুদের কাছ থেকে আমিও ইনহেলার নিয়ে জমিয়ে রেখেছি চাচার কথা মাথায় রেখে। প্রেসক্রিপশনের কাগজটা হাতে নিয়ে ওসমান চাচার স্নেহের পরশটুকু আমার পারিশ্রমিক ছিলো।
এর পর স্নাতকোত্তর পাঠে কলকাতার পিজি হাসপাতালে এসেছি। সপ্তাহান্তে চেম্বারে বসে ওসমান চাচার জন্য ইনহেলার সংগ্রহ করেছি নিয়ম করে। চাচাও এসেছেন মাসে দুমাসে নিয়ম করেই।
স্নাতকোত্তর পাঠের সিলেবাসে ভারাক্রান্ত হয়ে ক্রমে সংকুচিত হয়েছে সাপ্তাহিক চেম্বারের সংখ্যা। বই আর রোগীর ভিড়ে সামাজিক পরিসরটুকু ছোটো হতে হতে একসময় একটা ছোট্ট রুমে সীমাবদ্ধ হয়েছে। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটেয়ে বই আর আঁকিবুকি কাটা ফ্লো-চার্ট। সামনে পরীক্ষা। এম.ডি. ফাইনাল। এক সমুদ্র সিলেবাস। তারই মাঝে খাবি খাচ্ছি আমি। যোগাযোগের মুঠোফোনটাও অবহেলায় পড়ে থাকে।
এমনই এক সন্ধ্যেয় চেম্বার থেকে আসা বারংবারের বাজতে থাকা কলটা রিসিভ করতেই চেম্বারের তাপসবাবু বললেন – একজন বৃদ্ধ এসেছেন। আপনাকে এখনই দেখাতে চায়।
আমি তো এখন কলকাতায়। চেম্বার থেকে একশো কিলোমিটার দূরে। কি করে দেখা সম্ভব? উনাকে অন্য কাউকে দেখিয়ে নিতে বলুন। নিদেনপক্ষে কাছেপিঠের হাসপাতালে দেখাতে বলুন।
কিন্তু উনি আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখাতে চান না। আমি বুঝিয়ে বলেছি। কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা।
আমার অপারগতার কথা দৃঢ় ভাবে আরও একবার ব্যক্ত করে ফোনটা নামিয়ে রেখে সিলেবাসে ডুবে গেলাম আমি।
এরপর পরীক্ষা পার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এলাম চেম্বারে। মাসখানেক পর জমে থাকা ইনহেলারে চোখ পড়তে তাপস বাবুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম – চাচা আসেনি?
অনেকদিন দেখিনি। কোনো খোঁজও পাইনি।
গতানুগতিকতার স্রোতে স্মৃতিপথ যখন ধুয়ে যায় তখন সেপথে কার ছাপ কত ঊজ্জ্বল, সে তুলনাও অতি অপ্রয়োজনীয়।
দিন চারেক আগে ওসমান চাচার সঙ্গে আসা সেই যুবকটির সাথে দেখা। কথায় কথায় ওসমান চাচার কথা জিজ্ঞেস করতেই অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ নামিয়ে বলল- গত মাসে আপনি ছিলেন না ডাক্তারবাবু। বৃষ্টি ভিজে সন্ধ্যেবেলায় আবার শ্বাসের টানটা উঠেছিলো চাচার। গাড়ি করে আপনার চেম্বারে এসে যখন শুনলাম আপনি নেই, চাচাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উনার সেই এক গোঁ। মরতে হলে আপনার কাছেই মরবে। হাসপাতালে কিছুতেই নিয়ে যেতে পারলাম না। সেই রাত আর সকালের আলো দেখেনি ডাক্তারবাবু। রাতেই সব শেষ।
কথাগুলো কানে ঢুকলো ঠিকই। কিন্তু সারা শরীর যেন অদ্ভুত আচ্ছন্নতায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো আমার। হাসপাতালে নিয়ে যেতে জোর করনি কেন? কেন আর কাউকে দেখিয়ে সে রাতেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? বুড়ো মানুষটার আবদারে কান না দিলেই তো জীবনটা বেঁচে যেত। অনেক প্রশ্ন এসেছে মনে। কিন্তু কোনোটাই আর করে ওঠার শক্তি সেদিন পাইনি। অপরিসীম এক আত্মশ্লাঘায় অবসন্ন শরীরের চোখের কোন কেটে শুধু দুটি জলের ফোঁটা নেমে এসেছিলো গাল বেয়ে। ক্ষমা কোরো চাচা।