প্রথমেই একটা কথা পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো, বাত বলতে এই লেখায় আমি অস্টিও আর্থ্রাইটিসের কথা বলতে চেয়েছি। সাধারণত যে রোগে বয়সের সাথে সাথে হাঁটু, কোমর, কাঁধ এবং শরীরের আরো অনেক গাটে ব্যথা আরম্ভ হয়। যেকোনো বাতের মধ্যে এই বাতের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশী।
যদিও বাংলায় বাত বলতে গাউট থেকে আরম্ভ করে রিউমাটয়েড, রিউম্যাটিক আর্থ্রাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থোপ্যাথি, স্পন্ডালাইটিস, রিয়াকটিভ আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি প্রায় সব রোগকেই বোঝায়। সেসব বিস্তারিত ভাবে অন্য কোনো লেখায় আলোচনা করা যাবে।
সারাজীবন বাতের ব্যাথায় ভোগেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমরা সকলেই প্রায় জানি যে এটা গাঁটের ক্ষয়জনিত রোগ। কিন্তু এই রোগের আরও অনেক বিষয় আছে যা আমরা জানি না, অথচ সুস্থ থাকার জন্য জানা খুবই প্রয়োজন।
বাত যদিও প্রকট হয় মধ্যবয়সে বা বৃদ্ধবয়সে গাঁটের ব্যাথার মাধ্যমে, এই রোগের উৎপত্তি হয় কিন্তু যৌবনে। ২৫-৩০ বয়স পর্যন্ত শরীর কোষ ও কলার বৃদ্ধি হয়। তারপর প্রাকৃতিক নিয়মেই শুরু হয় শরীরের ক্ষয়।যদিও প্রথম অনেক বছর আমরা তা বাইরে থেকে বুঝতে পারি না।
এই ক্ষয় শরীরের সকল অঙ্গে হলেও, গাঁটের ক্ষয়ের ফলে সৃষ্টি হয় বাত এবং বাতের ব্যাথা। ব্যাথা ছাড়াও বাতের ফলে গাঁট ফুলে যায়, গরম হয়ে যায় এবং শক্ত হয়ে যায়। হাঁটু বা কোমর ভাঁজ করতে সমস্যা হয়। হাত মুঠো করা যায় না। রোগীর দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
বাত শুধু যে হাঁটুতেই হয় তা নয়। নিতম্ব (hip joint), কোমর, ঘাড়, হাতের আঙ্গুল, বিশেষতঃ হাত ও পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের গোড়া এবং কখনও কাঁধের গাঁটও বাতে আক্রান্ত হতে পারে।
আমাদের গাঁটের ভিতর হাড়ের উপর থাকে নরম তরুণাস্থি-র প্রলেপ এবং জেলির মত এক ধরনের তরল পদার্থ। বাতে এই দুটো আবশ্যিক বস্তু প্রথমেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে গাঁটের স্বাভাবিক ভাঁজ ও সোজা হওয়ার ক্ষমতা ব্যহত হয়। তারপর শুরু হয় হাড়ের ক্ষয়। তখন স্বাভাবিক নিয়মেই শরীর চেষ্টা করে সেই ক্ষয় মেরামত করতে। সেই মেরামতের সময় গাঁটের ভিতরে এবং আশেপাশে হাড়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়। আশেপাশের কলা এবং তন্তু গুলো(tissue এবং ligament) ফুলে ওঠে। ব্যাথা এবং গরম ভাব শুরু হয়। গাঁট ভাঁজ হতে চায় না। মেঝেতে বসা, হাত মুঠো করা, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা বন্ধ হয়ে যায়।
যৌবনের শেষপর্ব থেকে শুরু হওয়া স্বাভাবিক ক্ষয় তো আছেই। বাতের আরও অন্যান্য কারণগুলো হল – বংশগত, বয়স, হাড়ের অস্বাভাবিক কম ঘনত্ব এবং হাড়ের চোট, বিশেষতঃ গাঁটের কাছাকাছি অঞ্চলে হাড় ভেঙ্গে যাওয়া প্রভৃতি। তাছাড়া এই রোগে মহিলারা বেশী আক্রান্ত হয় এবং শরীরের গাঁট ও হাড়ের উপর যৌবনে অত্যধিক চাপের ফলে এই রোগের বাড়াবাড়ি হয়।
মহিলাদের চল্লিশের পরে এবং পুরুষদের পয়তাল্লিশ বছর বয়েসের পরেই হতে হবে সাবধান। অত্যধিক কাজ করার পরে মাঝে মাঝে গাঁটে ব্যাথা এবং হঠাৎ হঠাৎ গাঁটের মধ্যে কটাস কটাস করে অস্বাভাবিক আওয়াজ করতে পারে। এগুলো হল প্রথম দিকের উপসর্গ।
শুরু থেকেই সতর্ক হন। মেঝেতে বসা এবং উবু হয়ে বসা বন্ধ করুন। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত ওঠানামা কমান। ডাক্তারের পরামর্শ নিন। রিউম্যাটয়েড বাত কিম্বা ইউরিক অ্যাসিড জনিত সমস্যা থাকলে তার জন্য অন্য চিকিৎসা আছে।সেই চিকিৎসা করান।
ফিজিওথেরাপিস্টের সাহায্য নিন। নির্দিষ্ট ভাবে শিখিয়ে দেওয়া ব্যায়াম করুন (হাঁটুর জন্য হাঁটুর ব্যায়াম, কোমরের জন্য কোমরের ব্যায়াম ইত্যাদি)। প্রানায়াম করে নখে-নখ ঘষে হাঁটুর বাত সারবে না- এটা বুঝতে হবে। ব্যায়ামে মাংসপেশির জোর বাড়ে। গাঁটের রক্তসঞ্চালন ব্যবস্থা ভাল হয়। তরুণাস্থি পুষ্টি পায়।হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়, ভঙ্গুরতা কমে। সুতরাং, প্রাথমিক অবস্থায় ব্যায়াম হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। বাতের রোগকে প্রথমদিকে অবহেলা করলে, অল্প অল্প ব্যথা এবং কট কট শব্দকে পাত্তা না দিলে, সে বৃদ্ধবয়সে মারাত্বক আকার ধারণ করতে পারে। তখন হাঁটু বেঁকে গিয়ে চলাফেরাই মুস্কিল হয়। আঙ্গুল বেঁকে গিয়ে হাতের কাজে বাধা সৃষ্টি করে। এমনকি, কোমর বা ঘাড়ের বাতের ফলে মেরুদণ্ডের হার বৃদ্ধি পেয়ে নার্ভের উপর চাপ দিয়ে প্রবল যন্ত্রণা, হাত–পা অবশ হয়ে যাওয়া এবং আংশিক পঙ্গুত্বও বিচিত্র নয়।
বাতের জটিলতায় প্রয়োজন হতে পারে শল্যচিকিৎসা। যেটা ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। সেটা মোটেই কাম্য নয়।
আজকাল সারা পৃথিবীতে বাত নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। আবিষ্কার হচ্ছে নানাধরনের ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা। বাতের চিকিৎসা শুরু করতে হবে রোগের শুরুতেই, প্রথম স্তরে। কেবলমাত্র তবেই হাঁটু বা অন্যান্য গাঁটকে তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। খাওয়ার ওষুধ, ইঞ্জেকশান, ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম সঠিক ভাবে প্রয়োগ করলে খুব ভাল ফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তার জন্য সঠিক সময়ে ডাক্তার-এর পরামর্শ নেওয়া দরকার। দেরী করলে চলবে না। এখন টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে হাঁটুর জেলি বা তরুণাস্থি তৈরি হচ্ছে এবং তা রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করছেন ডাক্তাররা। ব্যায়াম এবং ফিজিওথেরাপি-ও আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে অনেক সফল ভাবে করা যাচ্ছে। কিন্তু তার জন্য রোগীকে সচেতন হতে হবে। বুঝতে হবে যে আধুনিক চিকিৎসার ফলাফল খুবই ভাল হলেও তা ব্যয়বহুল।
রোগী সচেতন না হলে বা নিয়মিত চিকিৎসা না করালে গাঁটের অবস্থা খারাপ হয়। যন্ত্রণা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। গাঁট শক্ত হয়ে যায়। তখন আর ওষুধ পত্রে কাজ হয় না। এইসব ক্ষেত্রে শেষ রাস্তা হল শল্যচিকিৎসা।
শল্যচিকিৎসা দুই প্রকার। জয়েন্ট বা গাঁট-এর অবস্থা কিছুটা ভাল থাকলে osteotomy বা হাড় কেটে জয়েন্ট কে সোজা করে জুড়ে দেওয়া যায়।জয়েন্ট একেবারে খারাপ হয়ে গেলে স্বাভাবিক জয়েন্টকে কেটে বাদ দিয়ে কৃত্রিম জয়েন্ট প্রতিস্থাপন। এই চিকিৎসা এখন আমাদের দেশে এবং রাজ্যেও অত্যন্ত সফলভাবে হচ্ছে। তবে এটি খুব ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি।
সঠিক সময়ে সতর্ক হলে এবং নিয়মমত চললে এই ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা এড়ানো সম্ভব।
খুব দরকারি লেখা।
লেখাটি খুব দরকারী।কিন্তু হঠাত করে থেমে গেল।ফলে পুরো ছবি পেলাম না।