জ্বর নিয়ে ভাবতে বসলেই মনে হয়, জ্বরের সঙ্গে কোনটি মানাবে? জর্জরিত, নাকি জ্বর-জড়িত? দ্বিতীয়টি শিব্রাম লিখেছিলেন। আপাতত আমরা এই দুইয়ের মাঝে ত্রিশঙ্কু হয়ে আছি, জ্বর জড়িয়ে ধরুক বা না ধরুক, জর্জরিত তো বটি।
ডাক্তারি-বিদ্যায় অবশ্য জ্বর ব্যাপারটার কিছু ব্যাখ্যা রয়েছে। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস, সেখানে রয়েছে শরীরের তাপমাত্রার কেন্দ্রীয় সরকার। দেশের অর্থনীতির হাল-অনুসারে যেমন করে সুদ বাড়ে বা কমে, হাইপোথ্যালামাস-এও তেমনই। দরকার বুঝে তাপমাত্রার মাপকাঠি উঁচুতে তুলে দেয় – জ্বর। অর্থনীতির হাল ফেরানোর সুদের হেরফেরের যে দাওয়াই, তার ফল যেমন সবসময় কাজে আসে না, বিভিন্ন জীবাণুর মোকাবিলায় শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে ফেলাও তেমনই – সবক্ষেত্রে উপযোগী নয়, ক্ষেত্রবিশেষে বিপত্তিও ঘটায়। সে যা-ই হোক, আমাদের দেহে ওই ব্যবস্থাটিই বহাল।
তবে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ামাত্র সংক্রামক জীবাণু পটাপট মরে যায়, এমন তো নয়। তাপমাত্রা বাড়লে শ্বেত রক্তকণিকা বেশি বেশি করে তৈরি হয়, বেশি বেশি করে কাজে উদ্যোগী হয়, বেশি বেশি জৈব-রাসায়নিক উপাদান তৈরি হয় – সব মিলিয়ে জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াইটা আরও মজবুত হয়। আমাদের শরীর এসব অবশ্য একদিনে জানেনি। বিবর্তনের হিসেবনিকেশ মেনে এ আমাদের ধাপে ধাপে অর্জন। বিবর্তনের ধারা শিরোধার্য করে চিকিৎসার স্ট্র্যাটেজি সাজানো, যার বাজারচলতি নাম ডারউইনিয়ান মেডিসিন, সেই ভাবনায় জ্বর বাড়লে জ্বরের বড়ি খাওয়া অনুচিত। কেননা দেখা গেছে, অনেক জটিল সংক্রামক ব্যধির ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি জ্বর কমালে সংক্রমণ জটিল হয়ে দাঁড়ায়। আবার জ্বরের বাড়াবাড়ি হলেও তো কম সমস্যা নয়। কাজেই, কিছু লাভ কিছু ক্ষতি, জীবনের বাকি সব ক্ষেত্রের মতোই, ভারসাম্যের হিসেবনিকেশ এখানেও। অষ্টপ্রহর এই বাড়তি তাপমাত্রা বজায় রাখতে বাড়তি জ্বালানির জোগান – সবসময় ইগনিশন অন থাকা গাড়ির ইঞ্জিনের মতোই – কম ধকলের ব্যাপার নয়। অতএব ওই ভারসাম্যের হিসেব। বিশেষত, পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুসারে কোন দিকটিকে অগ্রাধিকার দেব, তারও হিসেব। অসুখটি জটিল, নাকি তার দাওয়াইয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – এ হিসেব ছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞান অচল।
তবে জ্বর কি একরকম? আমাদের সমাজজীবনে ইদানীং জ্বরের ছড়াছড়ি। বিশ্বকাপ আসতে না আসতেই খবরের কাগজের সুবাদে জানতে পাই, ফুটবলজ্বরে নাকি কাঁপছে এদেশ। অন্তত এ শহর তো বটেই। ভারসাম্য রেখে সেই তাৎক্ষণিক হুজুগে উন্মাদনার পরিবর্তে যদি পাড়ায় ফুটবল নিয়ে ন্যূনতম উৎসাহ মিলত বছরভর? বছরে দু-তিনবার ভ্রমণজ্বরের অনুষঙ্গ হিসেবে যদি মিলত প্রকৃতিপ্রেম নান্দনিক রুচির ন্যূনতম বোধ? আমোদগেঁড়ে সম্মিলিত মোচ্ছবের সঙ্গে যদি মিলত সামূহিক সহমর্মিতার অনুভূতি? নাহ্, ভারসাম্যের বোধ সম্ভবত অর্জিত শিক্ষা, আপনাআপনি সে বোধ মেলে না। অতএব, অতিমারী পরিস্থিতিতেও ভারসাম্য বজায় রাখার শিক্ষা রাতারাতি গজিয়ে উঠল না কেন, এ প্রশ্ন অবান্তর।
আসলে ভারসাম্য নিয়ে কথা বলতে গেলে অগ্রাধিকারের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনা, সকলের কাজের পরিসরটি চালু রাখা – নাকি অবাধ হুল্লোড়ের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া – শেষেরটিকে যদি বেশি জরুরি ভাবি, তাতে তো অনুচিত কিছু নেই। মানুষের রুচি বিভিন্ন হবে, এ তো প্রত্যাশিতই। তবে ওই দ্বিতীয়টিকে বেছে নিয়ে প্রথমটি কেন পাওয়া গেল না, সে নিয়ে হাহাকারটি বড্ডো দ্বিচারিতা বোধ হয়।
অথচ এই মোচ্ছবের মাসকয়েক আগেই ছিল এক আতঙ্কের সময়। তাকে কি আতঙ্ক-জ্বর আখ্যা দিয়েছিলেন কেউ? জানি না। দিলেও চোখে পড়েনি। তবে অক্সিজেনের জন্যে হাহাকার, সিলিন্ডার নিয়ে কালোবাজারি, হাসপাতালে শয্যাসঙ্কট – এই সব কিছু বিস্মৃত হয়ে এমন উৎকট উচ্ছ্বাসে মাততে পারা, সেও কিছু কম অর্জন নয়।
তারও আগে ছিল জনশূন্য পথ, নিস্তব্ধ রাত্তির, প্লাস্টিক ব্যাগে মুড়ে নিঃসঙ্গ শেষ যাত্রা। সংক্রামিত হওয়ার খবর দেওয়ার কিছু পরে মহাকাশচারী-সুলভ পোশাকে সজ্জিত কিছু মানুষ অসুস্থদের নিয়ে যেতেন কোনও হাসপাতালে – সেখানে অবস্থার অবনতি হলে আরেক হাসপাতালে – একান্ত নিকটজনেরাও সবসময় খবর পাননি, প্রিয় মানুষটি ঠিক কোথায়। অথবা, তাঁর শেষকৃত্য সমাধা হলো ঠিক কোনখানে। বা আদৌ হলো কি?
যাক সে কথা। সুখস্মৃতির মতোই, আতঙ্কের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকার মানে হয় না। তবে শিক্ষা হয়ত নেওয়া যায়। অন্তত নেওয়াই যেত। নাকি ওই আশ্চর্য জ্বরের স্মৃতি এই শিক্ষাই দিয়েছে, দুদিন বই তো নয়?
আধা লকডাউন। ট্রেনের সময় কমিয়ে আনা। ইশকুল কলেজ বন্ধ। একটা আস্ত প্রজন্ম স্কুলছুট হওয়ার মুখে। দিনের আয়ে যাঁদের হাঁড়ি চড়ে, তাঁদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছোঁয়া। ভুগে মরার আতঙ্ক নয়, না খেতে পাওয়ার আতঙ্ক। রাষ্ট্রকে সহমর্মিতাবোধহীন বলে গালি পাড়ার মুহূর্তে একটু প্রশ্ন করুন, আপনার মোচ্ছব-উল্লাসের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তো এই ছিল। তাহলে?
অবশ্য আজকের কথা নয়, ইতিহাস সাক্ষী, সংক্রামক জ্বরের মোকাবিলায় রাষ্ট্র যে সব কড়া পদক্ষেপ নেন, আমনাগরিক সর্বদাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যেসব ব্যবস্থাগুলো নিতে হয়, সেগুলো ঠিক সেই অর্থে “মানবিক” নয়।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। বিংশ শতকের প্রথম ভাগে, ইংলন্ডে ফিভার ভ্যান-এর প্রচলন ছিল। উনবিংশ শতকে, শিল্পবিপ্লবের পর, বিপুল সংখ্যায় মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজের সন্ধানে আসেন। বেশ কিছু এলাকায় শ্রমজীবি মানুষ গাদাগাদি করে থাকতে শুরু করেন। যেমন ধরুন, ম্যাঞ্চেস্টার অঞ্চলে। ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার কারণে সেখানে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ছোঁয়াচে জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটত। বিশেষত শিশুদের মধ্যে ডিপথেরিয়া আর স্কার্লেট ফিভার। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের তখন হামাগুড়ি দেওয়া চলছে – বিংশ শতকের শুরুর দিকে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হলেও সকলের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়ার মতো উৎপাদন হয়ে ওঠেনি। অতএব, ছোঁয়াচে জ্বরের চিকিৎসা বলতে রোগাক্রান্তকে বাকিদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং অপেক্ষা করা। অপেক্ষা, তাঁর শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কতদিনে নিজেনিজেই সংক্রামক জীবাণুর সঙ্গে লড়াইয়ে জিততে পারে। পারলে ভালো, না পারলে…
সংক্রামিত মানুষটিকে বাকিদের থেকে আলাদা করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে যে বাহন পাঠানো হত, তারই নাম – ফিভার ভ্যান। তবে শুধু নিয়ে যাওয়া তো নয়, তার সঙ্গে মিশে যেত অনেক আতঙ্কের অভিজ্ঞতা। বাড়ি থেকে প্রায় জোর করে নিয়ে যেতে হতো শিশুটিকে। জোর করে, কেননা অ্যান্টিবায়োটিক-পূর্ব সেই যুগে, বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও আশ্রয়ে স্রেফ পরিচর্যা ও অপেক্ষার মাধ্যমে নিম্নবিত্ত শিশুটির সেরে ওঠা বনাম মৃত্যু – সম্ভাবনা হিসেবে দুটি বেশ কাছাকাছি। কে-ই বা এমন অনিশ্চয়তার মুখে বাচ্চাকে ছাড়তে চায়!! পাশাপাশি, শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার সময়, বাড়ি থেকে শিশুটির ব্যবহৃত যাবতীয় সামগ্রী – তার পড়ার বই কিংবা তার খেলনা – সব পুড়িয়ে দেওয়া হতো, বাকিদের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমানোর আশায়। বাড়ির সামনে ফিভার ভ্যান থামার অভিঘাত সংক্রামক ব্যধির আতঙ্কের চাইতে বহুগুণ বেশি।
টলমলে পায়ে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথ চলার শুরু, শিল্পবিপ্লবের পরে আধুনিক পুঁজির যাত্রা, ঘিঞ্জি বস্তিতে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা নিম্নবিত্তের ঘরে নিয়ত ছোঁয়াচে জ্বরের প্রাদুর্ভাব – এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে রইল ফিভার ভ্যান ও এলাকার ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসকের হাতে তৈরি হওয়া সেই ভ্যান পাঠানোর ফরমান।
সংক্রমণ যাতে ছড়িয়ে না পড়তে পারে, যাতে বাকি শিশুরা সুস্থসবল বেঁচে থাকতে পারে – নাকি একসঙ্গে অনেকে মিলে অসুস্থ হয়ে শিল্পের উৎপাদনব্যবস্থাটি যাতে না বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে – রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ঠিক কী থাকে, এ সংশয় মেটার নয়। জনকল্যাণ, নাকি সেই মুখোশের আড়ালে থাকে সুবিধেভোগী শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার ভাবনা?
জ্বরো রোগীর সেই ভ্যান থেকে শতাধিক বর্ষকাল অতিক্রম করে ভুবনায়ন পরবর্তী এক উত্তরাধুনিক বিশ্বে এসে পড়লাম। সংশয়টি রয়েই গেল।
নাকি বদলেও গিয়েছে?
যে রঙের মুখোশই পরুন না কেন, এতদিনে আমরা বুঝে গিয়েছি, রাষ্ট্র ব্যাপারটা নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার কারণেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সে স্বার্থ গরিষ্ঠের। না, সংখ্যাগরিষ্ঠের নয় – অর্থনীতির গরিষ্ঠভাগ যে শ্রেণীর হাতে, তাঁদের স্বার্থ। এবং যেহেতু অর্থনীতির গরিষ্ঠভাগ কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে থাকে না, সেহেতু রাষ্ট্রের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষা বিশেষ হয়ে ওঠে না। নির্যাতিত-বঞ্চিতের স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের যে অবশ্যম্ভাবী ভূমিকা, যেকথা রুডলফ ভির্শ বারবার বলেছেন – রাষ্ট্রক্ষমতার প্রায়োগিক মুখের সঙ্গে চিকিৎসকের ফরমান ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনকল্যাণমুখী লক্ষ্যের থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে ধরা যেতে পারে ওই ফিভার ভ্যান।
তার থেকে একশ বছর পার হয়ে এসে এ এক জাদুবাস্তব বিশ্ব।
রাষ্ট্র জনগণের চাহিদা মেটাচ্ছেন। আমোদের চাহিদা, মোচ্ছবের চাহিদা, হুজুগের চাহিদা, নেশায় মাতাল হওয়ার চাহিদা।
সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থরক্ষার অছি হয়ে দাঁড়ানোর যে দায়িত্ব চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছিল, চিকিৎসকরা প্রাণপণে সেই দায় পালনের চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক চিকিৎসকদের কথায় ভরসা রাখছেন না। কাদম্বিনীর চাইতেও মর্মান্তিক দশা চিকিৎসকের। সহস্রাধিক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু এটুকু প্রমাণ করতে পারেনি, কোভিড সত্যিই প্রাণঘাতী এক জ্বরের নাম।
আর খেলা হবে নয়, রাষ্ট্র খেলাটা খেলছেন। কখনও সুতো ছাড়া চলছে, মোচ্ছবে আমজনতার রুজি জড়িয়ে এই অজুহাতে। কখনও সুতো টেনে নেওয়া হচ্ছে, আমজনতার জীবনরক্ষার যুক্তিতে। এই অনির্বচনীয় ইয়ো-ইয়ো লাট্টু খেলায় মোচ্ছব-জ্বরে আক্রান্ত সকলেই।
চন্দ্রবিন্দুর গানটা একটু বদলে বলা যায় –
ল্যাজ বেঁকিয়ে এগিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে
তবু গাধার বুদ্ধি দেখো, সে মোচ্ছব ভালোবাসে।
গাধাটাকে ঘাস দাও (ভেসে যাবে)
আরে, গাধাটাকে ঘাস দাও (ফেঁসে যাবে)
গাধাটাকে ঘাস দাও (ঠেসে খাবে)
সুস্থ হলে তবে তো দেশে যাবে!
জ্বরের কথা লিখতে বসেছিলাম। লেখার শেষ অবধি পৌঁছে উপলব্ধি, আমাদের কোভিড-আচরণ কোনও নিছক জ্বরজারি নয়, এ এক উত্তরাধুনিক বিকারগ্রস্ততা।