মস্তিষ্ক ছাড়া আর যে অঙ্গ মানুষকে জীবজগতের অন্য সদস্য, এমনকি বানর ও ‘এপ্’ দের থেকে আলাদা করেছে- তা হল হাত। বিবর্তনের ইতিহাসে মানুষ হাত দিয়ে পাথর ছুঁড়ে শিকার করেছে, হাত দিয়ে শিকারের চামড়া ছাড়িয়ে মাংস খেয়েছে, লাঙল ধরেছে, চাবুক চালিয়েছে। আবার হাত দিয়েই লেখালেখি করেছে। সেলাই করেছে। ছবি এঁকেছে। মানুষের হাত, বিশেষতঃ বুড়ো আঙুল অনেক লম্বা হওয়াতে এবং তাতে অসংখ্য স্নায়ু ও অনেক ছোট-বড় হাড়, মাংসপেশী, টেন্ডন থাকার ফলে মনে হয় যেন পঞ্চেন্দ্রিয়র পরে হাত হল আরেক ইন্দ্রিয়। হাত দিয়ে স্পর্শ, তাপপ্রভেদ, কোনো বস্তুর পৃষ্ঠতলের সামান্য প্রভেদ অনুভব করা যায়। সুতরাং মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র বা চোখের মত হাতও বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। আর কাঁধ থেকে কব্জি পর্যন্ত ঊর্ধাঙ্গের মূল ভুমিকা হল হাতকে তার কাজের উপযোগী স্থানে পৌঁছে দেওয়া।
সেই হাতে বা কব্জিতে যদি ব্যথা হয় তাহলে মানুষের খাওয়া, পোষাক পরা, শৌচকার্য ইত্যাদি দৈনন্দিন কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায় অথবা প্রচন্ড অসুবিধা হয়। অর্থ্যাৎ, সূক্ষ্ম সৃজনশীল কাজকর্ম দূরে থাক-সাধারণ জীবনধারন অসহ্য হয়ে ওঠে। অথচ অনেকেই হাতের ব্যথাকে প্রথমদিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না।
কব্জিতে বা হাতে ব্যথা কেন হয়?
চোট লেগে:
পড়ে গিয়ে, খেলতে গিয়ে, মারামারির ফলে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে বা দুর্ঘটনা ঘটে কব্জির লিগামেন্ট, টেন্ডন বা মাংসপেশীতে টান পড়ে বা ছিঁড়ে গিয়ে কব্জিতে ব্যথা হতে পারে। এছাড়া চোট লেগে কব্জির হাড়, হাতের বা আঙুলের হাড় ভেঙে যেতে পারে। জয়েন্ট সরে যেতে পারে। চিকিৎসা হল- প্রথমে বরফ লাগানো, হাতের বিশ্রাম দেওয়া, ক্রেপ ব্যান্ডেজ বা স্প্লিন্ট লাগানো, ব্যথার ওষুধ খাওয়া। তারপর চিকিৎসকের পরামর্শ মত এক্সরে বা এম আর আই করে সঠিক রোগ নির্ণয় করে তার চিকিৎসা।
কারপাল টানেল সিন্ড্রোম:
হাতের তালুর দিকে একটা নার্ভ কব্জিতে একটা সরু জায়গায় চাপে পড়ে যায়। ফলতঃ হাতের তালু এবং কয়েকটা আঙুলে ব্যথা, ঝিনঝিন ভাব, অবশ ভাব হয়। রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পরে উপসর্গ বেশী হয়। যাঁরা কম্পিউটারে বেশী কাজ করেন, ড্রিল নিয়ে কাজ করেন, প্রচুর সেলাই করেন, ছবি আঁকেন- তাঁদের বেশী হয়। তাছাড়া, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগীদের এবং গর্ভাবস্থায় এই রোগ হতে পারে।
এক্ষেত্রে হাতের বিশেষ ধরনের কিছু ব্যয়াম করতে হয়, ঘুমোনোর সময় হাতে স্প্লিন্ট লাগিয়ে ঘুমোতে হয়। তাতেও কাজ না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি নার্ভের পরীক্ষা করে প্রয়োজন হলে অপারেশন করতে বলতে পারেন।
আর্থ্রাইটিস:
হাতের বিভিন্ন ধরনের আর্থ্রাইটিসে হাতে এবং কব্জিতে ব্যথা হয়। যেমন, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস, ইনফেকটিভ (সংক্রমন জনিত) আর্থ্রাইটিস, গাউট (ইউরিক অ্যাসিড বেশী হয়ে) প্রভৃতি।
অষ্টিও আর্থ্রাইটিস বয়সজনিত রোগ। মধ্যবয়সে শুরু হয়। সাধারণতঃ, বুড়ো আঙুলের গোড়ার জয়েন্ট বা অন্যান্য আঙুলের নখের কাছের জয়েন্ট আক্রান্ত হয়। আঙুলের গাঁট ফুলে যায়, ব্যথা হয় এবং আঙুল শক্ত হয়ে যায়। চিকিৎসা মূলতঃ হাতের বিশ্রাম, ব্যথার ওষুধ, ব্যতের ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, ব্যয়াম, স্প্লিন্ট।
রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সাধারণতঃ দুটো হাতই আক্রান্ত হয়। এটি জিন সম্পর্কিত রোগ। তাই পুরোপুরি সারানো যায় না। এই রোগ যৌবনে বা মধ্যবয়সে শুরু হতে পারে। মহিলাদের বেশী হয়। সকালের দিকে ব্যথা বেশী হয়। হাত মুঠো করতে অসুবিধা হয়। বিশ্রামে থাকলে ব্যথা বেড়ে যায়। কাজের মধ্যে থাকলে ব্যথা কমে। চিকিৎসা শুরু করতে দেরী হলে হাতের আঙুল, কব্জি খুব বেঁকে যেতে পারে। ব্যথা, ফোলা এবং বেঁকে যাওয়ার কারণে হাত অকেজো যেতে পারে। তাই দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। রক্ত পরীক্ষা, এক্সরে ইত্যাদির মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ওষুধ ওষুধ শুরু করতে হবে। এইসব ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ওষুধ বহুদিন, এমনকি সারাজীবন খেতে হতে পারে। এছাড়া প্রয়োজন মত ব্যথার ওষুধ, বরফ লাগানো, স্প্লিন্ট, ব্যয়াম, ফিজিওথেরাপি করতে হয়।
গাউটে হাতের বা কব্জির জয়েন্ট কম আক্রান্ত হয়। তবে হলে তখন জয়েন্ট হঠাৎ লাল হয়ে, ফুলে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথা হয়। জয়েন্টের উপরটা গরম হয়ে যেতে পারে। রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে গিয়ে এই রোগ হয়। বেশীরভাগ কারন বংশগত। কিছু বিশেষ খাদ্যের সাথেও সম্পর্ক আছে। চিকিৎসা হল হাতের বিশ্রাম, বরফ লাগানো, চিকিৎসকের পরামর্শ মত ব্যথার ওষুধ এবং ইউরিক অ্যাসিডের ওষুধ খাওয়া।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস সোরিয়াসিস নামক এক চর্মরোগের সাথে সম্পর্কিত। চিকিৎসা অনেকটাই রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মত।
ইনফেকটিভ (সংক্রমণ জনিত) আর্থ্রাইটিসে জয়েন্টের মধ্যে সংক্রমন হয়ে পুঁজ হয়। হঠাৎ হাতে বা আঙুলের জয়েন্টে মারাত্মক ব্যথা, ফোলা হয়। জয়েন্টের উপরের চামড়া লাল হয়ে, গরম হয়ে যায়। জ্বর আসতে পারে। সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
এছাড়াও গ্যাংলিয়ন, ডি-কুয়েরভ্যান ডিজিজ, ডুপুইট্রেন কন্ট্র্যাকচার, কিয়েনবক ডিজিজ, ট্রিগার ফিঙ্গার- ইত্যাদি রোগে হাতে, আঙুলে বা কব্জিতে ব্যথা হতে পারে।