“Then they answered all the people, His blood be on us and on our children”. এই মারাত্মক শব্দসমষ্টি বিশেষত শেষ তিনটি শব্দ প্রায় দেড় হাজার বছরের বেশি সময় ধরে তাড়া করেছিল ইহুদী সম্প্রদায়কে গোটা ইউরোপ জুড়ে। ইহুদী পুরোহিত ও জনগণের দাবিতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে রোমান গভর্নর পন্টিয়াস পিলেট অনিচ্ছাসহকারে প্রাণদণ্ডের আদেশ দিতে গিয়ে নিজের হাত ধুয়ে বললেন ” I am innocent of this man’s blood, see to it yourself “. সমবেত জনতা এর দায়ভাগ তুলে নিল শুধু নিজেদের উপর নয় তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মদের উপরেও…..
এই জায়গাটা খুব সন্দেহজনক, মানুষ নিজের উপর পাপের দায়ভাগ তুলে নিলেও কখনও কি সন্তান সন্ততিদেরও তার অংশীদার করবে?? কিন্তু এই তথাকথিত শব্দসমষ্টিকে হাতিয়ার করে বারে বারে ইহুদীদের উপর নেমে এসেছে চরম নির্যাতন, লাগাতর ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘evil force’ বা প্রত্যেকটি বিপর্যয় বা মরকের জন্য দায়ী হিসাবে। হলোকাস্টের অনেক আগে প্লেগের মহামারীর সময় ইউরোপে পুড়িয়ে মারা হয় ইহুদীদের জীবন্ত অবস্থায় কারণ এই ‘black death’ নাকি তাদের দ্বারাই আনীত। অবশ্য পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে খ্রীষ্টীয় ইউরোপের উৎসাহ ও ঐতিহ্য শুধুমাত্র ইহুদীতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি।
মধ্যযুগের বিভিন্ন সময়ে ইংল্যাণ্ড, স্পেন, পর্তুগাল দেশত্যাগ করতে বাধ্য করে সমস্ত ইহুদীদের….. তীব্র ইহুদিবিদ্বেষকে মূলধন করে নাৎসীরা ক্ষমতায় আসার পরে ধাপে ধাপে ‘ইহুদীমুক্ত’ (judenrein)করে দেশকে, নিহত হয় দেড় লক্ষের বেশি জার্মান ইহুদী আর বাকিরা বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে। Holocaust (burnt offering)এ বলি হয় ইউরোপের সমগ্ৰ ইহুদীদের দুই তৃতীয়াংশ প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ, যাদের মূল অংশ হলো পূর্ব ইউরোপ বিশেষতঃ পোলান্ডের। পৃথিবীজুড়ে ইতিহাসে বারে বারে গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে নিষ্ঠুরতম শাসকদের সৌজন্যে। কিন্তু সমস্ত নজিরকে ম্লান করে ‘হলোকাস্ট’ এর বিভীষিকাময় অধ্যায়।
প্রশ্নটা ঠিক এখানেই, যে সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠি যুগ যুগ ধরে বিতাড়িত, নিপীড়িত, উৎপীড়িত ..তারাই কী করে ভিন্নতর পরিস্থিতিতে হয়ে উঠতে পারে চরম উৎপীড়ক, দেশছাড়া করতে পারে এমন এক গোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষকে যারা আবার কোনও দিনই কোনও ভাবেই যুক্ত ছিল না প্রথমোক্তদের প্রতি যুগ যুগ ধরে ঘটে যাওয়া অন্যায় অবিচার ও নির্যাতনের অনন্ত উপাখ্যানের সঙ্গে !!! নাকি, এটাই ইতিহাসের প্রহসন যে ক্ষমতার আস্বাদে একদা উৎপীড়িতের অনায়াসেই উত্তরণ ঘটতে পারে উৎপীড়কের ভূমিকায় ; নিপীড়িত হয়ে উঠতে পারে চরম নিপীড়ক। তাও কাদের প্রতি না যাদের সঙ্গে আগে কখনও কোনও বৈরিতাই ছিল না। সম্ভবতঃ তাদের দোষ একটাই ছিল তারা দুর্বলতর, rather softer target..। ইহুদি রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভাবের অল্প পরেই ১৯৫৩ সালে ইস্রায়েল জার্মানীর সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসে যে ইহুদীদের সম্পত্তিহানির কারণে পরবর্তী ১৪ বছরে জার্মানীকে দিতে হবে তিন বিলিয়ন মার্ক( সেই সময়ের নিরিখে যা ছিল ১৭৪ মিলিয়ন ডলার)।তার পরেও বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণে অর্থ আসে সব মিলিয়ে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৮০ বিলিয়ন ইউরোর বেশি, সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ, holocaust survivorদের পেনসন, কোভিড সহায়তা ইত্যাদিতে। এখানেই অবাক লাগে ইস্রায়েল এ যাবৎ তাদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত বিতাড়িত আরব জনগণের সম্পত্তিহানির জন্য ঠিক কত অর্থ ব্যয় করেছে বা আদৌ করেছে কিনা। বরং আরবদের ফেলে যাওয়া ঘরবাড়িজমি সমস্ত বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হয়েছে, যাতে করে ফিরে আসা সম্পূর্ণ রূপে রুদ্ধ হয়।
ইস্রায়েল science and technology তে অসাধারণ উন্নতি করলেও সামাজিক দিক যথেষ্ট রক্ষণশীল ও পশ্চাদপদ। এখানে বিবাহ সম্পূর্ণ ভাবে ধর্মীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং ইহুদী ও অইহুদী বিবাহ নিষিদ্ধ। রাব্বি বা ধর্মীয় পুরোহিতই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন পাত্র ও পাত্রী উভয়েই ইহুদী কিনা। এতদিন মৌখিক পরীক্ষাতেই কাজ চলছিল। কিন্তু, ইদানীং কালে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন বা বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্ম প্রাধান্য লাভ করায় অনেক রাব্বি mitochondrial DNA ( যা নাকি মায়ের দিক থেকে ancestor খুঁজে বার করতে সক্ষম) পরীক্ষা করাতে উপদেশ বা অনুরোধ করছেন। হ্যাঁ, এখনও আদেশনামা বার হয়নি, শুধু মাত্র উপদেশ। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে আসা দশ লক্ষের বেশি মানুষেরা। এমনিতেই তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের প্রমাণপত্র প্রায় কিছুই নেই।এরপরে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তো……
ভাগ্যের পরিহাস হলো,এক সময়ে সদাসন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে হতো ইহুদী পরিচয় গোপনে ; আর এখন সন্ত্রস্ত থাকতে হয় ইহুদী পরিচয় প্রমাণে!! ইহুদীদের জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা ও একই সঙ্গে জাতিগত বিশুদ্ধতা বা racial purity প্রমাণে রাব্বিদের এই অত্যধিক উৎসাহ জানিনা অন্যত্র কতটা প্রভাব ফেলবে!!! তবে, ইস্রায়েলে ধর্মীয় নেতৃত্ব ও অতি দক্ষিণপন্থীদের ক্রমবর্ধমান সংযোগ ও প্রভাব বিস্তার প্যালেস্তাইন সমস্যাকে যে আরও অনেক বেশি বিপজ্জনক ও সঙ্কটাপন্ন করে তুলছে সে সম্পর্কে কোনও রকম সন্দেহ নেই। বিভিন্ন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের পারস্পরিক সহাবস্থানই এখন যেন গভীর প্রশ্নের সম্মুখীন!!
আইরিশ উদ্যোগপতি প্যাডি কসগ্রেভ আয়োজিত ‘ওয়েব সামিট’, লিসবন বয়কট করছে গুগল, মেটা ইত্যাদি কারণ প্যাডি ট্যুইট করেছে,”War crimes are war crimes even when committed by allies, and should be called out for what they are.” কিন্তু ভুলটা কোথায়?? ৭ই অক্টোবর হামাসের অভিযানে সাধারণ মানুষের মৃত্যু অন্যায় হলে গাজায় নব্বই হাজারের বেশি বাড়ি ধ্বংস, প্রায় দশ লক্ষ মানুষকে কয়েকদিনের মধ্যে গৃহছাড়া করা এবং পরিশেষে আল আহলি হাসপাতালকে বোমায় গুঁড়িয়ে দেওয়াকে কোন বিশেষণে অভিহিত করা যাবে ইস্রায়েলের পাশে থাকার অঙ্গীকারাবদ্ধ রাষ্ট্রপ্রধানরা কি দয়া করে জানাবেন?? খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায় দ্বারা পরিচালিত হাসপাতালে রোগী ছাড়াও বহু সাধারণ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন অন্তত: এটা আক্রমণের পরিধির বাইরে থাকবে!! এর পরেও ইস্রায়েলকে আশ্বস্ত করা হয়েছে আরও মারণাস্ত্র (lethal weapon)সরবরাহের, আর সঙ্গে অবশ্য গাজার মানুষের জন্য কয়েক ট্রাক মানবিক সাহায্যের আশ্বাস!!! তবে আশার কথা, মার্কিন মুলুকে ডেমোক্রাটদের একটা বড় অংশ যুদ্ধে নিরুৎসাহী, আর রিপাবলিকানরা তো দেশের বাইরে ভালো মন্দ সব বিষয়েই অর্থ ব্যয়ে অনাগ্রহী। ইস্রায়েলেও যে সকলে নেতানইয়াহু র সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন তা নয়। একটা ভালো অংশের মানুষ মনে করে নেতানইয়াহু নিজের স্বার্থে ও ফাতহা বা প্যালেস্তাইন অথোরিটিকে দুর্বল করার জন্য বিভিন্নভাবে মদত দিয়ে ‘হামাস’ এর উত্থান ঘটিয়েছেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট তো মনে করেন, ইচ্ছে করেই ‘হামাস’ কে তোলা হয়েছে যাতে কোনও negotiation এ যেতে না হয়। ওলমার্টের পরিষ্কার কথা,”This is not a competition of who kills more. We are not interested in killing civilians.”
কিন্তু কি করা যাবে পৃথিবীতে লাগাতর যুদ্ধ না চালালে তো অনেকেরই প্রভূত ক্ষতি!! ইস্রায়েলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও মদতদাতার কল্যাণে মধ্য প্রাচ্যে ইরাক, আফগানিস্তান,লিবিয়া, সিরিয়া প্রমুখ একের পর এক দেশ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে, পরবর্তী লক্ষ্য কি গাজা,ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক না পূর্ব জেরুজালেম???
আর শুধু এলাকা তো নয়, তার সঙ্গে ধ্বংস হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের আশা আকাঙ্খা জীবন জীবিকা…..। গাজায় নিহতদের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ হলো নারী ও শিশু। নিহত শিশুদের সংখ্যাই এর মধ্যে হাজার ছাড়িয়েছে………
দু হাজার বছর আগে রোমান গভর্নর নিজের হাত থেকে ‘নিরপরাধ রক্ত’ ধুয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু বর্তমান ‘রোমান’ অধিপতিদের পক্ষে সেটা বোধহয় একেবারেই অসম্ভব……………..