গৌরচন্দ্রিকাঃ
শিশিরদাকে খুব মিস করেছি এবার ট্রেকে গিয়ে। শিশিরদা আমাদের পঁয়ষট্টি বছরের তরতাজা যুবক। ট্রেকে অদম্য উৎসাহ। পারিবারিক কারণে যেতে পারেনি। নানা কারণে এ ট্রেক নিয়ে লিখব না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু শিশিরদা ফোন করে বলল যেতে পারেনি অন্তত লেখা পড়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবে। তাই ঠিক ‘তাঁর’ মতো না হলেও এ লেখা শিশিরদার অনুপ্রেণয়ায়!
2019 সালে পিন্ডারি ট্রেকে গেছিলাম। সেই মাইটি মাইককতোলির কোলে জয়কুন গ্রামে রহস্যময় চাঁদনি রাতে চন্দ্রাহত হওয়া , ভোরবেলা প্রথম সূর্যের আলোয় সোনার মুকুট পরা মাইকতোলির আর এক রূপ দেখা। পথে ঝর্ণা, ফুল পাখির রোম্যান্টিকতা। ধসে যাওয়া রাস্তা নিজের বুক ধড়পড়ানি শুনতে শুনতে পার হবার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। অবশেষে গভীরখাদের পাশ দিয়ে আলপথ ধরে পিন্ডারি জিরো পয়েন্টে পৌঁছানর অ্যাডভেঞ্চার। মনে যে উচ্ছ্বাস হয়েছিল তার কোনো তুলনা হয়না। মনে হয়েছিল জিরোতে হিরো হলাম। এবারো পঞ্চচুল্লি ‘জিরো’ পয়েন্টে পৌছেছিলাম। তাই এ লেখার নাম রাখলাম ‘আবার জিরোতে হিরো’।
পঞ্চচুল্লিতে পাঁচমিশালিরাঃ
পঞ্চচুল্লি যাওয়ার পাঁয়তারাটা শুরু হয় সেই 2019 সালে। মাঝে কোভিড দুটি বছর কেড়ে নেওয়ায় মনে হয় যেন প্রাগৈতিহাসিক কালে আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম। যাইহোক অনেক টালবাহানা করে অবশেষে এই 2022 এর 22 শে মে শুভযাত্রা করতে পারলাম। ফেরা ছিল 29 শে মে।
আমাদের দলটা এবার বড় অদ্ভুত। এবার রেগুলার ট্রেকবন্ধুদের দল নয়। আমরা তিনবন্ধু। আর আমাদের স্ত্রীরা। এক বন্ধুর মেয়ে আর তার বন্ধু। আর আমার স্ত্রীর বন্ধু। মোট নজন। আসলে দু বছর কোথাও না বেরতে পেরে আমাদের বৌ এরা জোর করে দলে ঢুকে পড়েছে। আর আমরাও আরো দু বছর বুড়িয়েছি। যাইহোক এই ‘চায়নাগেট’ সিনেমার মত নড়বড়ে দল নিয়েই আমরা ডাকু জাগিরা মানে পঞ্চচুল্লি ধরতে বেরিয়ে পড়লাম।
কতগুলো শুকনো তথ্য দিয়ে দিই। অকাল তখত ট্রেনে কলকাতা স্টেশান থেকে বেরিলিতে নামতে হয়। সেখান থেকে ধরচুলা হয়ে দুগতু যেতে হয়। প্রায় 450 কিমি রাস্তা। তাই মাঝে দুদিন স্টপ করলে ভালো হয়। পিথোরাগড় এক রাত। আর তারপর নাগলিং একরাত। নাগলিং থেকে দুগতু 10 কিলোমিটার। তাই এখানে গিয়ে ট্রেক শুরু করা যায় একই দিনে।
দুগতু থেকে বেসক্যাম্পঃ
দুগতু একটা সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। আর নদী পেরিয়ে আর একটু উঁচুতে ধান্তু গ্রাম। এই দুগতু থেকেই ট্রেক শুরু।
রাস্তার প্রথম 700 -750 মিটার খালি চড়াই। যা হয়, ঠান্ডার জন্য অনেকগুলো চাপিয়েছিলাম গায়ে। হাঁটতে হাঁটতে গরম লাগতে একটা একটা করে খুলতে খুলতে উঠছি।
এরপরের রাস্তাটা দারুন। শান্ত নিরিবিলি পাইন বনের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। এবং রাস্তাটা খুব ধীরে ধীরে উঠেছে। তাই কষ্ট হয়না। পাখির মিষ্টি ডাক। রঙ বেরঙের প্রজাপতি। আর জংগলের নিজস্ব আওয়াজ ছিল আমাদের সঙ্গী। যেহেতু আমাদের হাঁটার গতি এক একজনের এক এক রকম। নজনের দলটা তিন চারটে দলে ভাগ হয়ে গেল। রাস্তায় দেখলাম 300 -400 মিটার দূরত্বে পরিবেশ বান্ধব ডাস্টবিন রাখা। যার জন্যে রাস্তার ওপর চকোলেটের বা ফ্রুট জুসের প্লাস্টিক খুব কম।
হিমালয়ে হাঁটার কিছু নিজস্ব অনুভূতি আছে। সব থেকে বেশী যেটা মনে হয় এই বিশালত্বের কাছে নিজেকে একটা তুচ্ছ মানুষ। এর নীরবতা সরবতা। নীল আকাশ হঠাৎ ছেয়ে আসা বাদুলে মেঘ। কখনো ভাবগম্ভীর কখনো অস্থিরমতি। সব মিলে যেন বলে এখানে হিমালয়ই চালক। আমরা যেন তার নিয়মেই চলি।
রাস্তাটা খুব কম। মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার। তারপর আমরা চলে এলাম পঞ্চচুল্লি বেস ক্যাম্প। এখানে ইগলু হাট আছে কে এম ভি এনের। এখানেই আজ রাতটা থেকে পরের দিন জিরো পয়েন্ট যাওয়া।
ইগলু হাটগুলো এমনিতে বেশ সুন্দর। সাদা সাদা ইগলু প্যাটার্নের ঘর। চার পাঁচটা বেড ভালোভাবেই ঢুকে যায়। কিন্তু মেন্টেনেন্স ভালো নয়। ছাদের ফুটো ঢাকতে নীল রঙের বিশদৃশ প্লাস্টিক দিয়ে ছাদগুলো ঢাকা। আমরা আসপাশ হেঁটে খাওয়া দাওয়া করে আড্ডা মেরে কাটিয়ে দিলাম।
জিরো পয়েন্টঃ
বেস ক্যাম্প থেকে জিরো পয়েন্টের রাস্তাটা আর তিন চার কিলোমিটার। আমরা ব্রেকফাস্ট করে নজনের দল বেরিয়ে পড়লাম।
মিথ হচ্ছে পান্ডবরা মহাপ্রস্থানের পথে যাবার আগে শেষবারের মত দ্রৌপদী পাঁচ স্বামীকে পাঁচটি চুল্লিতে রান্না করে খাইয়েছিল। সেই চুল্লিই এখন পাঁচ শৃংগ। পান্ডবদের মহাপ্রস্থানের পথে যেমন এক একজন করে পড়ে যাচ্ছিল। এখানেও তাই হলো। তবে পড়ে যাচ্ছিল না। সরে পড়ছিল।
প্রথমে একটুখানি নামতে হয়। তারপর রোডোডেনড্রনের বন। মূলত গোলাপি রঙের ফুল দেখেছি, কিছু সাদা। তবে একটু দেরিতে আসায় শুকিয়ে যাওয়া ফুলই বেশী। এরপরেই বিদায় নিল আমার বৌ। ক্যাম্পে চলে গেল।
এই রাস্তাটা অসাধারণ। প্রতি বাঁকে বাঁকে রূপ পরিবর্তন। কিছুটা গিয়েই প্রথম স্নো ব্রিজ পেলাম। বাঁদিকের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসেছে জমে যাওয়া বরফ। আমাদের রাস্তার ওপর দিয়েই ডানদিকে নেমে গেছে। নীচে দিয়ে আছে জলের প্রবাহ। এর ওপর দিয়েই আমাদের যেতে হবে। সাবধানে। পিছলে না পড়ি। এটা পেরিয়ে বিদায় নিল আর এক বন্ধুর বৌ মেয়ে ও তার বন্ধু। রাস্তায় পড়ল মন মুগ্ধ করা এক তৃণভূমি। ছোট ছোট লাল ফুলের নকশা কাটা সেই সবুজ গালিচায়।
ইতিমধ্যে আমরা পেরচ্ছি আরো স্নোব্রিজ। এবারেরটা বেশ বড়। সেটা পেরিয়ে আবার একটা উঁচুনীচু মাঠ। এখানে বসে গেলে আরো দুজন। আমাদের আর এক বন্ধুর বৌ এবং আমার বৌএর বন্ধু।
এ লেখা পড়ে যারা ভাবছেন ট্রেকটা খুব কঠীন। তা নয়। আবার খুব সহজও নয়। যারা সরে পড়ছে বলছি তারা কখনো ট্রেক করেনি। উপযুক্ত জুতো না থাকা বা আরো শারীরিক সমস্যা থাকা স্বত্ত্বেও প্রায় চোদ্দ হাজার ফিট উচ্চতায় এতদূর ট্রেক করা পঞ্চাশোর্ধ বয়সে, সেটাও কম কৃতিত্বের নয়।
মহা প্রস্থানের পথ থেকে সরে পড়ার জন্যে থাকলাম আমরা তিন বন্ধু এবং আমাদের গাইড একটা কম বয়সী ছেলে। নাম তার নকুল। তবে ছেলেটি চতুর্থ পান্ডব হতে চায় না। হতে চায় ডাক্তার!
এই রাস্তা অদ্ভুত সুন্দর। গ্লেসিয়ার থেকে বেরিয়ে এসেছে ছোটছোট জলধারা। তাই দিয়ে তৈরি হয়েছে উঁচুনীচু মাঠের উপর জলরঙের আঁকি বুকি। একটু দূরেই হাতছানি দিচ্ছে বরফ ঢাকা রাস্তা।
পা রাখলাম সাদা বরফ ঢাকা পথে। দুপাশের পাহাড়ে গাছ খুব কম কিন্তু কিছু গুল্ম আর তৃণ মিলে নানা রঙ। কখনো হালকা মেঘ আসছে আকাশে। আলো ছায়ার খেলায় মোহময় হয়ে উঠছে পাহাড়গুলো। আর সামনে অমোঘ ডাক দিয়ে চলেছে পাঁচটি তুষার শুভ্র অতিকায় শৃংগ। একটা জিনিস বলতে পারি হিমালয়ে আর কোন ট্রেক নেই যেখানে এত কম হেঁটে গ্লেসিয়ারের উপর দিয়ে কোনো পিকের এত কাছে চলে যাওয়া যায়।
রাস্তাটা পুরোটাই উঁচু নীচু। তবে ক্রমশ উঠতে হবে। একটা বরফ ঢাল পেরিয়ে পরের ঢেউএর উঁচুতে ওঠা, যেটা আগের ঢেউএর থেকে ওপরে। এভাবেই এগিয়ে চলা।
একটা পয়েন্টে গিয়ে খুবই কাছে লাগছে পাহাড়্গুলোকে। খুব অ্যাভেলাঞ্জ হয় শৃংগগুলোতে। ভয়ংগকর আওয়াজ হচ্ছে। ভালো করে চোখ দিলে দেখা যায় বরফ গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাওয়ার দৃশ্য।
নকুল বকবক করতে করতে যাচ্ছিল। ওর দাদুর বাবা তিব্বত থেকে এসেছিল।এবং এই ধর্মা ভ্যালির অধিকাংশের পূর্বসূরিরাই তিব্বতের। তাই একই সংগে ওরা হিন্দু এবং বৌদ্ধ।
আমরা এক জায়গায় দাঁড়াতে নকুল বলল আরো কিছুটা যাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ লোক এই পর্যন্তই আসে। ওদিকে আমাদের দুজন ফেরার রাস্তায় অপেক্ষা করছে। এদিকে বেলা বেড়ে গেছে। আবহাওয়া খারাপ হতে পারে। তাই ফিরতে হবে।
মনের সুখে ক্যামেরা, মোবাইলে ছবি তুললাম। ভিডিও করলাম। আর অধিকাংশ ছবি তুলে রাখলাম মন ক্যামেরাতে। বিদায় পঞ্চচুল্লি।