ভোরবেলা স্কুটির ঘটঘট আওয়াজে চমকে উঠলাম। যদ্দূর দেখা যায় জল থৈ থৈ। আমার সিঁড়ির প্রথমধাপ জলে ডুবে। আর এক ধাপ জল উঠলেই একতলা জলমগ্ন। জলঢোঁড়া সাপ মহানন্দে ঘোরাফেরা করছে চাতালে।
-“দিদি, ঠিক আছ তুমি?”
-“মণি ! কীভাবে এলে ?”
-“আর বোলো না। ঘরে জল ঢুকেছে। খাটের উপর বাসনকোসন , আলমারি সব তুলেছি।”
-“তোমার বাচ্চা ?”
-“ক্লাবে দিয়ে এলাম। ক্লাবঘর উঁচু।ওখানে খিচুড়ি পাবে দুবেলা।”
মণির চোখে উৎকন্ঠা।
দোতলা থেকেই চেঁচিয়ে বললাম, “আজ ঘর ঝাড়পোঁছার দরকার নেই। কিছু লাগবে তোমার? ওষুধ টষুধ?”
-“হাজার টাকা ধার দেবে দিদি ?”
জলঢোঁড়া সাপটা মণির স্কুটির আওয়াজে পালাল।
-“তেল ভরব স্কুটিতে।”
মণিকে কখনও এতো উদভ্রান্ত দেখিনি।
-“বুড়ো বাপ মা মরে যাবে গো দিদি। ঝড়ে ঘর ভেসে গেছে। ভাইবউটা পোয়াতি।”
-“সে কী ! তুমিই তো বললে ভাই তোমার সব জমিজমা কেড়ে নিয়েছে। তোমার টাকায় কেনা। ফের ধার দেবে?”
-“যাব।” মণির গলার সুরে জেদ। ফের চমকে উঠলাম।
-“যাবে ? তুমি কি পাগল মণি? বুক সমান জল বসিরহাটে। ট্রেন চলছে না। লকডাউনে কোনও গাড়িঘোড়া নেই।”
-“ভ্যান ট্যান লাগবে না। স্কুটি নিয়েই যাব।”
বিদ্যুতবিহীন কাল রাত থেকে এমনিই দরদর করে ঘামছি। মনির উত্তর পেয়ে কালঘাম ছুটে গেল।
-“তোমার মাথাটা গেছে। ডুবে মরবে।”
-“এখনও ঠিক আছে দিদি। টাকাটা দিলে ভাল হয়। তোমার জন্য নিচের কল থেকে দু ‘বালতি জল তুলে দিই?”
এই নাছোড়বান্দা স্বভাবের জন্যই মণিকে আমার ভাল লাগে। যখন স্কুটি কিনেছিল ব্যাঙ্ক থেকে ধারদেনা করে, গ্যারান্টার হয়েছিলাম।
-“কী হবে মণি ? তুমি লোন শোধ করতে না পারলে ?”
মণির চোখে বিজলির চমক দেখেছিলাম।
-“বদনামের ভয় পাচ্ছ? মণি বেইমান নয় যে পিছন থেকে ছুরি মারবে। না খেয়েও লোন শোধ করব।”
পঁচিশ বছরের এই চকচকে ইস্পাতকে বাগ মানাতে পারেনি মণির বর বাপি। লাল রঙের স্কুটিটা যেদিন কিনে ঘরে তুলেছিল সেদিনই বাপি ঘর ছেড়ে চলে যায়।
-“কাজটা ভাল করোনি মণি। বাপিকে আটকানো উচিত ছিল। ও রাগ করেছে বলে তুমিও গোঁ ধরে থাকবে ?”
-“কুঁড়ের ধার একটা। শুধু ঘরে শুয়ে থাকে আর আমার পয়সায় খায়।”
মণির চোখে জল চিকচিক করছিল।
-“কত ভাল ইলেকট্রিকের কাজ জানে তবু খাটবে না ,কিছুনা। নয়তো ইলেক্টিরির লাইনে কম পয়সা ?”
চুপ করে ছিলাম। আগুনে ঘি দিতে নেই।
-“আমাকে তো সংসারটা টানতে হবে বলো। স্কুটিটা কিনেছি বলে দশবাড়ি কাজ করতে পারছি। ছেলেটার পড়ার খরচ, গ্যাস, ঘরভাড়া, নিজের কিছু শখ আহ্লাদ আছে। কোনো খরচাই দেয়না।”
-“আমার চেম্বারে একটা এসি বসাতে হবে। গরমে রোগীদের কষ্ট হয়। বাপিকে আসতে বোলো তো।”
মণি চোখ উল্টে বলেছিল, “তাকে কোথায় পাব! দেখগে কোথায় বসে মাল খেয়ে ফুর্তি করছে! গুণের তো শেষ নেই।” মণির নির্লিপ্ত ভাব চোখমুখে ফুটে উঠেছিল।
ঝাঁটা ফেলে দিয়ে তারপর আমার কাছে এসে নিচু গলায় বলেছিল, “আসলে হিংসে । বুঝলে ? ওকে বাদ দিয়েই যে সব চালিয়ে নিচ্ছি একা।”
-“যাহ, হিংসে হতে যাবে কেন ? ঠোকাঠুকি কোন সংসারে না হয়-”
-” না গো, আজ এক মাস হল আলাদা। তারাপীঠে গেছে। অন্য মেয়েছেলে আছে বোধহয় । আমিও দেখব কতো জেদ!”
কাজ হয়ে গেলে সাবান দিয়ে হাত পা ধুয়ে মণি প্রসাধন করত আমার চেম্বারের আয়নায়। ওটুকুই ওর বিলাসিতা। সিঁদুরের টিপ, গোলাপি লিপস্টিক। সিঁথিতে মোটা করে ভ্যাদভেদে সিঁদুর। সোপ অপেরার নায়িকাদের মতো।
এখন মণির সালোয়ার কামিজ জলে ভিজে চুপচুপে। কোনও আপত্তি শুনল না। দু’ বালতি জল তুলে , পাউরুটি সেঁকে ,চা করে মুখের সামনে দিয়ে গেল।
-“এক কাপ খেয়ে যাও মণি। এদ্দূর যাবে!”
-“সময় নেই।” মণির স্কুটি স্টার্ট দিয়েছে জলের মধ্যে ঢেউ তুলে।
হঠাৎ দেখলাম বাপিকে। প্যান্ট গোটানো হাঁটু অবধি। মাথা গামছায় জড়ানো। গায়ের টি শার্ট জলে জবজবে।
ওদের বাক্যালাপ যে ক্রমশ চড়া সুরে উঠবে , সে আশংকা সত্যি হল।
-“একদম না। ”
-“আরে, তোর সঙ্গেই তো যাব।”
-” উঁহু তোমার মতলব ভাল না, আমার কাছে টাকাকড়ি কিচ্ছু নেই।”
-“ভুল বুঝছিস। আমার কাজ আছে। সত্যি!”
-“মিথ্যুক! ফালতু বগ্গাবাজি করছ। এই তুমি যাবে না চিল্লাব?”
-” দ্যাখ বউ, না জেনে চেঁচাস না। ঝড়ে যেমন গাছ পড়েছে , তেমনই কারেন্টের পোল ভেঙেছে । অগুন্তি জায়গায় ট্রান্সফরমারে আগুন লেগেছে। এখন যদি সেগুলো মেরামত না করেই কারেন্ট দেওয়া হয় তাহলে শক খেয়ে মুড়িমুড়কির মতো মানুষ মরবে। লোক দরকার এখন।”
মণির দুচোখে আগুণ জ্বলে উঠল।
-“ও হো হো ভারি আমার কাজের লোক রে! কেন, গত বছর যখন বলেছিলাম, বসিরহাটের ইলেক্টিরি বোর্ডে লোক নেবে , গেসলে ? তখন তো বললে গেরামের লোকের কারেন্ট লাগে কীসে।”
রাগে খোঁপা খুলে মণির কোঁকড়ানো চুল ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে। হেলমেট পরতে পরতে ব্যঙ্গের সুর টেনে বলল, “হ্যাঁ গো, গেরামে আর কারেন্ট লাগে কীসে। চাষের ডিপ টিউব ওয়েল, শ্যালো পাম্প তো বড়লোকদের ফুঁয়ে চলে। বাচ্চারা পড়ে ঘুঁটের বিজলিবাতিতে। যাও যাও।”
-“সে তুই যতোই রাগিস না কেন, আজ আমাকে নিয়ে তোকে যেতেই হবে। ইন্টারনাল ওয়ারিংয়ের কাজ। সবাই জানেনা। বসিরহাট থেকে আজ ফোন করেছিল বড় অফিসার। চাকরিটা ছেড়ে দিলেও ঠিক মনে রেখেছে। বলল, বাপি একবার আসতে পারবে, বড্ড দরকার। লাখ লাখ লোক অন্ধকারে।”
‘ইন্টারনাল ওয়ারিং !’ শব্দটা গেঁথে গেল।
তারপরই দেখলাম জল কেটে লাল স্কুটি ভোঁ করে ছুটে বেরিয়ে গেল। মনিকে দুহাতে জড়িয়ে পিছনের সিটে বাপি। মাথার উপর ফ্যানটা হঠাৎ ঘুরে উঠল আর টিউবলাইটটা জ্বলে উঠল। এই বিস্তীর্ণ ধ্বংসের মধ্যেও দুদিনের মাথায় বিদ্যুৎ এল শেষ পর্যন্ত ? ছুটে গিয়ে পাম্প চালালাম। একফোঁটা জল ছিলনা।
অলক্ষ্যে থাকা আমাদের পাড়ার বাপিদের মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। সো প্রিভিলেজড উই আর। সমাজের প্রতিটি মানুষের ইন্টারনাল ওয়ারিংটা যদি এভাবেই ঠিক করা যেত!