বারমুডা আর স্যান্ডোগেঞ্জি পরা নিজের চেহারাটা সেলফিতে দেখল গেজেট। একবার , দু বার, তিনবার। ‘গেজেট’ নামটা পাড়াপড়শির দেওয়া। যেকোনও খবর ঝড়ের আগে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাবলু দাসের নাম ‘গেজেট’। তিপ্পান্ন বছরের বাবলুর এই স্বভাব আজকের নয়। তখন মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট গেজেটে বার করত শিক্ষাপর্ষদ । বাবলু মহানন্দে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পাড়ার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিত অকৃতকার্যতার সংবাদ। কে টায়েটুয়ে পাশ করেছে কিংবা কার থার্ড ডিভিশন!
বহুত মজা হত গেজেটগিরি করে। আত্মপ্রসাদ। কাঁকড়াগিরি। এখন আর সেদিন নেই। হোয়াটস অ্যাপ আর ফেসবুক এসে বাবলুর গেজেটত্ব মেরে দিয়েছে। খবর ছোটে হাওয়ার আগে। কোথায় সেই রামরাজ্য!
গেজেট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নেয়াপাতি ভুঁড়িটা গন্ডগোল করছে। দীর্ঘদিন লকডাউনে ঘরে বসে বসে কাঁহাতক বাসন মাজা আর কাপড় কাচা যায়! বিদ্রোহ করেছিল বলে বউ বলেছে বাসন মাজা মকুব। বদলে টিকটক করে হোয়াটস অ্যাপে ছাড়তে হবে।
-“টিকটক?”
-“হুঁ। তুমি নাচবে আর আমি বসে বসে মাল খাব।”
গেজেটের চোখ পকোড়া। -“নাচব?”
-“বচ্চনের ঐ গানটার সঙ্গে আমার গোলাপি ঘাগড়া পরে নাচবে । আর আমি তোমার দিকে টাকা ছুঁড়ে দেব।এতকাল ধরে তোমরা যা করেছ তার উল্টোটা।”
-“কোন গান ? জিসকি বিবি মোটি উসকা ভি বড়া কাম হ্যায়?”
একটা খুন্তি উড়ে এসেছিল গেজেটের মাথা লক্ষ্য করে।
বারমুডা ছেড়ে গোলাপী ঘাগড়া পরলে যদি বাসনমাজার কাজটা কমে! পুড়ে যাওয়া কড়াই মেজে ঝকঝকে করার থেকে ভাল। কীভাবে যে বউটা রোজদিন এই খাটুনির কাজ করে। যাকগে, এখন বোতল জোগাড় করতে হবে। অন্ধকার হোক। ভোলামুদির দোকানের পিছনে চুপ করে দাঁড়াতে হবে। সবাই ওভাবেই মাল কিনছে।
অন্ধকারে কলাপাতার মধ্যে খসখস আওয়াজে অস্বস্তি হতে লাগল গেজেটের। কুকুর ? নাকি শিয়াল? ভাতজাংলার এখানটা কৃষ্ণনগর শহরের একদম কাছে হলে কী হবে পাড়াগাঁ ভাব। তার মধ্যে বিনবিনে মশা। পাখির সাইজ। এক একটা কামড়াচ্ছে যেন কাঠঠোকরা। শালা! কেন যে বউয়ের আবদারে রাজি হলাম! মাল আনতে দোকানের গুদামে ঢুকে ভোলা করছেটা কী?
আজ বোধহয় পূর্ণিমা। চাঁদ উঠেছে আকাশে। সামনের বিশাল পরিত্যক্ত বাড়িটার ছাদে একটা ছায়া সরে গেল। গায়ে কাঁটা দিল গেজেটের।বাড়িটায় কেউ থাকে না আজ দশ বছর।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝি ধরেছে। তা হোক। তাদের জন্যই তো লোকের ঘরে টাকা ঢুকছে। অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। জয় হোক মাতালদের। ‘করোনা মাঈ কী জয়’ বলে চেঁচাতে গিয়েও চুপ করে গেল গেজেট। পেগ না মেরেই কী খোয়াব দেখছে ? থরথর করে কাঁপুনি শুরু হল।
‘ভূ উ উ উ ত’ দাঁতে দাঁত চেপে দড়াম করে উল্টে পড়ল গেজেট।
ভোলা বোতল নিয়ে বেরিয়ে গেজেটকে খুঁজে না পেয়ে হাঁক পাড়ল “কই গেলি? কেউ নেই রে। নিচ্চিন্তে আয়।”
কিন্তু মোমের আলোয় খরিদ্দারের মুখ দেখে ভোলার রক্ত চলকে উঠল। বুক গুড়গুড়।
ডাক্তারবাবুর আত্মা? উনি তো মারা গিয়েছেন আজ দু হপ্তা। প্রসাদ ডাক্তার। বড় ভাল চিকিচ্ছে করেন। কিন্তু, ওর নাকি করোনা হয়েছিল।
ভোলা হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠতেই ভিড় জমে গেল দোকানের সামনে।
চাঁদের ফ্যাটফেটে আলোয় ডাক্তার প্রসাদকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
-“আপনি বেঁচে আছেন ডাক্তারবাবু?”
-“ইয়ে, আমরা তো শুনেছিলাম আপনি এলাকা থেকে উধাও।”
-“সবাই দুঃখ পেয়েছে ডাক্তার। আপদ বিপদে রাতবিরেতে আপনার কাছে যেতাম!”
চন্দ্রালোকে উপস্থিত জনতার কারও কারও যাও বা সন্দেহ হচ্ছিল, ছায়ামূর্তি দেশলাই এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার চাইতেই সম্বিত ফিরল। মানুষ হাত ধুয়ে ফেলতে পারে। চিরদিনের স্বভাব। কিন্তু ভূত নিশ্চয়ই হাত ধুয়ে ফেলবে না। এ ডাক্তারবাবু না হয়ে যায় না। ভোলা খুচরো ফেরত দিতে গিয়ে ছায়ামূর্তিকে জড়িয়ে ধরল। “ডাক্তারবাবু আপনি আমার টিবি অসুখটা যেভাবে সারিয়েছিলেন! নয়তো মরেই যেতাম।”
“ঠিক ধরেছ ভোলা। আমি এখন ডাক্তার আত্মা প্রসাদ। তোমাদের জন্য সার্ভিস দিয়ে আজ নিজেই আত্মা হয়ে গেলাম। জানো কেন এমন হল?”
ভোলার চোখ ছলছলে।
“মাসখানেক আগের কথা। চেম্বারে এক রোগী এল। মোটাসোটা, ডায়াবেটিস। জ্বর। আমি দেখতে চাইছিলাম না। কিন্তু ঐ যে একটা শপথ নিতে হয়েছিল পাশ করার সময়। হিপোক্রেটিসের শপথ। অসহায় রুগী ফেরানো যাবে না। দেখলাম। ওষুধ পত্তর দিলাম।”
-“তারপর ?”
-“পরদিন খবর পেলাম রোগী মারা গেছেন। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। তবে কি রোগীর করোনা হয়েছিল? তবে কি আমারও?”
-“জানি স্যার, উনি কৃষ্ণনগরের বিরাট বড় বিজনেসম্যান ছিলেন। শেষটা খুব খারাপ। মারা যাওয়ার পর ফ্যামিলির কাছে বডি যায় নি। এমনকি যেভাবে লুকিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে যেন ক্রিমিনাল।”
-“ঠিক । বাস্তবটা এতটাই নিষ্ঠুর যে আমাকেও সেই ভয় তাড়া করল। আমার যদি রোগীর থেকে করোনা হয়, তাহলে আমারও কি একই পরিণতি? পাড়ায় লোকে আড়চোখে দেখবে, ফিসফাস করবে। মরে গেলে বউ, ছেলে, মেয়ে দেখতে পর্যন্ত পাবে না। এতো বছর ধরে মানুষকে সেবা করার এই পুরস্কার?”
গেজেট কখন জ্ঞান ফিরে পেয়ে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ বোঝেনি। ডাক্তার প্রসাদের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল গেজেট।
“ডাক্তারবাবু ক্ষমাঘেন্না করে দ্যান। প্রথম খবরটা আমিই ছড়িয়েছিলাম। লোকটার করোনা টেস্ট নেগেটিভ এসেছিল। কিন্তু ততোক্ষণে গুজবটা ছড়িয়ে গেছিল যে-”
“হ্যাঁ, স্যার , আপনাকে এভাবে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে! ছি ছি। লজ্জা আমাদের। কাল যদি আমাদের ঘরে ঘরে করোনা জ্বর হয় কোথায় পালাব সবাই? আপনারাই তো ভরসা।”
-“ভরসা নয় ভগবান।” ভিড়ের মধ্যে থেকে উড়ে এল কথাটা।
ডাক্তার প্রসাদ হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। “এই ভগবান বলা বন্ধ করুন তো। দশচক্রে ভগবান ভূত! ভগবানকে এক নিমেষে শয়তান বানানো যায়। একবার ছুঁয়ে দেখুন আমায়। আপনাদের মতো মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ। আসুন!”
“মাফ করেন ডাক্তারবাবু। বুঝতে পারছি, কী কষ্টের মধ্যে আছেন আপনারা ..”
“এই পুরনো বাড়িটায় আজ চোদ্দদিন ধরে আধপেটা খেয়ে আলাদা হয়ে আছি, জানেন? ঘুম নেই চোখে। সারাক্ষণ এক দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আজ কোয়ারেন্টাইন খতম। এবার বাড়ি ফিরব। বুড়ি মা আমার, কেঁদে কেঁদেই শেষ বোধহয়। আমাদের ঘরেও বউ বাচ্চা আছে। আমাদেরও ভয় হয়, ডিপ্রেশন হয়। কবে আর বুঝবেন?”
ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় দেখা গেল কারও কারও চোখে জল চিকচিক। নিস্তব্ধ চরাচর।
ডাক্তার এতক্ষণে আত্মপ্রসাদের আলগা হাসি দিলেন। হালকা।