প্রবল হাওয়ায় ঠক ঠক করে কাঁপছে জানলা। শার্সি ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। দামাল ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে তছনছ হচ্ছে বাংলা। নারীটি বুঝতে পারে শক্তিশালী এই ঝড়ের সঙ্গে তাকে যুঝতে হবে আজ একা।
সময়ের দশায় আজকের রাতে সে পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন। শ্বশুরবাড়িতে একাকিনী। মেয়েদের পাখিজীবন। না থাকে নিজের ঘর, না কিছু। ডিম পাড়ার জন্য বাসা বাঁধতে হয়। তাকে অবশ্য ভাগ্যের পরিহাসে নয়, পেশার বাধ্যতায় থাকতে হচ্ছে এখানে।
শাশুড়ি গত হয়েছেন একযুগ আগে। শ্বশুরের বাৎসরিক ক্রিয়াকর্ম সমাধা হল সবে। একমাত্র ছেলে মা বাবার জিম্মায়। রোজই কাজে বেরোতে হয়। এতবড় বাড়িতে বালকের পক্ষে একা থাকা ঝুঁকির। স্বামী কর্মস্থলে দূরে। তালাবন্ধ শহরে ছেলের ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে তাই দাদু দিদিমার নিরাপদ আশ্রয়ে।
পুরনো বাড়িতে আজকাল কেই বা থাকতে চায়? কিন্তু তারা চায়নি নগরের কৃত্রিম বৈভবে মোড়া খুপরি ফ্ল্যাটঘরে থাকতে। সেখানে নিত্যদিন হাজার সুবিধা। মসৃণ পিচঢালা রাস্তা, ঝলমলে বিপনি, ঝাঁ চকচকে সুইমিং পুল। আধুনিক বিলাসব্যসনের শতেক উপকরণ। নিরন্তর আন্তর্জালের মধ্যে মানুষগুলো জলহীন মাছের মতো খাবি খায়। বারান্দায় গোনাগুনতি টবে ফুল ফুটলেই সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে যায় সেই ফুলের ছবিতে।
কিন্তু ঘ্রাণ? তার সাবেকি বাড়ির পুরনো দালান, লাল মেঝে , খড়খড়ির জানলা খুললেই বাগান থেকে ভেসে আসে হাস্নুহানা। বেল , জুঁই, কামিনী। ভোর হতেই ঘুম ভাঙায় একজোড়া বুলবুল। বেলায় আসে দোয়েল। পুকুরপাড়ে আকন্দর ডালে বসে থাকে একজোড়া মাছরাঙ্গা। পুকুরে বুড়বুড়ি কাটে জলফড়িং। পাকা পেয়ারা খেতে রোজ আসে জোড়ায় জোড়ায় টিয়া।
শ্বশুর শাশুড়ি বেঁচে থাকতে একদিনের জন্যও তুলসিতলায় ফুল দেয়নি সে। ঢাকঢোল পিটিয়ে পুজোআচ্চার বিরুদ্ধে বরাবরই সঘোষিত বিদ্রোহী সে। এখন সে তুলসিতলায় যত্ন করে প্রদীপ দেয়। মনে হয় ওখানেই ঘুমিয়ে আছেন শ্বশুর শাশুড়ি।
আজ তুফান উঠেছে। শোঁ শোঁ আওয়াজে উথালপাথাল করছে ঘূর্ণিঝড়। বহুদূর জেলা থেকে একটা ফোন এল, “ঠিক আছ তো? পাম্পে জল তুলে রেখো। হাতের কাছে টর্চ, মোবাইল। আমিও জেগে থাকব রাতভোর।”
এগারো বছর আগে এমনই এসেছিল আয়লা। কত ক্ষয় ক্ষতি ! কত ঘর ভেঙে গেছিল। সেসব আর ফিরে পায়নি তারা।।রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে তলিয়ে গেছিল ঘর ফিরে পাওয়ার আশা। আজও কত লক্ষ মানুষের ঘরের দেওয়াল পড়ে গেছে, চাল উড়ে গেছে।
ঝুপ করে পাওয়ার কাট হল। ইনভার্টার চালু হয়েছে। কিছুক্ষণ অন্তত নিশ্চিন্তি। ঘর থাকতেও যারা আজ ঘরছাড়া , এক এক করে ফোন করতে শুরু করল সে।
“হ্যালো সুমন্ত্র, কী খবর?”
“আড়াই মাস বাড়ি যাইনি লকডাউনে। বউ, মেয়ের মুখ ভুলেই গেছি।”
“হ্যালো ইন্দ্রাণী, কী করছিস ?”
“এই তো লেবার রুমে। একটা ডেলিভারি করব রে।”
নারীটির আর একা লাগেনা। তার মনে হয় তার একলার ঘরখানা মিশে গেছে অন্য অনেক ঘরে। ঘরছাড়াদের সঙ্গে।