‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ’….
মহামারীতে আক্রান্ত পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশ। যারা অর্থ আর প্রতিপত্তির জোরে দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়াতো, যারা বিশ্বাস করত জোর যার মুলুক তার, এমন সব রাষ্ট্র শক্তি আজ অতিমারীর ভয়ে থরহরি কম্পমান। প্রকৃতির রুল বুকে একটাই সত্য আজও বুঝি চরম সত্য– দ্য সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট। বাঁচার লড়াইয়ে কে এগিয়ে যাবে আর জিতবে তা সময় বলে দেবে। আপাতত: যে ভয় আমাদের গ্রাস করেছে তা নিয়ে দু চার কথা।
কোভিড-১৯ ভাইরাস যে ভয়ানক ছোঁয়াচে সে এত দিনে আমরা সবাই জেনেছি। কিন্তু সেই ভাইরাসের ভয় যে তেমনই ছোঁয়াচে সেইটা বোধহয় এতটা ভেবে দেখা হয় নি। অভিযোজনের মাধ্যমে আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্ব আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে অন্যের উদবেগ বা ভয়ের ব্যাপারে আমরা অতি সংবেদনশীল। আমাদের মস্তিষ্ক খুব সহজেই অন্যের ভয় দ্বারা সংক্রামিত হয় এবং অন্যের উদবেগ ও ভয়কে নিজের বলে ধরে নিয়ে ভীত হতে পারে।
যেমন ধরুন আমরা সোস্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন খবর দেখছি, রাস্তায় লোকজন মাস্ক পড়ে ঘুরছে, বিভিন্ন দেশের মৃতের সংখ্যা বাড়ছে এসব দেখে শুনে আমাদের মনে ভয় জন্মাচ্ছে। আবার এও সত্য অনেকটা ভয় অন্যরা ভয় পাচ্ছে তার থেকেও সংক্রামিত হচ্ছে আমাদের মধ্যে। ভাবছি তা হলে তো সত্যিই ভয়ের বিষয় বটে। এতে বিপদ বাড়তে পারে, এমন ভয় বা উদবেগ মহামারীর আকার ধারণ করতে পারে এবং সামাজিক স্তরে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে এবং করছেও।
ভয় যখন মহামারী মানুষ তখন মানবিক হতে ভুলে যায়। যখন জানতে পারি ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীদের ভাড়া বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। একের পর এক বাড়ীর মালিক এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সে তো ভয়েই। অথচ বার বার বিভিন্ন সতর্কবার্তায় রোগ ঠেকাতে কি কি করণীয় তা পরিষ্কার ভাষায় জানানো হচ্ছে। তাতে কিন্তু কোথাও বলা নেই আপনার বাড়ীর একতলায় কি দোতলায় যিনি থাকেন তিনি স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত বলে তাঁকে বাড়ী থেকে বার করে দিতে হবে। মানে আমি বলতে চাইছি যতটুকু ভয় পাওয়ার ততটুকু ভয় পেয়ে যাবতীয় সরকারি নির্দেশাবলী মেনে চলতে হবে। কিন্তু অন্যের থেকে ভয় যেন আমাদের মধ্যে সংক্রামিত না হয় যাতে ভয়ের মহামারী সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আমাদের মস্তিষ্ক জটিলতম ধাঁধার মতো। আমরা রোগটাকে খুব ভয় পাচ্ছি এবং প্রাণপণ চাইছি তা যেন না ছড়ায়। অথচ বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর আমরা কিছুতেই নিজেদেরকে আলাদা করে রাখতে রাজি হচ্ছি না। বুঝতে চাইছি না এতে বাড়ির লোকের সংক্রমণ হতে পারে। আলাদা ভাবে থাকা তো দূরস্থান, উল্টে বহুজনের সঙ্গে মেলামেশা করা বা পার্টি করার ইচ্ছাও ত্যাগ করতে পারছি না। এই মনোবৃত্তি কিসের পরিচায়ক? সোশ্যাল ডিসটেন্সিং শব্দ কি আমাদের মধ্যে ভয় তৈরি করছে? জেনে বুঝেও এমন অস্বীকার করার মনোভাব আমাদের মধ্যে ভয়জনিত কারণে আসছে না তো?
এ যেন এক অন্য মহামারী!!! রোগ লুকিয়ে যাওয়া, বা বিদেশ সফরের হিস্ট্রি লুকিয়ে যাওয়া এ সবের আসল কারণ বোধহয় মনের গভীরে কাজ করা ভয় থেকেই আসছে। করোনা পজিটিভ হওয়ার বা হওয়ার সম্ভাবনা যেন সমাজচ্যুত হওয়ার সমান। এমনও জানা যাচ্ছে যে বিমান কর্মী বা বিদেশফেরত মানুষের পরিবার পরিজন প্রতিবেশির দ্বারা হেনস্থার শিকার হচ্ছেন।
এমন নয় তো ভয়ের সংক্রমণে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাবধানি হতে গিয়ে অমানবিক হয়ে পড়ছি। করোনা অসুখ একটা ভাইরাস সংক্রমণ বই তো আর কিছু নয়। বিশেষত: যাতে মৃত্যুর হার খুবই কম। উপযুক্ত সাবধানতা নিলে আর সচেতন হলে এই রোগকে মহামারী হওয়া থেকে আমরাই পারি আটকাতে। কিন্তু রোগের ভয় যদি প্রয়োজনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে মহামারী হয়ে দাঁড়ায় তবে কি আমরা পারব এই যুদ্ধ জয় করতে?
রোগ লুকোবেন না, সামাজিক দূরত্বের মানে কিন্তু সমাজচ্যুতি নয়। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক বন্ধন অটুট রাখা দরকার। অসুস্থ মানুষকে এক ঘরে না করে তাঁকে সোশ্যাল আইসোলেশনের ক্ষণস্থায়িত্ব সম্বন্ধে শিক্ষিত করা প্রয়োজন ও সাহায্যের আশ্বাস দেওয়া প্রয়োজন। এতে যাঁরা আক্রান্ত বা যাঁদের রোগগ্রস্ত হওয়ার আশংকা আছে তাঁরা অযথা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন না। ফলত: রোগ লুকোবার সম্ভাবনা কমবে।
এগিয়ে আসুন ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, সরকার ও জনসাধারণের পাশে দাঁড়ান। রোগের ভয়ে সাবধানতা নিন, কিন্তু অমানবিক হবেন না। তবেই আমাদের জয় সুনিশ্চিত করতে পারব আমরা।
Khub sundor describe korli re
এই দিকটা আরএকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।দিকনির্দেশনা