একটা কথা গতকাল উঠেছিল আমাদের বন্ধুদের কবিতা পাঠের এক ভার্চুয়াল জমায়েতে। সেখানেই এই বিষয়টা , যা আমি বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেটি হল প্যারোডি, মানে নামকরা কবিতার প্যারোডি, আদৌ কি তা কবিতার একটা ধারা বলে স্বীকৃত হতে পারে? প্যারোডির পেছনে কি ঘাম ঝরানো উচিত?
সর্বসম্মতিক্রমে আলোচনায় যা ঠিক হল, প্যারোডি কখনওই উল্লেখ্য সাহিত্যকর্মের নমুনা হতে পারে না। আমি একমত হলাম না। সে অন্য কথা। আমি তো এ’রকম বেয়াড়াপনা করেই থাকি।
আর একটা কথা তুললাম। প্যারোডি কি শুধু ব্যঙ্গাত্মক ভাবেরই বাহন হবে? তার কি অন্য ভাবের বাহন হবার যোগ্যতা নেই? এই ব্যাপারে কথা উঠতে বন্ধুরা কেউ কেউ বললেন, – হ্যাঁ, তা হতেই পারে।
তবে মোটামুটি ভাবে প্রাজ্ঞজনেরা যা বললেন, – তোমার কলম, তোমার কালি, তোমার কাগজ আর তোমার সময়। লিখতেই পারো, যা মন চায়। তবে, আমরা পড়ব না, কারণ আমাদের তা’ পছন্দসই না।
আমার ফেসবুকের বন্ধুরা কী মনে করেন এই প্যারোডি বিষয়ে? একটু জানতে চাইছিলাম।
ব্যঙ্গাত্মক নয় এমন প্যারোডি (বা, অনুকরণে লেখা, যাই বলুন) কিন্তু লিখেছেন নাম করা কেউ কেউ।
★
আকাশলীনা
— জীবনানন্দ দাশ
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস –
আকাশের ওপারে আকাশ।
এর অনুকরণ বা অনুসরণে লেখা
ফিরে এসো মালবিকা
— শক্তি চট্টোপাধ্যায়
মালবিকা অইখানে যেওনাকো তুমি,
কথা কয়োনাকো অই যুবকের সাথে,
কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে?
মালবিকা জানো তুমি ঘাসে কি লবণ?
সামনে দেওদার বন, আমি বসে আছি।
ফিরে এসো মালবিকা কী সুস্বাদ এখানে, জীবনে –
ফিরে এসো মালবিকা যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর,
শান্তিনিকেতনে আমি দেখেছি পলাশ-
ফিরে এসো মালবিকা,
ও-পলাশে আমি তোমাকে সাজাবো;
রাঙা ধুলো দিয়ে আমি তোমাকে সাজাবো;
ভালোবাসা দিয়ে আমি তোমাকে সাজাবো।
ফিরে এসো মালবিকা,
যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর।
এখানে মন্দিরে-মেঘে আশ্চর্য ঝংকার-
ফিরে এসো মালবিকা, ইচ্ছে করো, এখনই এসো!
★
এই প্রসঙ্গে,
‘জলদর্চি’তে সঞ্জীব কাঞ্জিলালের লেখা থেকে একটু উদ্ধৃতি দিই।
“ফিরে এসো মালবিকা
ও-পলাশে তোমাকে সাজাবো;
রাঙা ধুলো দিয়ে আমি তোমাকে সাজাবো
ভালোবাসা দিয়ে আমি তোমাকে সাজাবো।” (ফিরে এসো মালবিকা)
উক্ত কবিতাটি সম্ভবত কবির জীবৎকালে প্রকাশিত শেষ কবিতা। এই কবিতাটিতে কবি জীবনানন্দের পঙক্তির ঋণ স্বীকার করেননি বলে অভিযোগ উঠেছিল- এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকার পর্বে কবি লিখেছিলেন- “আমি নামটা বদলে নিয়েছি। আর বিশেষ কিছু বদলাইনি। দু’তিন লাইন আমি প্রয়োগ করেছি জীবনানন্দ থেকে…. আমি সচেতনভাবেই ওঁকে অনুসরণ করি, আবার এক সময় অবশ্য ওঁকে উতরে যাওয়ারও চেষ্টা করি।” বাস্তবিকই, পূর্বসূরির সম্মোহন যেভাবে উৎসারিত হয়- কুশ্রীতা থেকে সৌন্দর্যে- প্রেম থেকে অপ্রেমে- মাটি ও আকাশময় ইথার লগ্ন থাকে যার স্পন্দমানতা,- তার দ্বারা উত্তরসূরী এভাবেই ছেঁকে নেন শব্দলীন উৎসকে। তারপরই শুরু হয় অতিক্রমণের আন্তরিক উদ্যোগ। মেধা ও প্রজ্ঞানিহিত এই চেষ্টার সফলতা ও অসাফল্যের দীন ব্যর্থতা, যা বর্ণনাতীত কষ্টের। এ হিসাবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় যদি তাঁর পূর্বসূরি জীবনানন্দের অমোঘ, অতিক্রমনীয় সর্বগ্রাসী মায়া থেকে নিয়ে থাকেন প্রেমজাত অনুষঙ্গ- তবে তা কেবল সংস্কৃতি চেতনা সংক্রমণের ইতিহাস মাত্র। যা নিন্দার্হ নয়ই, বরং পুরাতন অনুষঙ্গের ভিটে-মাটিতে নতুন বাসার নব নির্মাণ। ”
এই যুক্তি-প্রবাহ কি তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেই তাঁর বেলায় গ্রাহ্য? অন্য কারওর জন্য তা প্রযোজ্য হবে না?
কিম্বা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা থেকেই যে নিজে…
১)
মায়াবনবিহারিণী হরিণী
গহনস্বপনসঞ্চারিণী,
কেন তারে ধরিবারে করি পণ
অকারণ।
থাক্ থাক্, নিজ-মনে দূরেতে,
আমি শুধু বাঁশরির সুরেতে
পরশ করিব ওর প্রাণমন
অকারণ॥
চমকিবে ফাগুনের পবনে,
পশিবে আকাশবাণী শ্রবণে,
চিত্ত আকুল হবে অনুখন
অকারণ।
দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব–
বাঁধনবিহীন সেই যে বাঁধন
অকারণ॥
২)
কাঁটাবনবিহারিণী সুর-কানা দেবী
তাঁরি পদ সেবি, করি তাঁহারই ভজনা
বদ্কণ্ঠলোকবাসী আমরা কজনা ॥
আমাদের বৈঠক বৈরাগীপুরে
রাগ-রাগিণীর বহু দূরে,
গত জনমের সাধনেই
বিদ্যা এনেছি সাথে এই গো
নিঃসুর-রসাতল-তলায় মজনা ॥
সতেরো পুরুষ গেছে, ভাঙা তম্বুরা
রয়েছে মর্চে ধরি বেসুর-বিধুরা।
বেতার সেতার দুটো,
তবলাটা ফাটা-ফুটো,
সুরদলনীর করি এ নিয়ে যজনা–
আমরা কজনা ॥
রবিঠাকুরের লেখা এই দ্বিতীয় লেখাটি নিয়ে আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব?
★
কিম্বা,
অরুণাচল নামের এক অর্বাচীন যে সুনীলকে অনুসরণ করে একদা লিখেছিল, নীচের লেখাটি…সেটিই কী হয়েছিল কিছু?
★
কেউ কথা রাখিনি
________________
কেউ কথা রাখিনি, একাত্তর বছর কাটলো,
কেউ কথা রাখিনি
ছেলেবেলায় এক মাঝরাতে
স্বাধীনতা তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
সূর্যোদয়ের পর আলোটুকু মেখে নিতে হবে
তারপর কত পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ চলে গেলো,
কিন্তু সেই আলোটুকু
আর এলোনা
আজও তার প্রতীক্ষায় আছি।
মানচিত্রে নতুন আঁকা আঁচড়ের ও’পাশ থেকে
নাদের আলী বলেছিল,
বড় হও দাদাঠাকুর
হাওড়ের মাঝখানে নৌকো বেয়ে যাবো এক দিন
সেখানে ঢেউএর মাথায় মাথায় লিলুয়া বাতাস
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো?
আঁচড় ক্রমশ গভীর হয়ে এখন ম্যাপে কাঁটাতারের বেড়া
এ’পারে মাসকেট আর ও’পাশে চাপাতি
অবিশ্বাস আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
হাওড়ের ঢেউ দেখাবে?
একটাও বিপ্লব ঠিক ভাবে করতে পারিনি কখনো
দেখিয়ে দেখিয়ে বাজার ছেয়েছে পাশের বাড়ির পশরা
ভিখারীর মতন ওদের চেয়ারম্যানকে
আমার চেয়ারম্যান ভেবে দেওয়ালে এঁকেছি
তাদের ভিতরে তখন কাজের উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে কারখানা ফসলের ক্ষেত
কত রকম উন্নতি ঝলসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!
বাবা পঞ্চবার্ষিকী ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন, আমরাও…
বাবার কারখানা এখন বন্ধ, নতুনকে তাড়িয়েছি
সেই প্রতি হাতে কাজ, সেই ডলার ছোঁয়ার স্বপ্ন,
সেই বিপ্লব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবেনা!
পরপর প্রজন্মকে ডেকে ভালোবাসা বলেছিল,
যেদিন সে সত্যিকারের আসবে
সেদিন প্রত্যেক বুকে আতরের গন্ধ হবে!
ভালোবাসার জন্য কেউ হাতের মুঠোয় প্রাণ নিইনি
দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধার সাহস পাইনি
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে আদৌ খুঁজিনি ১০৮টা নীল পদ্ম
প্রেমিকাকে অবলীলায় বেচে দিয়েছি বাজারে
প্রেমিককে ছেড়ে কর্পোরেটের হাত ধরে পাড়ি দিয়েছি বিলেত আমেরিকায়
অসহায় মেয়ের শরীর ছিঁড়ে খুঁজেছি শুধুই মাংসের গন্ধ
কেউ কথা রাখিনি,
তিরিশ বছর… চৌত্রিশ বছর কাটল
তারপরের সাত বছরও
কেউ কথা রাখিনি!
★
প্যারোডি আমাকে টানে। এই নিয়ে বিপদেও পড়েছি কম না। প্রায় ইতিহাস বিকৃতির দায়ে পড়ে গেছি। এও এক বিভ্রাট, আজ্ঞে হ্যাঁ, বিপরীত-সম্মাননা বই কি! তলায় ইউ টিউব লিঙ্কে সেই গোলোযোগের বিবরণ রইল।
★
★