গত দিন দুয়েক ধরে হঠাৎ লোকজন একটা মানসিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করছে। তার নাম প্যাথলজিকাল লাইং (যার অন্য দুটো গালভরা সমার্থক প্রতিশব্দ হলো – মিথোমেনিয়া এবং সিউডোলগিয়া ফ্যান্টাস্টিকা)।
প্রথম উপপাদ্য এই, যে প্যাথলজিকাল লাইং, ইন্টারনেটে যেখানে যা-ই লিখুক না কেন, একটা মানসিক অসুখ নয়। কিছু কিছু মানসিক সমস্যার প্রকাশের নানা ভঙ্গিমার তালিকায় এই ধরণের মিথ্যা কথা বলা দেখা যায়।
সে সব তোমরা চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অসুখের তালিকার বই ICD 11 বা অ্যামেরিকান সাইকিয়াট্রিক আসোসিয়েশনের “ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকাল ম্যানুয়াল” খুলে দেখে নিও।
মিথ্যে সবাই বলে। একমাত্র যুধিষ্ঠির কোনও দিন বলেননি (ইতি গজ)। আর এক ইংরেজ পাদ্রী, যিনি ছোটোদের “মিথ্যে বলা” প্রতিযোগিতার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, “তোমরা মিথ্যে বলার কম্পিটিশন করছ? জানো, আমি জীবনে একটাও মিথ্যে বলিনি!” – এবং এই বলেই তিনি কম্পিটিশনের প্রথম পুরষ্কার (একটি আপেল) জিতে নেন।
এক সময়ে একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছিল যে সাধারণ মানুষ দিনে গড়পড়তা দুটো মিথ্যে বলে। পরবর্তীতে অন্যান্য রিসার্চে জানা গেছে যে বহু মানুষ দিনের পর দিন মিথ্যে না বলে কাটাতে পারে, আবার অনেকে প্রায়ই মিথ্যে বলে।
“বাধ্য হয়ে” মিথ্যে বলা আর “অপ্রয়োজনে” মিথ্যে বলার মধ্যে তফাৎ আছে। তবে অল্ডার্ট ভ্রিজ প্যাথলজিকাল লাইং-এর যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে অনেক মিথ্যেই প্যাথলজিকাল লাইং-এর পর্যায়ে পড়বে। ভ্রিজ বলেছেন, প্যাথলজিকাল লাইং হলো “a successful or unsuccessful deliberate attempt, without forewarning, to create in another a belief which the communicator considers to be untrue.”
এ যদি সত্যি হয়, তাহলে অনেক মিথ্যেই প্যাথলজিকাল লাইং হয়ে দাঁড়াবে। হোমওয়ার্ক না করে – কাল রাতে বাবার শরীর খারাপ হয়েছিল থেকে আরম্ভ করে ঠাকুমা মারা গেছে বলে স্কুল/কলেজ/অফিস আসব না… সবই প্যাথলজিকাল লাইং।
সিউডোলোগিয়া ফ্যান্ট্যাস্টিকার আরও কতগুলো লক্ষণ আছে। সেগুলো এমন –
১) Chronic lying/storytelling that is unrelated to or out of proportion to any clear objective benefit; অর্থাৎ কোনও (সামঞ্জস্যপূর্ণ) লাভের জন্য মিথ্যে বলা নয়। বলার জন্য বলা। বলব বিনা আশায়, বলব বিনা ভাষায়…
২) Qualitatively the stories are dramatic, detailed, complicated, colorful, and fantastic; বলব মুখের হাসি দিয়ে, বলব চোখের জলে…
৩) The stories typically feature the pseudologue as the hero or victim and seem geared to achieve acceptance, admiration, and sympathy; এটা নিঃসন্দেহে “লাভ” কিন্তু ওইটুকুই।
৪) In terms of insight, the pseudologue lies somewhere along a spectrum between conscious deceit and delusion, not always conscious of his motives and seeming at least intermittently to believe his stories yet never to reach the level of conviction that would indicate a loss of reality-testing. অর্থাৎ যা বলছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও, যিনি বলছেন তিনি সেটা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে বলতেও পারেন (না-ও পারেন), যদিও অন্যান্য দিকে তাঁর সত্য, বা আসলের ব্যাপারে জ্ঞান টনটনে।
সুতরাং, সিউডোলোগিয়া, বা প্যাথলজিকাল লাইং বললেই শুনব না। যা কিছু তোমাগো বোধশক্তির বাইরে, বা ভালো লাগছে না, সবই সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্টদের ঘাড়ে ঠেলে দেবার এই অপচেষ্টা মানছি না, মানব না। চিকিচ্ছে করব না, যা খুশি করো গে যাও।
এর সঙ্গে আমার বউ-য়ের কী সম্পর্ক? সেটাই বলছি। গল্প না হলে তো জমবে না।
ব্যাঙ্গালোরে নিমহ্যানস-এ তখন আমার নিউরোলজিতে পোস্টিং চলছে। আমি সাইকিয়াট্রির ছাত্র, নিউরোলজি শিখতে গেছি। নিউরোলজি, বা সাইকিয়াট্রি বিভাগে আমার পদমর্যাদা সবচেয়ে জুনিয়র ডাক্তারের – যাকে বলে জুনিয়র রেসিডেন্ট। নিউরোলজিতে যে সব জুনিয়র রেসিডেন্ট, বা তাদের ওপরের পদে সিনিয়র রেসিডেন্টরা কাজ করত, তারা চেষ্টা করত আমাদের দিয়ে যত ওঁচা কাজগুলো করিয়ে নিতে – আর আমরা সর্বদা চেষ্টা করতাম সেগুলো না করতে। ডাক্তারি শিখতে গেছি। ক্লার্ক আর বেয়ারার কাজ কেন করব বাপু?
এই উদ্দেশ্যে আমি নিউরোলজি বিভাগে জানাইনি যে আমি একসময় কলকাতায় নিউরোলজিতে সিনিয়র রেসিডেন্ট-এর তুল্য পদে কাজ করেছি। তাহলেই আমাকে শেখানো ছেড়ে এটা করে দে, ওটা করে দে করতে শুরু করবে সবাই – যেচে তো কেউ গরুকে বলে না, আমাকে ঢুঁসোতে আয়।
দেশের নানা জায়গা থেকে আমাদের মতো সাইকিয়াট্রি ছাত্র ছাত্রী আসত নিমহ্যানস-এ নিউরোলজি শিখতে। আমাদের সময়ে অন্যতম জনপ্রিয় ছাত্রী ছিল ভিনরাজ্য থেকে আসা এক বাঙালি। ধরা যাক তার নাম সুমিত্রা। সুমিত্রা খুব মজার মেয়ে। মন দিয়ে কাজ করত, আর কাজ শেষ হলে মন দিয়ে হইচই করত। ওর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ভূতের গল্পে ইন্টারেস্ট। সেটা এমনিতে খারাপ নয়, কিন্তু হঠাৎ কাউকে যদি দুপুর দুটোর সময় লাঞ্চ খেতে খেতে ক্যান্টিনের গমগমে হইচইয়ের মধ্যে বলা হয়, “একটা ভূতের গল্প বল/বলো!” তবে অন্তত প্রথমবার সে চমকাতে বাধ্য।
আমি সেদিন চটপট আমার কাজ সেরে ক্যান্টিনে বসে কফি খাচ্ছিলাম। নিউরোলজিতে পোস্টিং-এর ফলে সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টের নানা অ্যাকাডেমিক অনুষ্ঠানে আমাদের না গেলেও চলত, কিন্তু সে দিন বোধহয় যাওয়া-উচিত ধরণের কিছু একটা ছিল।
একা একা বসে মন দিয়ে কফি খাচ্ছি, হঠাৎ সামনের সিটে ধপ করে বসল এসে সুমিত্রা।
সুমিত্রার এই ধপ করে বসাটা আমরা ততদিনে চিনে গেছি, এবং সেটাতে ডরাতাম না – এমন কেউ ছিল না।
বললাম, “ভূতের গল্প বলার সময় নেই।”
সুমিত্রা পাত্তা দিল না। কফি আসা অবধি এটা সেটা বলল, তারপরে প্রথম চুমুক দিয়ে কফির কাপ নামিয়ে রেখে বলল, “তুই বিয়ে করেছিস কত বছর?”
আমি ঠোঁটে তখন কফির কাপ। অন্য কেউ হলে বিষম খেত, কিন্তু আমি অম্লানবদনে কফি গিলে বললাম, “দু বছর।”
সুমিত্রা কী উত্তর আশা করে প্রশ্নটা করেছিল জানি না, তবে চোখ গোলগোল হয়ে গেল। কফিতে দ্বিতীয় চুমুক দেবার জন্য কাপটা তুলতে যাচ্ছিল, সেটা থেমে গেল মাঝ আকাশে। তারপরে আস্তে আস্তে নামিয়ে রেখে ততোধিক আস্তে আস্তে বলল, “সত্যি?”
আমি “নন-চ্যাল্যান্ট” ভাবে বললাম, “আশ্চর্য! প্রশ্ন করবি, তারপরে উত্তর পেয়ে জানতে চাইবি উত্তরটা সত্যি কি না – তাহলে আমাকে জিজ্ঞেসই বা করলি কেন?”
সুমিত্রা আস্তে আস্তে বলল, “না, তা নয়। তবে…” তারপরেই উত্তেজিত হয়ে বলল, “শালা, আমি ঠিক ধরেছিলাম। সবাই জানে তুই অবিবাহিত। কিন্তু আমি বলেছিলাম, ‘ওর নিগ্ঘাৎ বউ আছে, এখানে কাউকে বলেনি। ঠিকমতো প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে আসবে।’ তবে ভাবিনি এত সহজে বলে দিবি।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমি তো কাউকে বলিনি আমি অবিবাহিত।”
সুমিত্রা জোর দিয়ে বলল, “কিন্তু তোর হাবভাব অবিবাহিতর মতো। মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াস (সেটা অবশ্য সত্যি নয়। ছেলেদের সঙ্গেও ঘুরে বেড়াতাম)। তোকে দেখে কেউ ভাবেইনি আজ অবধি যে তুই বিয়ে করেছিস, বা করে থাকতে পারিস।”
আমি শ্রাগ করে বললাম, “আমাকে জিজ্ঞেস করলেই জানত। আমি তো কাউকে মিথ্যে বলিনি – এই দেখ না, তুই জিজ্ঞেস করেই জানতে পারলি।”
ডান হাতের তর্জনী তুলে ডাইনে-বাঁয়ে নাড়িয়ে নাড়িয়ে সুমিত্রা বলল, “উঁ-উঁ-উঁ-হুঁ… আমি ঠিক প্রশ্ন করেছি বলে উত্তরটা বেরিয়েছে। সত্যি করে বল, আমি যদি জিজ্ঞেস করতাম, ‘অনিরুদ্ধ, তুই বিয়ে করেছিস?’ কী বলতি? ‘হ্যাঁ’, না, ‘না’?
মানতে বাধ্য হলাম, ওভাবে জিজ্ঞেস করলে তো ‘না’-ই বলতাম। ‘দু-বছর’ বলার কথা মাথায় আসত না।
এবারে বেশ উৎসাহ নিয়ে জমিয়ে বসল সুমিত্রা। বলল, “বেশ। এবারে বল। দু-বছর বিয়ে হয়ে গেছে তোর?”
একটু ভাবার মতো করে ওপর দিকে তাকালাম। বললাম, “দুবছর হয়ে গেছে, দু বছর হয়ে আরও দুই… না, তিন মাস চলছে।”
“কী নাম তোর বউয়ের?”
কী নাম বলেছিলাম, মধুবালা, না বৈজয়ন্তীমালা, না টুনটুন… এখন মনে নেই। গল্পের খাতিরে ধরা যাক বুঁচকি (ওই, যে হ্যাঁ বলেছিল যাঃ বলে)।
“কী করে?”
“চাকরি।”
“কোথায়?”
“ওয়ার্নার ব্রাদার্সে।”
সুমিত্রার হাত থেকে কফির কাপটা পড়ে গেল। ভাগ্যিস কফি শেষ হয়ে গেছিল! বলল, “ওয়ার্নার ব্রাদার্স মানে?”
বললাম, “ওরা একটা অ্যামেরিকান কম্পানি। সিনেমা বানায়…”
“ওয়ার্নার ব্রাদার্স কী করে আমি জানি রে, শুয়ার। বলছি, ওখানে কাজ করে মানে? অ্যাক্টিং করে? অ্যাক্ট্রেস?” (তখনও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে অ্যাক্টর বলার রেওয়াজ চালু হয়নি)
মাথা নাড়লাম। বললাম, “ওয়ার্নার ব্রাদার্স মানেই কি অ্যাকটিং করতে হবে নাকি? কত কাজ আছে – ডিরেকশন আছে, এডিটিং আছে, সাউন্ডের লোকজন – ইঞ্জিনিয়ার থেকে নিয়ে যে মাইক ধরে থাকে – সব আছে। তবে বুঁচকি অফিসে কাজ করে। অ্যাডভার্টাইজিং-এ। সিনেমার সঙ্গে ওর কোনও ডিরেক্ট সম্পর্ক নেই।”
“কলকাতায় ওয়ার্নার ব্রাদার্সের অফিস আছে?”
আছে, মানে ছিল তখন – ল্যানসডাউন পদ্মপুকুর পার করে উত্তরে যেতে গেলে একটা-দুটো বাড়ি পরেই ডানহাতে একটা দেওয়ালে একটা চার ইঞ্চি বাই ছ’ইঞ্চি বোর্ড ছিল, তাতে লেখা ছিল ওয়ার্নার ব্রাদার্স – তার নিচে আর কী লেখা থাকত বাসের দোতলা থেকে পড়া যেত না।
কিন্তু আমি বললাম, “কলকাতায় কাজ করবে কেন? হলিউডে করে।”
“তোর বউ হলিউডে থাকে?”
থাকে।
“কী করে ওখানে গেল?”
তখন জানা গেল যে আমার বউ ফার্স্ট জেনারেশন অ্যামেরিকান বাঙালি। ওর মা বাবা দুজনে বিয়ের পরে অ্যামেরিকা যান। এবং ওখানে সেটল করেন। বুঁচকির জন্ম ওখানেই।
“তার মানে ও জন্মসূত্রে আমেরিকান সিটিজেন?”
ঘাড় নাড়লাম।
“তার মানে তুই-ও বিবাহসূত্রে আমেরিকান সিটিজেন?”
বললাম, “আমার ব্যাপারটা অত সহজ না। আমি যদি আমেরিকা গিয়ে ওকে বিয়ে করতাম, তাহলে যত সহজে হত, অত সহজ না। আমাকে গিয়ে সিটিজেনশিপ অ্যাপ্লাই করতে হবে, তারপরে ন্যাচারালাইজেশন প্রোসেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। বিয়ে না-করে ওখানে গিয়ে সিটিজেনশিপ অ্যাপ্লাই করলে যত ঝামেলা তার চেয়ে সোজা, তবে আমি অ্যাপ্লাই না-ও করতে পারি।”
আরও আশ্চর্য হয়ে সুমিত্রা বলল, “কেন?”
মুখ বেঁকিয়ে বললাম, “আমার ভালো লাগে না। গ্রিন কার্ড এমনিই পেয়ে যাব। তাহলে আর সিটিজেনশিপ কেন?”
ব্যাপারটা বুঝল না সুমিত্রা, কিন্তু আর তর্ক করল না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ওর ইন্টারেস্ট অন্য দিকে। বলল, “কিন্তু এরকম একটা মেয়ের সন্ধান পেলি কোথায়?”
বললাম, “আমি পাইনি। সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে।”
সুমিত্রার চোখ গোল থেকে গোলতর হয়ে গেল। “সম্বন্ধ করে! তুই? বিশ্বাসই হয় না। তুই সম্বন্ধ করে বিয়ে করেছিস?”
আমি আরও আশ্চর্য হয়ে গেলাম। “আমি সম্বন্ধ করে বিয়ে করতে পারি না কেন? শতকরা কতজন ভারতীয় আজও সম্বন্ধ করে বিয়ে করে জানিস?”
তা জানে সুমিত্রা, কিন্তু আমি সম্বন্ধ করে বিয়ে করেছি সেটা ভাবতে ওর কেমন অসুবিধে হচ্ছে…
“কিন্তু তোর সঙ্গেই বিয়ে হলো কেন? তোর মধ্যে কী এমন আছে?”
আমি দু’হাত মেলে দিয়ে বললাম, “তা তো জানি না, যোগাযোগ হলো… কাগজে বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন না। ওর মা-বাবা ছোটোবেলা থেকে ওকে বাঙালি কালচারে, মানসিকতায় বড়ো করেছেন, কলকাতা বেসড্ ডাক্তার পাত্র চাইছিলেন, আমার কথা জানতে পেরে আমার বাবা-মা-কে অ্যাপ্রোচ করলেন…”
“আর তুই রাজি হয়ে গেলি?”
“আমার আপত্তির কারণ কী? পাত্রী হিসেবে মোটেই খারাপ না। অ্যামেরিকান সিটিজেন, চাকরি করে, স্মার্ট…”
“সুন্দরী?”
“খুব। বাঙালিদের মতো সুন্দরী। অ্যামেরিকানদের মতো না।”
সুমিত্রা একটু ভাবল। তারপরে বলল, “তোর দিকটা তো বুঝলাম, শালা। ভালো দাঁও মেরেছিস। কিন্তু বুঁচকি তোকে বিয়ে করল কেন?”
মাথা নেড়ে বললাম, “জানি না। তবে ফুলশয্যার রাতে বলেছিল, ওর একটাই চাওয়া ছিল – মা বাবাকে বলেছিল, যাকে নিয়ে আসবে তাকে বিয়ে করব, কিন্তু বরের দাড়ি থাকা চাই।”
এবারে বিষম খেল সুমিত্রা। কেশে টেশে নিয়ে জল খেয়ে বলল, “তোর বউ-টা পাগল মাইরি।”
বললাম, “দাড়িওয়ালা বর চাইলে সেটা যদি পাগলামি হয়, থাকুক সে পাগলামি দীর্ঘজীবী হয়ে…”
“তা এর পরে তোর প্ল্যান কী? মানে তুই তো এখানে সাইকিয়াট্রিস্ট হচ্ছিস, আর ও ওখানে চাকরি করছে… তারপরে?”
আমি বললাম, “ওটাও ইমিগ্রেশনের আইনের জন্যই। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে অ্যাপ্লাই করলে যত সময় লাগে, সে প্রায় দু’বছরই কেটে যায়। আরও পরে যদি যাই, আমার পেপার্স থ্রু হবে তাড়াতাড়ি। তাই ভাবলাম এর মধ্যে এম-ডি টা করে নিই। এম-ডি পেলাম না, তাই ডিপিএম করছি। আমার শেষ হতে আরও এক বছর দু মাস। আর একবছরের মাথায় বুঁচকির একটা প্রোমোশন ডিউ। ওই প্রোমোশনটা হলে ও-র পোস্টিং হবে লস এঞ্জেলেস শহরেই হেড অফিসে।”
“ওয়ার্নার ব্রাদার্সের হেড অফিস লস এঞ্জেলেস-এ? হলিউডে না?”
“হলিউড – লস এঞ্জেলেস কত আর দূর। আর হেড অফিস তো সবসময়েই বড়ো শহরে – তাই না? হলিউডে তো সিনেমা হয়, ব্যবসা তো হয় এল-এ থেকে।”
“আর তুই ওখানে গিয়ে কী করবি?”
“আমি এম-ডি করব, সাইকিয়াট্রিতে – ইউ-সি-এল-এ-তে।”
সুমিত্রার মুখ হাঁ হয়ে গেল। “শালা, মাইরি তুই তো হেবি ছক্কড় পার্টি! তলে তলে তোর এত – কেউ জানে না?”
আমি আবার শ্রাগ করে বললাম, “কেউ না জানার দায়িত্ব তো আমার নয়। আমি তো কাউকে যেচে কিছু বলতে যাইনি। তবে কেউ জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই বলে দিতাম – এই যেমন তোকে বললাম।”
সুমিত্রা এতই অবাক হয়ে গেছিল, যে কিছু বলতেই পারল না। চলে গেল।
রাত হয়েছে, শুতে যাব… এমন সময় হস্টেলের ঘরের দরজায় টোকা। দরজা খুলে দেখি দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র রামচন্দ্রন। তামিল বাঙালি, লেক মার্কেটের কাছে বাড়ি ছিল – ওদের আমরা ছোটোবেলায় ম্যাড্রাসি বলতাম। রামচন্দ্রন মেডিক্যাল কলেজে আমার জুনিয়র ছিল। এবং তখন নিমহ্যানসে আমার চেয়ে একবছরের সিনিয়র। আজ থেকে দু’বছর আগে আমার জীবনে কী ঘটছে ও ভালো করেই জানে।
দরজা খোলামাত্র বলল, “তোমার দু’বছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে?”
আমি দরজা হাট করে খুলে বললাম, “আরে চুপ চুপ, ভেতরে আয়।”
রামচন্দ্রন মাথা নেড়ে বলল, “না, দাদা, বেরোতে হবে। চট করে তোমাকে বলে যাই, তুমি সলিড কেলো করেছ।”
কী কেলো করেছি?
যেটা জানা গেল তা হলো এই –
নিমহ্যানসে আমাদের চেয়ে বেশ সিনিয়র এক বাঙালি দাদা ছিলেন। তিনি আর “বৌদি” ছিলেন সব বাঙালির অবিসম্বাদী দাদা-বৌদি। কী করে জানি সব বাঙালি নিমহ্যানসে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যেক দিন সন্ধেয় ম্যারেড সিনিয়রদের কোয়ার্টারে দাদার বাড়িতে গিয়ে আড্ডায় জমায়েত হত। কী করে জানি না, সে আড্ডায় আমি কোনও দিনই যাইনি।যদিও দাদা-বৌদির সঙ্গে আমার অসদ্ভাব ছিল না।
“বৌদি তোমার জন্য দু’চারটে ভালো বাঙালি মেয়ের সম্বন্ধ দেখছিল। সেই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল কাল। হঠাৎ সুমিত্রা বলল, ‘হতেই পারে না অনিরুদ্ধর বিয়ে হয়নি। ওর চালচলন হাবভাব দেখেই বোঝা যায় ওর বিয়ে হয়ে গেছে।’ বৌদি বলল, ‘কিন্তু সবাই জানে ও অবিবাহিত।’ সুমিত্রা বলল, ‘ঠিক করে জিজ্ঞেস করোনি কেউ। ঠিক করে জিজ্ঞেস করলে ও বলে দেবে। যখন ও একেবারে প্রশ্নটার জন্য প্রিপেয়ার্ড না, তখন।’ আর আজ সন্ধেবেলা এসেছে খুব উত্তেজিত – তোমাকে চালাকি করে স্বীকার করিয়েছে যে তুমি বিবাহিত – ফলে সেই নিয়ে খুব আলোচনা। কিন্তু কেলোটা হয়েছে যে বৌদি তোমার ওপর খুব রেগে গেছে। তুমি বিবাহিত, কিন্তু ব্যাচেলরের মতো চলাফেরা – তাতে বৌদি খুব চটেছে। আমি বলে দেব যে তুমি আসলে বিয়ে করোনি, সুমিত্রাকে ঢপ দিয়েছ।”
বৌদি আমার ওপর চটলে আমার কিছু এসে যায় না, কিন্তু বুঝলাম রামচন্দ্রন বোধহয় কলেজের দাদার বদনামে কলেজের অমর্যাদা হয়েছে মনে করেছে, তায়, ও আসল ঘটনা জানে, কোনও দিন জানাজানি হলে ওর ওপরেও বৌদি চটবেন, তাই নিজের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য গল্পটাকে, যাকে বলে straighten করতে হবে।
বললাম, “সুমিত্রা তো আর ক’দিন পরে নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। তারপরে বললে হয় না?”
রামচন্দ্রন আবার ঘাড় নেড়ে চলে গেল। পরে জেনেছিলাম ও সেদিনই বা পরদিনই গিয়ে দাদা-বৌদিকে সব বলে দিয়েছিল। তাতে ওর কী সুবিধে হয়েছিল জানি না, কিন্তু আমার হয়েছিল। বৌদি আমার ওপর এতই চটেছিলেন, যে আমার জন্য মেয়ে দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আর আমাকে আর বানিয়ে বানিয়ে ভূতের গল্প বলতে হয়নি কোনও দিন।
এই হলো সিউডোলগিয়া, বা প্যাথলজিকাল লাইং-এর একটা সিঙ্গল উদাহরণ। এরকম উদাহরণ আগে আরও দুটো লিখেছি “অটরবটরপট” কাহিনি সম্ভারে। ফেসবুকে আছে, চাইলে দেখে নিতে পারো।
বেশ পি-এম মেটিরিয়াল না আমি? সি-এম তো হতে পারব না। অনেক চেষ্টা করেছিলাম বুধবার। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ধোপে টিঁকল না। Ratnaboli pipped me at the post. সে ও নাহয় সি-এম হোক, আমি পি-এম হব। ভালো ভালো
গল্প বলব রোজ…
চলবে না?