হেল্থের সাথে যুক্ত নন এরকম কয়েকজন বন্ধু দিন পনেরো আগে আমার একটা পোস্টে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘ক্যাচ কেস’ মানে কী? সময়ের অভাবে সেদিন না পারলেও আজ চেষ্টা করব আপনাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়ার। ‘ক্যাচ’ শব্দের অর্থ হ’ল ধরা আর ‘কেস’ মানে রোগী। অর্থাৎ যে রোগী কাউকে ধরে কিম্বা কারও সুপারিশে হাসপাতালে ভর্তি হয়। ব্যুৎপত্তিগতভাবে ক্যাচ কেসের অর্থ যাই হোক না কেন, মেডিক্যাল প্র্যাকটিসে ক্যাচ কেস বলতে খুবই চেনা কোনো পেশেন্ট বা খুবই পরিচিত কারও নিকট রোগীকে বোঝায়। মূলতঃ সাত ধরণের ক্যাচ কেস আমরা পেয়ে থাকি।
১) স্বগোত্রীয় ক্যাচ কেস:
এক্ষেত্রে কোনো সহকর্মী ডাক্তার, মেডিক্যাল স্টুডেন্ট, অথবা সিস্টার দিদি নিজেই রোগী হয়ে ভর্তি হন। এটা আমাদের কাছে ভীষণ টেনশনের ব্যাপার। কারণ, যার চিকিৎসা করা হয় তিনি নিজে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেককিছুই জানেন। তাই বেশ ভয়ে ভয়ে স্টেপ নিতে হয়। ফলে বহুক্ষেত্রেই রোগী ওভার-ট্রিটমেন্ট এবং আণ্ডার-ট্রিটমেন্ট উভয়েরই শিকার হন। অধিকাংশ ডাক্তারবাবুই এইসব ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক নেন না, কিন্তু শরীরের সমস্ত অ্যাড্রেনালিন কয়েক মিনিটেই খরচ করে ফেলেন।
২) স্ব-গোত্রীয় পারিবারিক ক্যাচ কেস:
এক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসকের মা-বাবা, স্পাউজ কিম্বা ছেলে-মেয়ে চিকিৎসার জন্য অপর একজন চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। বহু ডাক্তারবাবু এক্ষেত্রেও পারিশ্রমিক দাবি করেন না। এমনকি দিতে চাইলেও অনেকেই রিফিউজ করেন। অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ প্রথম গোষ্ঠীর থেকে কোনো অংশেই কম হয় না।
৩) স্ব-গোত্রীয় পরিবার-বহির্ভূত ক্যাচ কেস:
এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য নন এমন কারও জন্য কোনো ডাক্তারবাবু ক্যাচ মারেন। যেমন ডাক্তারবাবুর ক্লাবের বন্ধু, ডাক্তারবাবুর ইনসিওরেন্স করে দেওয়া এজেন্ট, ডাক্তারবাবুর পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন এমন কেউ, অথবা ডাক্তারবাবুর শ্যালকের খুড়শাশুড়ির ভাই… ব্লা ব্লা ব্লা! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তারবাবু একবার দেখা করে কিম্বা ফোন করে বলে দেন, “আমার পরিচিত। একটু দেখো কিন্তু।” ব্যাস! উনি তো বলে দিয়েই খালাশ! তারপর কী পরিমাণ ঝক্কি চিকিৎসাকারী ডাক্তারকে পোহাতে হয় তা শুধু তিনিই জানেন। রোগীর বাড়ির লোক এই ছোটোখাটো ক্যাচ পড়ার পর নিজেদের প্রিভিলেজড গোষ্ঠীর লোক ভাবতে শুরু করে। এক্ষেত্রে চিকিৎসক পারিশ্রমিক দাবি করলে রোগীর বাড়ির লোক বিশেষ সন্তুষ্ট হয় না। “এত চেনা হওয়া সত্ত্বেও ডাক্তারবাবু ফী চাইলেন!”….ছুটির পর অনেকেই এই কষ্ট বুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।
৪) প্রভাবশালী ক্যাচ কেস:
এক্ষেত্রে রোগী প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ার সুবাদে হাসপাতালে কিম্বা চিকিৎসকের চেম্বারে গিয়ে প্রচুর হাবভাব নেয়। যেমন পঞ্চায়েত প্রধান, কাউন্সিলর, পাড়ার উঠতি নেতা, সিন্ডিকেটের দাদা, ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি প্রমুখ। এরা চায় আগে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সমস্ত রোগীকে ফেলে ডাক্তারবাবু তাকে কিম্বা তার পরিবারের অসুস্থ কাউকে আগে দেখে দিক। ডাক্তারবাবুর চেম্বারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এরা সুযোগ পেলেই প্রেশারটা চেক করিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখিয়ে নেয়। বলা বাহুল্য পুরোটাই ফ্রিতে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে অপারেশনের পর রোগী খারাপ হয়ে গেলে এরাই সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
৫) কনভার্টেড ক্যাচ কেস:
এক্ষেত্রে রোগী ক্যাচ ছাড়াই ভর্তি হয়। কিন্তু দু’দিন পর হঠাৎ ডাক্তারবাবুর মোবাইলে কোনো নেতা বা মন্ত্রী ক্যাচ মেরে বলেন, “ডাক্তারবাবু তিনশো চারের পেশেন্টটাকে একটু দেখবেন।” যে তিনশো চারের বাড়ির লোক দু’দিন আগেও কাঁচুমাচু মুখ করে “হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, না ডাক্তারবাবু” বলছিল হঠাৎ করেই তাদের দাপট বেড়ে যায় এবং ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। পেশেন্ট পার্টি হিসেবে এরা খুবই বিরক্তিকর এবং নটোরিয়াস হয়।
৬) স্পেশাল ক্যাচ কেস:
এঁরা সাধারণতঃ সরকারি উঁচুপদে চাকরি করেন কিম্বা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি হন। যেমন সরকারি আমলা, থানার বড়বাবু, স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষক বা প্রফেসর, স্থানীয় ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, লায়ন্স ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, মানবাধিকার কমিশনের লোক, নারীকল্যাণ সমিতির পদস্থ কর্ত্রী প্রমুখ। এঁরাও চান ডাক্তারবাবু তাঁকে কিম্বা তাঁর রোগীকে সবার আগে বিশেষ যত্ন নিয়ে দেখুক। মোটামুটি সকলেই চিকিৎসকের পারিশ্রমিক দিয়ে দিলেও রোগী হিসেবে এঁরা বিশেষ সুবিধার হ’ন না।
৭) সেলিব্রিটি ক্যাচ কেস:
কোনো ক্রিকেটার, কোনো অভিনেতা, কেন্দ্র বা রাজ্যের কোনো মন্ত্রী, কোনো খ্যাতনামা সাহিত্যিক, শিল্পী কিম্বা শিল্পপতি প্রমুখেরা যদি রোগ বাঁধিয়ে আসেন তখন তাঁকে সেলিব্রিটি ক্যাচ কেস বলে। ডাক্তারবাবুদের নাস্তানাবুদ করার জন্য এমন একজন রোগীই যথেষ্ট। দিনের মধ্যে একাধিকবার মেডিক্যাল বোর্ডে হাজিরা দেওয়া, মেডিক্যাল বুলেটিন প্রকাশ করা, প্রেসের সামনে বিবৃতি দিতে দিতে জীবন জেরবার। রোগী সুস্থ হয়ে গেলে ডাক্তারবাবুকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। খ্যাতির বিড়ম্বনায় নাওয়া-খাওয়া ভুলতে বসেন তিনি। কিন্তু ঘেঁটে গেলে সেই দুঃস্বপ্ন বহুকাল তাড়া করে বেড়ায়।
*************************************************
এরা ছাড়াও আরেক ধরনের রোগী আছে যাদের কোনো ক্যাচ নেই, যাদের মাথার উপর কোনো নেতা-মন্ত্রীর হাত নেই। এরা ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে একটা কাপড়ের পুঁটলিতে শুকনো মুড়ি বেঁধে ফার্স্ট লোকাল ধরে শহরের হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে আসে। সরকারি হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে মাত্র তিন মিনিটের জন্য ডাক্তারবাবুর দেখা পায়। বেসরকারি হাসপাতালের বিল মেটাতে গিয়ে গরু-ছাগল, জায়গা-জমি বিক্রি করে। ওষুধ কেনার সময় তিন পকেটের টাকা এক জায়গায় করেও বৌয়ের আঁচলে বাঁধা আটভাঁজ করা শেষ নোটটা বার করতে হয়। তবুও ডাক্তারবাবুর পারিশ্রমিক ফাঁকি দিয়ে কোনোদিন পালিয়ে যায় না। রোগ সেরে গেলে অনেকেই আবার খুশি হয়ে ডাক্তারবাবুর জন্য গাছের নারকেল, মাচার লাউ আর পোষা হাঁসের ডিম নিয়ে আসে। সত্যিই কী বিচিত্র এই সংসার!
দারুন লিখেছেন