দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ৩২
প্রতিদিন ওদের সংখ্যাটা বাড়ছে… বাড়ছে, বাড়ছে… বাড়তেই থাকছে। মাঠের লক্ষ্মী থেকে গেছে মাঠে.. অকাল বৃষ্টিতে ডুবে গেছে বিঘের পর বিঘে ধান। আলু গাছের গোড়ায় জল জমে শেষ হয়ে গেছে একের পর এক স্বপ্ন । ঋণ করে চাষ করেছিলেন কেউ। কেউ আবার চাষ করেছেন বাড়ির মা জননীর গয়না বন্ধক রেখে। চেম্বারে আসছেন রোজ এরকম মানুষ। মানসিক অবসাদ, প্যানিক অ্যাটাক বাড়ছে। ‘ডাক্তারবাবু একটু বিষ লিখে দিতে পারেন, বিনা কষ্টে মরতে পারি যাতে।’ বলে কেঁদে ফেলছেন আশি পেরোনো সম্পন্ন চাষী। এই বয়সেও নিয়ম করে মাঠে যান। হাতের তালুর মত চেনেন এক একটা মাটির কণা।
বছর চব্বিশের ইউনূস আলীর গোটা পরিবার আমায় দেখাতে আসে। বাড়িতে বৃদ্ধ মা বাবা আছে। প্রেসার সুগারের রোগী। বাবার প্রস্টেটের সমস্যা। সঙ্গে করে নিয়ে আসে ইউনূস। কাল ইউনূসকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ওর বাবা। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, ঘাম দিচ্ছে, বুক ধড়ফড় করছে। কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম দেড় লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে আলু চাষ করেছিল ইউনূস। গত পাঁচটা দিন দু চোখের পাতা এক করেনি সে। ইউনূসদের কথা কেউ লেখে না। কেউ বলে না। কৃষি আইন ভালো না খারাপ জানে না ইউনূস। ক্যাটরিনা ভিকির বিয়েতে কত রকমের ডাল হয়েছে সে খবর নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। সে মাটি চেনে। মানুষ বেইমানি করে, মাটি করে না। জানে ইউনূস, জানে, তার বাবা। বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল বেড়িয়ে আসে। অন্যদিকে ফেস শিল্ড আর মাস্ক-এর আড়ালে লুকিয়ে থাকা আরো এক জোড়া চোখ ভিজে আসে জলে। দেখতে পায় না কেউ, জানতে পারে না।
ঠাকুমার হাত ধরে মাঠে যেত ছেলেটা। আলু মাঠ, ধান মাঠ, ধান কাটা, রোয়ানো, ধান ঝাড়া, ‘পালুই’, ‘কুটিতে ডিগবাজি’, আলু তোলা, মাঠেই আলু পোড়া খাওয়া এসব এক ঝলকে ভেসে ওঠে চোখে। ইউনূসের মত এই ছেলেটাও স্বপ্ন দেখতো কোনো এক সময় – মরাই ভর্তি ধানের স্বপ্ন।
পেশার টানে বহু বছর পা দেওয়া হয়নি আলু জমিতে। ঠাকুমা গত হয়েছেন অনেক বছর। বস্তা বস্তা বই, পার্ট সেমিস্টার এম বি, নাইট ডিউটি, ইমারজেন্সি, আসতে আসতে পৌঁছে দিয়েছে অন্য এক জগতে। মানুষের নাড়ি দেখতে শেখার আশায়, মাটির নাড়ি দেখতে শিখে উঠতে পারিনি কোনো দিন। মন খারাপ হয়, হতাশ লাগে, ইউনূসদের কথা মনে পড়ে। ভয় হয় – মাটির থেকে দূরে চলে যাচ্ছি না তো?
উত্তর আসে না …
ইউনূসকে ওষুধ দিলাম, ফিজটা হাতে ধরিয়ে বললাম যেবার ভালো ফসল হবে, এক কেজি ধান বা আলু নিয়ে এসো আমার জন্যে। ইউনূসদের থেকে টাকা নিতে পারি না আমি। সেই মুহূর্তে মনে হয় আমারই জমির কথা। হয়তো ইউনূসের জায়গায় আমিই থাকতে পারতাম। বৃদ্ধ বাবার হাত ধরে ভরসা দেওয়ার সুরে বলি – কিছু হবে না আপনার ছেলের, আমি তো আছি।
আল্লাহ-র কাছে আমার জন্যে দোয়া করে বাপ পোয়। ভরসা পান বয়স্ক মানুষটা।
শুধু ভরসা পায়না আমার মন। চলে যায় ইউনূস, ঋণী করে যায় আমায়… চোখ খুলে স্বপ্নের দেশে চলে যায় সেই ছেলেটা… পরের বছর খুব ভালো ফলন হবে আলুর, ভরে উঠবে গ্রামের একের পর এক মড়াই, ঝলমল দিনে নবান্ন, লক্ষ্মী পুজোতে ইউনূসদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে যাবে একটা ছেলে – যে মাটির পালস্ দেখা শিখতে পারে নি কোনোদিন…..