৬ আগস্ট ১৯৪২ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরের ইহুদি ঘেটোতে উপস্থিত মানুষজন এক অদ্ভুত এক দৃশ্যের সাক্ষী ছিল। ১৯৫ জন অনাথ বালক-বালিকা লাইন করে রাজপথ ধরে চলছে। প্রত্যক্ষদর্শী ইরিনা স্নেলদেরোয়ার ভাষায়, “বাচ্চাদের গায়ে ছুটির দিনে বেড়াবার সবচেয়ে ভালো জামা কাপড়, নীল ডেনিমের ইউনিফর্ম, হাতে ছোট পুঁটুলি, চারজনের পেছনে চারজন- এই ভাবে প্রায় মার্চ করার ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে তারা, ছন্দোবদ্ধ ভাবে, সারি দিয়ে। লাইনের এক্কেবারে শুরুতে কোরচাক। একহাতে তুলে নিয়েছেন একটি বাচ্চাকে আর অন্যহাতে ধরে রেখেছেন আরেকটি বাচ্চার হাত”
এটুকু পড়ে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, কে এই কোরচাক, বাচ্চাগুলোই বা সেদিন লাইন করে কোথায় যাচ্ছিল। জার্মানি অধিকৃত পোল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকা নাৎসি বাহিনী ওই বাচ্চাগুলোকে পাঠাচ্ছিল বন্ধ খুপরির রেলগাড়ি চড়ে কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ট্রেবলিংকায়, সেই মৃত্যুপুরী যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। বাচ্চাগুলির অপরাধ তারা জাতে ইহুদি। তাদের অনাথ আশ্রমের পরিচালকের নাম ইয়ানুস কোরচাক। পেশায় শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ কোরচাক পাকেচক্রে হয়ে যান শিক্ষাবিদ, প্রচারক এবং অনাথ আশ্রম পরিচালক যাঁর প্রকৃত নাম হেনরিক গোল্ডস্মিথ।
ইউরোপ খ্যাত ইন্টেলেকচুয়াল ইহুদি হিসেবে নাৎসি বাহিনী তাঁকে ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল, উনি ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি শেষ মুহুর্তে এক নাৎসি কমান্ডার তাঁকে সনাক্ত করে জনপ্রিয় শিশুপাঠ্য বইয়ের লেখক হিসেবে, যে বইয়ের গুণমুগ্ধ পাঠক তার নিজের ছোট্ট মেয়ে এবং সেই মুগ্ধতায় ডঃ কোরচাকের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে। কোরচাক রাজি হন নি।
প্রত্যক্ষদর্শী ইরিনা সেদিনের সেই মৃত্যু মিছিল নিয়ে এরপরে লিখছেন, “বাচ্চাগুলোর একজনও ভয় পায় নি। মাথা উঁচু করে তারা মৃত্যু-চক এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাদের হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছিল কিছুদিন আগেই তাদেরই অভিনীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই নাটক ডাকঘরের অমলের কথা।”
হ্যাঁ সুধী পাঠক, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। ফ্যাসিস্ট নাৎসি বাহিনীর অবর্ণনীয় অত্যাচারের সেই দিনগুলোতে শিশুদের মনোবল চাগিয়ে রাখতে কোরচাকের পরিচালনায় ওই অনাথ আশ্রমে নাটক অভিনীত হত। ১৮ জুলাই ১৯৪২, মঞ্চস্থ হয় “ডাকঘর”, পোলিশ ভাষায় “পোচতা”। রবীন্দ্রনাথের সেই অমল আর দইওয়ালার সংলাপ গেঁথে যায় শুধু অভিনেতা নয়, দর্শক শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত শিশুগুলির মনে। অসহায় শিশুরা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে তাদেরও শিগগির পাড়ি দিতে হবে সেই পাঁচমুড়ো পাহাড়ের নিচে, শ্যামলী নদীর ধারে। তাই কদিন বাদেই সেই মৃত্যু মিছিলে তারা কেউ কান্নাকাটি করে নি, অমলের মতোই মর্যাদার সাথে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিল, ভয় ছিল না, আতঙ্ক ছিল না।
হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনী যাদের প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল ওই ভয়, আতঙ্ক, তারা সেদিন রণসাজে সজ্জিত হয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল যে তাদের অমোঘ অস্ত্র কি ভাবে ভোঁতা করে দিচ্ছে চশমাধারী নিরস্ত্র দুবলা পাতলা এক পেডিয়াট্রিশিয়ান যার হাতিয়ার হাজার হাজার মাইল দূরের এক বাঙালি কবি নাট্যকারের লেখা একটা নাটক।
সেই শিশুর দল বা ডঃ কোরচাক, কেউ আর বেঁচে ফেরেনি। কিন্তু পৃথিবীর বুকে ফ্যাসিস্টদের স্বৈরাচারী দাপাদাপির পাশাপাশি চিরকালের মতো লেখা থাকবে তাদের ওই লজ্জাজনক পরাজয়ের কাহিনী।
ভয়কে জয় করা যায়। আমাদের রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে গেছেন, মৃত্যুভয়কেও জয় করা যায়। এমন কি শিশুরাও পারে যদি তাদের জন্য ডঃ কোরচাকের মতো একজন শিক্ষক থাকেন, যদি অমলের জন্য থাকে একজন সামান্য দইওয়ালা। হ্যাঁ, ফ্যাসিস্টদের হারানো যায়।