আমাদের গ্রামের একদম শেষে নদীর ধারে ছিল শ্মশান। তার গায়ে ছিল গা ছম ছম করা বাঁশ বাগান। একটা ছোট্ট পুকুর, যার জল চিতার আগুন নেভাতে এবং দাহ কাজের পরে চান করতে ব্যবহৃত হয়, যেখানে ‘ঠিক দুপুর বেলা ভুতে মারে ঢ্যালা’। আর রাতেরবেলা। রাতের কথা না বলাই ভালো, সেটা আমাদের কাছে তখন এক ভয় জাগানো নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে যেত। তবে তার সামনে একটা ছোট্ট মাঠ ছিল। বিকেলে শ্মশানের সেই মাঠে আমরা দলে ভারী হয়ে সাহস করে ফুটবল খেলছি। বয়স তখন ওই দশ এগারো হবে। ফুটবল মানে বল নিয়ে ছুটে উল্টোদিকে বাঁশ দিয়ে তৈরি তিনকাঠির মধ্যে ঢোকাতে পারলে গোল। আমরা ছুটলে উল্টোদিকের দল বল কেড়ে নিয়ে আমাদের গোলে মারার চেষ্টা করবে। নাহলে আমরা মারব। খুব সরল খেলা। তবে ওই ছোটাছুটি ধাক্কাধাক্কি চোট এগুলো তো লেগেই আছে। আর ভীতু আমি গা এবং পা বাঁচিয়ে যতটুকু পারি বলে লাথি মারতাম।
এর মধ্যে খবর পেলাম ‘পেলে’ নামে একজন খেলোয়াড় আসছে তার দলবল নিয়ে। এবং সে নাকি পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়।
সেই সময় যুগান্তর না অমৃতবাজার পত্রিকা ঠিক মনে নেই, পেলে সম্পর্কে ধারাবাহিক রোজ লেখা বেরতে লাগল। একমাস ধরে। ব্রাজিলের অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলে ন্যাকড়ার বলে লাথি মেরে খেলা শিখে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সব থেকে বড় ব্যাপার তার অসাধারণ স্কিল আর গোল করার বর্ণনা। সব বুঝেছিলাম তা নয়। খালি একটা জিনিস মনে হয়েছিল। এভাবেও ফুটবল খেলা যায়!
সেই আজ থেকে প্রায় ছেচল্লিশ বছর আগের অজ পাড়া গাঁ গোপালপুরেও তার খেলার ঢেউ পৌঁছেছিল। আমার এক জাঠতুত দাদা খেলা পাগল ছিল। আর ছিল হুজুক। এবং সে ছিল চৌকস। কলকাতায় যাতায়াত আছে। অনেক কিছু জানত টানত। বলল টিভিতে পেলের খেলা দেখাবে।
টিভি আবার কি বস্তু? যা বুঝলাম। সিনেমার মত সব চলমান ছবি দেখা যায়। তবে এক্ষেত্রে মাঠের খেলা সরাসরি এই বাক্সটার মধ্যে দিয়ে দেখা যাবে।
আমাদের গ্রাম থেকে ভালো চাকরি পেয়ে দমদমে চলে গেছে এক কাকু। তার বাড়িতে টিভি আছে। তিন ঘন্টার রাস্তা। কুছ পরোয়া নেহি। দাদা বলল তোকে নিয়ে যাবো। টিভিতে দেখব। পেলে বল নিয়ে ছুটবে। গোল করবে। ওঃ। কি উত্তেজনা। কিন্তু আমার জন্যে আরো একটা বড় চমক অপেক্ষা করছিল।
সকাল সকাল রেডি হয়ে মালতিপুর স্টেশানে। কু ঝিক ঝিক কয়লা ইঞ্জিনের ট্রেনে দমদম।
গিয়ে দেখলাম ভালোই লোক জমেছে। একটা বেশ বড় ঘরে সতরঞ্চি পাতা। আর তার শেষ প্রান্তে সেই আশ্চর্য জিনিস ‘টিভি’ রাখা আছে। একটা বাক্সের মত জিনিস চারটে পায়ার ওপর। সামনেটা পেটমোটা কাঁচ।
খেলার আগে অ্যাড , বিশেষজ্ঞ মতামত শুনে এবং দেখে কিছুটা ধাতস্ত হলাম টিভি দেখা নিয়ে। তারপর খেলা শুরু হোলো।
এবং পেলে। প্রথম থেকেই বারবার ক্যামেরা ফোকাস করেছে। অবাক বিস্ময়ে বাক্সটার মধ্যে দেখলেও ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। লেখায় পড়ে হরিণ গতির অনবদ্য নায়কের যে ছবি আঁকা ছিল মনের মধ্যে তার সাথে এই মাঝবয়সী মানুষটাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না।
টিভি না খেলা কোনটা বেশি দেখছিলাম, মনে নেই। মনে আছে পেলে বিশেষ কিছু খেলতে পারেনি। একটা দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে গোল কিপার শিবাজী ব্যানার্জি ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুয়ান পেলের পা থেকে একটা বল তুলে নিচ্ছে। পেলে লাফিয়ে শিবাজীর মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। খুব ভালো লেগেছিল। আমাদের শ্মশানের মাঠে তো গোলকিপারের গায়ে পা লাগাবেই স্ট্রাইকার এই সময়। আর সেটা লাথি না ভুল করে লেগেছে, তা নিয়ে প্রচন্ড ঝগড়া হবে।
হাবিব, আকবর, শ্যাম থাপা, সুব্রত এরাও তো আমার নায়ক। আর টিভির কল্যাণে এরাও চোখের ওপর। তাই সেদিনের মোহনবাগানীদের খেলাতে মনোযোগ দিলাম। দারুন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। জিততে জিততে ২-২ ড্র। কেউ কেউ বলল গট আপ করে পেলের দলকে ড্র করা্নো হোলো।
খেলা শেষ। সব দর্শক আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। আমি আর দাদা তখনো বসে আছি। কারণ সেই কাকু কাকিমারা গল্প করছে। এবার প্লেটে করে সন্দেশ এল, দেশের লোকের খাতিরে। খিধেও পেয়েছিল। এবার আর এক চমক। পট করে একটা তুলে মুখে দিতেই, উরেব্বাস দাঁত কনকন করে উঠল। মিষ্টি খেয়ে দাঁতে পোকা লাগে জানতাম কিন্তু ঠান্ডায় দাঁত উপড়ে পড়ার অবস্থা হয় জানা ছিল না।
দাদার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম কি ঠান্ডা! দাদা চাপা গলায় কি একটা বলল ঠিক বুঝিনি।
আসার পথে ঠান্ডা সন্দেশ রহস্য উদ্ধার হোলো। ট্রেনে ফ্রিজ নিয়ে দাদার নাতিদীর্ঘ ভাষণ শুনে। ওইটা ছিল আমার কাছে শুধুই বিস্মিত হবার দিন। একই দিনে পেলে, টিভি এবং ফ্রিজ!
ঠাণ্ডা সন্দেশ খেলে কিস্যু অয় না।
আমি খেয়েছিলাম ঠাণ্ডা রসগোল্লা। সেই রসগোল্লা আমার দাঁতের চারদিকে জমে গেল। অক্সি এসিটিলিন ফ্লেমেও গলল না।
সেই থেকে আমার সুইট টুথ।