নিতান্তই স্বগতোক্তি ভাবতে পারেন, যাঁরা ভাবতে ভালোবাসেন তাঁরাই পড়ুন, যাঁদের খেয়েদেয়ে কাজ আছে, তাঁরা এড়িয়ে যান।
একটু নিরপেক্ষ ভাবে ভাবলে আজ আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সত্যিই একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভগবান না করুন, কিন্তু যদি আজ আমার কোনো নিকট আত্মীয়ের কিছু অঘটন হয়, আমি জানি না কোন হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হবে।
সরকারি হাসপাতালে বেড থাকবে কি থাকবে না ঠিক নেই, যদি বা তা জুটিয়েও ফেলি ওয়ার্ডে আরো শতাধিক রোগীর সাথে হয়তো খান দুই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে দিন কাটাতে হবে। এই ক্ষুদ্র জীবনে এটুকু আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে রোগী বেঁচে থাকে যত না স্বাস্থ্যকর্মীদের তৎপরতায়, তার চেয়ে ঢের বেশি ঈশ্বরের করুণায় আর রোগীর আত্মীয়দের যত্নে।
আর বেসরকারি হাসপাতালের হাবভাব আর নতুন কী বলবো!!! খুব জটিল রোগের চিকিৎসা বেসরকারি হাসপাতালে করানোর মতো আর্থিক সংস্থান আমার মনে হয় না খুব বেশি লোকজনের আছে!
আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে ডাক্তার সমাজের উপর এই ক্রমবর্ধমান বিতৃষ্ণার মূল কারণ এই অসহায়তা, অধিকাংশ মানুষই স্থির করে উঠতে পারেন না অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে কোথায় যাবেন!!
এখন জন্মাবধি আমি জেনে এসেছি, স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। শুধু জেনেই আসিনি, মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করেছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে স্বাস্থ্য জিনিসটা তো একটা সিস্টেম, এটা কারো একার হাতে তো নেই। যেমন আমি যদি কালই ঠিক করি, আমি আরো একশো জন ডাক্তার মিলে দেশের স্বাস্থ্যের চেহারাটাই বদলে দেব- এটা কিন্তু হওয়া সম্ভব না। যদিও স্বাস্থ্যক্ষেত্রের মুলকেন্দ্র একজন ডাক্তারই, কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিধি বিস্তর- স্বাস্থ্যকর্মী, অর্থ, প্রশাসনিক উদ্যোগ- অনেকগুলো স্তর যখন একসাথে কাজ করে, তখনই একটা সিস্টেম সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে।
সত্যি কথা বলতে কি, দেশের কোনো সরকারই যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হবেন, এই দুরাশা আমি বহু পূর্বেই ত্যাগ করেছি। কারণ স্বাস্থ্য কোনো গিমিক নয়, রাতারাতি ৩৭০ ধারা মানবো না, পাকিস্তানে ঢুকে বোম মেরে আসবো বা পাড়ায় দুর্গাপূজায় কয়েক হাজার টাকা ছুঁড়ে মারবো- এরকম টি-টোয়েন্টি সিস্টেমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়। যদি কিছু পরিবর্তন হয়, সেটা খুবই ধীরগতিতে অনেকদিনের প্রচেষ্টায় হবে- সুতরাং তাতে ভোট ব্যাংকে বিশাল কিছু প্রভাব পড়ার আশা কম। তাই যে কোনো সরকারই ডাক্তারদের মাথায় বন্দুক রেখেই দিন কাটাবেন।
সুতরাং সরকার বাদ গেল, ডাক্তারদেরও খুব বেশি কিছু করণীয় আছে বলে মনে হচ্ছে না- যদি কিছু করতে হয়, এবার সাধারণ মানুষকেই করতে হবে। সেটা সম্ভব হবে তখনই যখন একটা স্বাস্থ্যচেতনা তৈরি হবে, আর সেটা হওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর কী হতে পারে!
চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন। সরকারি হাসপাতালে আপনার জন্যে কেউ বসে নেই। সরকারি হাসপাতালগুলো সরকার শুধু ব্যবহার করছে নিজের প্রতিপত্তি দেখানোর স্বার্থে- সেখানে সাধারণ মানুষের যেটুকু উপকার হচ্ছে, সেটা নেহাতই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বলা যায়। ওই আউটডোরে হাজার রোগীর ভিড়ে ডাক্তার ২ মিনিটে আপনার রোগের কতটুকুই বা বুঝছেন! নিজেদের স্বাস্থ্যের মর্যাদা দিন, এই নিত্যদিনের নাটকের বিরুদ্ধে সরব হন।
অন্যদিকে সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে এত সরকারি আমলাদের প্রভাব হয়ে পড়েছে যে সেখানে সুস্থ মনের কোনো ডাক্তারের থাকা আর সম্ভব নয়। প্রাক্তন যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের এক সময় না এক সময় অবসর দিতে বাধ্য হবে সরকার- এই ধারা অব্যাহত থাকলে বছর দশেক পর সরকারি হাসপাতালে কোনো ভালো ডাক্তার থাকবে বলে আমার মনে হয় না।
তাহলে এখন উপায়? অনতিলম্বে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর সমস্ত রাজনৈতিক প্রভাব খণ্ডন করতে হবে। আর সব চেয়ে বড় কথা মানুষকে ডাক্তারদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। এই ডাক্তার পিটিয়ে মেরে ফেলে, আপনারা মেঘের আড়ালে যে একফালি আলোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল, সেটাও নিভিয়ে ফেলছেন। আজ আপনারা যদি পাশে না দাঁড়ান, এই স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল কোনোদিনই ফিরবে না।
দেশের সবচেয়ে গরিব লোকটার জন্যেও উচ্চমানের চিকিৎসার ব্যবস্থার প্রতিজ্ঞা আমাদের নিতেই হবে। তার জন্যে যতদূর যেতে হবে, যা করতে হবে- আমরা যেন সেটা করতে পিছিয়ে না পড়ি।
সময়োপযোগী লেখা। ধন্যবাদ।