তাড়াহুড়ো নয়, বরং নিয়ম মেনেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালো ফাইজারের সম্ভাব্য ভ্যাক্সিন
…………………………………………………
বিশ্বে এখন পর্যন্ত মোট ২১৫টি দেশের প্রায় ২.৩৩ কোটি মানুষ নোভেল করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত এবং ৮ লক্ষ মৃত। সারা পৃথিবীর মানুষ তাই অধীর আগ্রহে ভ্যাক্সিনের প্রতীক্ষায়।
এর মধ্যেই গত ১১ই অগস্ট বিশ্বের প্রথম কোভিড -১৯ ভ্যাক্সিন, ‘স্পুটনিক-৫’-এর অনুমোদন দিয়েছে রাশিয়া। স্বভাবতঃই, সকলেরই জোরদার কৌতূহল রয়েছে এই ভ্যাক্সিনটির বিষয়ে, যদিও সে কৌতূহল মেটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, একমাত্র ঐ নির্দিষ্ট গবেষণার সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীরা ছাড়া বোধহয় কারো কাছেই ভ্যাক্সিনটি সন্বন্ধে বিশেষ কোনও তথ্য নেই। সরকারিভাবে অবশ্য দাবি করা হয়েছে যে, ভ্যাক্সিনটির কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সমস্ত কিছুই নাকি পরীক্ষিত!
অথচ, কার্যক্ষেত্রে এটি এখনো হিউম্যান ট্রায়ালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় ধাপটিই পেরোয়নি। আগের ধাপের ফলাফলগুলিরও কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না।
আদতে কিন্তু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের এই থার্ড ফেজ বা তৃতীয় ধাপটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দফাতেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর (যেমন, এশিয়ান, ককেশিয়ান, আফ্রিকান ইত্যাদি) ও বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে দেখা হয়, ভ্যাক্সিন নিয়ে তারা আসল সংক্রমণের মোকাবিলা কতটা করতে পারছে? ভ্যাক্সিন নিয়েও ভাইরাসের দ্বারা সংক্রামিত হচ্ছে, না কি সুস্থ হয়ে উঠছে?
এই পরীক্ষাটি করার সময় জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ পান সত্যি ভ্যাক্সিনটি (true candidate), আর কিছু মানুষকে ভ্যাক্সিনের বদলে দেওয়া হয় শুধুমাত্র স্যালাইন বা প্রমাণিত নিরীহ ভ্যাক্সিন (প্লাসিবো)। স্বেচ্ছাসেবীদের কিন্তু জানানো হয় না কে সত্যি ভ্যাক্সিন পেলেন আর কে পেলেন না। এমনকি যাঁরা তাঁদের শারীরিক অবস্থার পরীক্ষা করে নথিবদ্ধ করেন, তাঁরাও জানতে পারেন না কে ভ্যাক্সিন গ্রুপের আর কে প্লাসিবো গ্রুপের! বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয়, ‘প্লাসিবো কন্ট্রোল্ড ডাবল ব্লাইন্ড র্যান্ডমাইজড ট্রায়াল’। এর আগের দুটি পর্যায় অবধি পরীক্ষাগুলি কিন্তু ‘সিঙ্গল ব্লাইন্ডেড’ প্রকৃতির অর্থাৎ, শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবীরা জানবেন না, কিন্তু পরীক্ষকেরা জানবেন। পরীক্ষার ফলাফলে পক্ষপাতদুষ্টতা বা বায়াসনেসের প্রভাব এড়াতেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তৃতীয় পর্যায়টিতে, ভ্যাক্সিন কিংবা প্লাসিবো নিয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা মহামারী পরিস্থিতিতে মিশে যান সাধারণ জনগোষ্ঠীতে। উদ্দেশ্য এটা দেখা যে, যারা ভ্যাক্সিন পেয়েছেন তাদের মধ্যে সংক্রমণ, যারা প্লাসিবো পেয়েছেন তাদের তুলনায় রাশিবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে উল্লেখযোগ্য ভাবে কম কি না।
এইবার, এইখানে অনেকগুলো অবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা।
১. প্লাসিবো আর ভ্যাক্সিন গ্রুপের মধ্যে কারোরই সংক্রমণ হলো না: গোষ্ঠীতে অতিমারির প্রকোপ কমে গেছে। এক্ষেত্রে, ভ্যাক্সিনের ক্ষমতা পরীক্ষিতই হতে পারলো না।
২. প্লাসিবো আর ভ্যাক্সিন গ্রুপের মধ্যে সমান সংক্রমণ: পরীক্ষিত ভ্যাক্সিনটি ব্যর্থ।
৩. ভ্যাক্সিন গ্রুপের চেয়ে প্লাসিবো গ্রুপে সংক্রমণের হার বেশি:পরীক্ষিত ভ্যাক্সিনটি সম্পূর্ণ সফল।
৪. প্লাসিবো গ্রুপের চেয়ে ভ্যাক্সিন গ্রুপে সংক্রমণের হার বেশি হলো, এমনকি তাদের প্রাণ সংশয় অবধি হয়ে গেল! শুনতে অবাক লাগলেও এরকমটাও হয়। আর এটাই ভ্যাক্সিন ডেভেলপমেন্টের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একে বলা হয় Antibody Dependent Enhancement (ADE) effect। অতীতে বহুবার এরকমটি ঘটেছে। কেন এমনটি হয়, সে আলোচনা আজ নয়। বরং যেটা বলার সেটা হল, রুশ গবেষকেরা পরীক্ষার এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ধাপটি শুরু করে উঠতে পারার আগেই সরকারী তরফে ভ্যাক্সিনের শর্তসাপেক্ষ অনুমোদন দেওয়া হয়ে গেছে।
আসলে, এই মূহুর্তে গোটা পৃথিবী জুড়ে দেড়শোরও বেশি ভ্যাক্সিন ক্যান্ডিডেট ট্রায়ালের বিভিন্ন ধাপে দাঁড়িয়ে আছে। স্বভাবতই শুরু হয়েছে এক তীব্র রেষারেষি, কে ভ্যাক্সিন তৈরিতে প্রথম হবে, কেই বা দ্বিতীয়! নিয়মনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কোনও কোনও দেশে এরকম ভাবে অনুমোদন পাওয়া সম্ভব হলেও বিশ্বের দরবারে এইসব ভ্যাক্সিনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিঃসন্দেহে কম হতে বাধ্য।
এর আগে, অক্সফোর্ড-এর ChAdOx1 nCoV-19 ভ্যাক্সিন-এর প্রাথমিক ধাপের ফলাফল ‘ল্যানসেট’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। আর এবার ভ্যাক্সিনের ইঁদুর দৌড় থেকে দূরে বরং খানিক নিঃশব্দেই বিজ্ঞানের নিয়মকানুন মেনে হিউম্যান ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে ঢুকে পড়লো ফাইজারের একটি ভ্যাক্সিন। ফাইজার এবং বায়োনটেকের মিলিত এই প্রোজেক্টে পরীক্ষিত হচ্ছে মোট ৪টি ভ্যাক্সিন। অতি সম্প্রতি এদের একটি সম্ভাব্য প্রতিষেধক, BNT162b1 -এর প্রাথমিক (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের) পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানের অন্যতম সেরা জার্নাল ‘নেচার’-এ। আসুন, দেখে নেওয়া যাক, কী জানা গেল পরীক্ষায়? কতটা আশার আলো দেখছেন বিজ্ঞানীরা? সীমাবদ্ধতাগুলিই বা কি রয়েছে?
এই BNT162b1 সম্ভাব্য প্রতিষেধকটি আসলে একটি মডিফায়েড মেসেঞ্জার আরএনএ (modRNA) ভ্যাক্সিন। এটি SARS-CoV-2 ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেনের বা RBD-এর সংকেত বহন করে, যা ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয়কারী অ্যান্টিবডির প্রধান টার্গেট। ভ্যাক্সিনটিকে দেহের মধ্যে কার্যকর উপায়ে ঢোকাবার জন্য এর mRNA টিকে লিপিড ন্যানো পার্টিক্যালে (১-১০০ ন্যানোমিটার সাইজের অতিক্ষুদ্র কণা) মুড়ে ইন্টার মাসকুলার ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, RNA ভ্যাক্সিনের কিছু সুবিধে রয়েছে। প্রথমত, প্রোটিন সংশ্লেষের জন্য প্রয়োজনীয় এই উপাদানটি জিনের মধ্যে ঢুকে নিজের সংযুক্তিকরণ করে না এবং সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানবদেহ থেকে খুব সহজে নির্গত হতে পারে। তাই এরা যথেষ্ট নিরাপদ। দ্বিতীয়ত, RNA ভ্যাক্সিন বলিষ্ঠ ও সহজাত অনাক্রমতা প্রদান করে। তৃতীয়ত, এজাতীয় ভ্যাক্সিন খুব দ্রুত ও প্রচুর পরিমানে উৎপাদন করা সম্ভব।
এবছরের ৪ মে থেকে ১৯ জুন, এই দেড় মাস সময়ের মধ্যে ১৮-৫৫ বছর বয়সী ৪৫ জন সুস্থ স্বেচ্ছাসেবককে BNT162b1 ভ্যাক্সিনটি প্রয়োগ করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে ৫১.১% পুরুষ এবং ৪৮.৯% মহিলা।
স্বেচ্ছাসেবকদের তিনটি বারো জনের এবং একটি নয়জনের এইভাবে মোট চারটি দলে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম দুটি দলকে ১০ ও ৩০ মাইক্রোগ্রাম ডোজে ১ম ও ২১তম দিনে মোট দুবার ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় দলটিকে ১০০ মাইক্রোগ্রাম ডোজে কেবলমাত্র একবারই ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ দলটিকে শুধু মাত্র প্ল্যাসিবো দেওয়া হয়েছে।
ভ্যাক্সিনটি প্রয়োগের প্রথম সাতদিন অবধি
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলাফল বিশ্লেষণ করে
দেখা গিয়েছে যে, অধিকাংশ ভ্যাক্সিন-প্রাপকদের মধ্যেই সেরকম গুরুতর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়নি। সামান্য মাথাব্যথা, ক্লান্তি, কাঁপুনি, পেশি ও অস্থি-সন্ধিতে যন্ত্রণা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা গেছে। ডোজের পরিমান ও সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে যদিও উপসর্গগুলি সামান্য বেড়েছে, কিন্তু মোটের উপর এই জাতীয় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি সবকটিই ছিল সাময়িক।
১০ ও ৩০ মাইক্রোগ্রামের উভয় গ্রুপেই প্রথম ডোজটি নেবার পরে ৮.৩% ব্যক্তির জ্বর (>=৩৮°সেলসিয়াস) এসেছে। ১০০ মাইক্রোগ্রাম ডোজ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে এই সংখ্যাটিই ৫০%।
দ্বিতীয় ডোজটি নেবার পরে ১০ মাইক্রোগ্রাম গ্রুপের ৮.৩% ব্যক্তির এবং ৩০ মাইক্রোগ্রাম গ্রুপের ৭৫% ব্যক্তির জ্বর এসেছে, যা অবশ্য একদিনেই সেরে গেছে। ১০০ মাইক্রোগ্রাম গ্রুপের ব্যক্তিদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলতা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায় দ্বিতীয় বুস্টার ডোজটি দেওয়া হয় নি।
এবার আসা যাক প্রতিষেধক প্রয়োগের পর
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত ফলাফলে। ভ্যাক্সিনের প্রথম ডোজ প্রয়োগের ২১ দিন বাদে রক্তে RBD বাইন্ডিং IgG অ্যান্টিবডির উপস্থিতি যথেষ্টই আশাব্যঞ্জক। দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগের ৭দিন বাদে তা আরও বেড়েছে। দেখা গেছে, করোনা আক্রান্তের সেরামে রোগ ধরা পড়ার ১৪ দিন পরে যে মাত্রার অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তার তুলনায় এই বৃদ্ধি প্রায় ৮-৫০ গুণ। এখন, প্রকৃত ভাইরাসের আক্রমনে এই ভ্যাক্সিন ঠিক কতটা মোকাবিলা করতে পারছে তা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী ধাপের পরীক্ষার ফল আসা অবধি।
এখনও যদিও বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বাকি। যেমন–
১. দ্বিতীয় ডোজটি প্রয়োগের দু’সপ্তাহের বেশি সময়ের রোগ-প্রতিরোধক প্রতিক্রিয়া ও সুরক্ষার ফলাফল জানা নেই। যদিও গবেষকেরা আগামী ৬ মাস থেকে ২ বছর অবধি স্বেচ্ছাসেবীদের শরীরে ভ্যাক্সিন পরবর্তী প্রভাব নথিবদ্ধ করে চলবেন।
২. ১৮-৫৫ বছর বয়স সীমার মধ্যেই পরীক্ষাটি হয়েছে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিরাই সর্বাধিক সংক্রমণ প্রবণ। আগামীতে তাই ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বের মানুষের মধ্যে প্রতিষেধকটির কার্যকারিতা দেখা হবে।
৩. সব ধরণের জনজাতির উপর ভ্যাক্সিনটির প্রভাব দেখা হয় নি। মূলতঃ শ্বেতাঙ্গদের (৮২.২%) ওপরেই প্রতিষেধকটি প্রয়োগ করা হয়েছে।
৪. এছাড়াও, যেহেতু পরীক্ষাটির তৃতীয় ধাপের ফলাফল হাতে আসা বাকি, তাই এখনও জানা যায়নি দেহে প্রকৃত ভাইরাসের বিরুদ্ধে সেটি কেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা কত দিন অবধি স্থায়ী হবে?
তবে প্রথম দুই পর্বের অনাক্রমতা বিষয়ক সমস্ত ফলাফলগুলি বিশ্লেষণ করে দেখে আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে এই BNT162b1 প্রতিষেধকটি প্রকৃত ভাইরাসের আক্রমনের বিরুদ্ধেও কার্যকরী ও সুরক্ষিত প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।