ফুরকিয়ার ইগলুঃ
আজ বৃহস্পতিবার ১৭.১০.২০১৯। আমরা দ্বোয়ালী থেকে হাঁটা শুরু করলাম। গন্তব্য ৬ কিলোমিটার দূরে ফুরকিয়া(৩২৬০ মিটার)। সকালের মিঠে রোদ গায়ে মেখে চলতে শুরু করলাম। প্রথমটা একেবারে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ গাছের ডাল শব্দ করে দুলে উঠতে ওপরে তাকিয়ে দেখি হিমালয়ান লাঙ্গুর এক ডাল থেকে আর এক ডালে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে অনায়াসে। দুর্ঘটনাও ঘটে। ফিরে আসার দিন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছিলাম সদ্যমৃত এক লাঙ্গুরকে। টাইমিং ঠিক না হতে ডাল ধরতে পারেনি।
পাখিদের কিচির মিচির শুনছি। কখনো বা এক ঝলক রঙের বাহার বা ল্যাজ দেখিয়ে ক্যামেরাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। রাস্তা বেশিরভাগটাই চড়াই হলেও খুব কষ্টকর নয়। বড় বড় গাছের জঙ্গল থেকে বেরতে আস্তে আস্তে হিমালয় তার শ্বেতশুভ্র রূপ খুলতে লাগল। সামনেটা বিস্তৃত হতে লাগল আর পরপর দেখা দিতে লাগল তুষার ঢাকা শৃঙ্গ। এরপর এসে পৌঁছলাম একটা সবুজ মাঠে… জোয়ারপানি বুগিয়াল।দৃশ্য দেখে মোহিত হয়ে গেলাম।এক দিকে ধ্বসের চিহ্ন অন্যদিকে পিন্ডারি নদী বরাবর সবুজ পাহাড়। দূরে দেখা যায় নন্দাখাট পাহাড়। মাঝে সবুজ গালিচার জোয়ার পানি বুগিয়াল। এখানে কিছু ভাঙ্গাচোরা শেডের অংশ দেখে জিজ্ঞাসা করতে জানলাম ডিসেম্বর জানুয়ারিতে পড়া বরফের চাপে এরকম হয়েছে।
পৌঁছে গেলাম ফুরকিয়া। আজ রাতে এখানে আমাদের কে এম ভি এনের ইগলু হাটে থাকা। গোল গোল সাদা ইগলু প্যাটার্নের ঘরগুলো বেশ মজার। জানালা দরজা বন্ধ করে দিলে আর যেহেতু রঙটা সাদা, ইগলুই মনে হয়। ভালো ইন্সুলেশানের জন্যে ঠান্ডা কম। ভেতরে জায়গাও বেশি। স্যাক ট্যাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিন চারজন থাকা যায়।
এস্কিমোদের দেশে না যেতে পারলেও এখানে থেকে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম। দুপুরের পর থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল।তাই আমরা আসপাশটা ঘুরতে পারিনি। খাওয়া আর ঘুম। কাল ভোরে উঠে জিরো পয়েন্ট।
জিরোতে হিরোঃ
আজ ১৮.১০.২০১৯ শুক্রবার। আমরা ভোর ছটার মধ্যে রেডি হয়ে হাঁটতে শুরু করেছি। গন্তব্য ৭ কিলোমিটার দূরে পিন্ডারি জিরো পয়েন্ট (৩৬০০ মিটার)। আমাদের ট্রেকিং এর সামিট পয়েন্ট। অন্য দিনগুলো আমরা সাধারণত আটটার আসপাশে শুরু করতাম। আজ এত তাড়াতাড়ি শুরু করার কারণ, প্রত্যেক দিন মোটামুটি দুপুর একটার পর আকাশ মেঘলা হয়ে যাচ্ছিল। বৃষ্টিও হচ্ছিল। সকালে পরিষ্কার আকাশে আমরা জিরো পয়েন্ট যেতে চাইছিলাম।তাছাড়া আজ আমাদের ফিরে যেতে হবে দ্বোয়ালি। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার হাঁটা। তাই সন্ধ্যের অন্ধকার হবার আগে, বৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে ফিরতে গেলে তাড়াতাড়ি বেরনো দরকার ছিল।
এই রাস্তার বেশিরভাগটা খাড়া, কিন্তু খুব অসুবিধা হয় না। যেহেতু দশ হাজার ফুটের ওপর উঠে গেছি, ক্রমশ বড় গাছ কমে যাচ্ছে। তবে অন্য সৌন্দর্য। সবুজ মাঠ। তুষার শুভ্র পাহাড় শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। বলজুরি (৫৯২২ মিটার) শৃঙ্গ দেখলাম, যাবার পথে।
অনেক দূর থেকে আমাদের দেবেন্দার দেখাল তিন চারটে মোনাল, উত্তরাখন্ডের স্টেট বার্ড, ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কাছে যাবার আগেই পালালো।
শুরুতেই রাস্তার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া একটা ঝর্না পেরতে গিয়ে আছাড় খেলাম। জলে ডোবা পিচ্ছিল পাথরকে ততটা গুরুত্ব না দেওয়ার জন্য,এ টা ছিল সতর্ক বাণী। পাহাড়কে কখনো অবজ্ঞা না করতে বলা।
একটু বাদেই এল ধ্বসের জায়গা। গাইডের একটু সাহায্যে দিব্যি পার হয়ে গেলাম। তিনটে জায়গা। বেশ কনফিডেন্স বাড়ল। একবার ভাবলাম এর মধ্যে কি সেই কঠিন জায়গাটাও পেরিয়ে গেলাম! ভুল ভাঙল।
একটা জায়গায় গিয়ে রাস্তা শেষ। দেখলাম নরেন্দার ঝুঁকে নীচেটা দেখছে। এই সেই ‘অসুবিধার’ জায়গা। ধ্বসের জন্যে জায়গাটায় পরিধি বরাবর উপর নীচ খাড়া একটা অর্ধবৃত্ত তৈরি হয়েছে। ব্যাসের এপারের বিন্দুতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, আর ওপারের বিন্দুতে আবার রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এখান দিয়ে যেতে হবে! সত্যি বলতে কি বুকটা একটু কেঁপে উঠল। শিশিরদা যাবে না বলে দিল। ওরাও বলল আঙ্কেলজি এখানেই থাক।
দেবেন্দার আজ একটা আইস অ্যাক্স নিয়ে গেছে। ওটা দিয়ে কিছু ঝুরো পাথর দেয়াল থেকে ফেলে দিল। নরেন্দার আগে নেমে হাত বাড়াল, ধরলাম হাত।বাঁ দিকে ভেঙ্গে যাওয়া পাহাড় হাঁ করে আছে। ওদিকে তাকাবো না ঠিক করলাম। ডান দিকে দেয়ালে ভিজে মাটি আর ইতিউতি বেরিয়ে থাকা কিছু পাথর। ওই দেয়ালে পা রেখেই যেতে হবে কিন্তু পা রাখব কোথায়! কোথাও দেয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা একটু খানি পাথরে পা, কোথাও এক দু ইঞ্চির মত গর্তে জুতোর ডগা গুঁজে দেওয়া। কোথাও বা টিকটিকির মত আটকে থাকা নরেন্দারের জুতোর ওপর পা দিয়ে হাঁটা। সারা রাস্তা নরেন্দার বলে গেল, বিসোয়াস রাখিয়ে সাব, আপ নেহি গিরেঙ্গে। সাবাশ এই নরেন্দার এবং পেছন থেকে সাহায্যের হাত বাড়ান দেবেন্দার। কি ক্ষমতা ছেলে দুটোর।
কতক্ষণ লেগেছিল ঠিক জানি না। তবে কাকে বলে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিয়োরির ‘টাইম ডায়লেশান’ হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সময় যেন শেষ হচ্ছিল না! আমার পরে কৌশিকও একইভাবে চলে এল। এরপর শিশিরদাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে নরেন্দার ওপারে চলে গেল। হ্যাঁ ছুটে গেল, যেভাবে আমরা প্লেন ল্যান্ডে একটু ছুটে ট্রেন ধরি সেভাবে!
এবার জিরো পয়েন্টের দিকে যাবো। রাস্তা আধ কিলোমিটার মত প্রায় সমতল, যেখানে পিন্ডারিবাবার আশ্রম। আমরা ঠিক করলাম ফেরার পথে আশ্রমে দাঁড়াব। এখানে আর রাস্তা সেই অর্থে নেই। সবুজ পাহাড়ি গুল্মে ঢাকা মাঠ। মাঝে মাঝে জলধারা আর বোল্ডার। সেসব পেরিয়ে গিয়ে উঠলাম এক প্রকৃতির তৈরি ভেড়িপথে। যারা সুন্দরবন গেছেন তারা বুঝবেন। একদিকে মাঠ একদিকে নদী। পার্থক্য হচ্ছে এখানে মাঠের দিকটা কুড়ি ফুট মত নীচে, আর পিন্ডারি নদীর দিকটা কত হবে আটশ বা হাজার ফুট নীচে। তবে ধ্বস পেরিয়ে বুকে এখন অদম্য সাহস। তাই ভেড়ি দিয়ে হেঁটে চললাম। অবশেষে জিরো পয়েন্ট। আর যাওয়া যাবে না। ভেড়ি এমন ভাবে ভেঙ্গে গেছে, পা দেওয়া সম্ভব নয়।
সামনে তাকিয়ে যা দেখলাম ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। এত ফুর্তি হল দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে যেন এক হাত দিয়ে পিন্ডারি গ্লেসিয়ার আর এক হাত দিয়ে বিখ্যাত ছাঙ্গুস (৬৩২২ মিটার) পর্বত ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে ছবি তোলালাম দেবেন্দারকে দিয়ে।
একেই বলে বোধহয় ভয়ঙ্কর সুন্দর। পিন্ডারি গ্লেসিয়ার যেন বিশালকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা এক চঞ্চলা নদী হঠাৎ স্থির হয়ে গেছে। বরফ ঢাকা শান্ত সমাহিত ছাঙ্গুস মাথায় সাদা পেঁজা তুলোর মত এক টুকরো মেঘ নিয়ে আরো মোহময় হয়ে উঠেছে। এছাড়া আছে পানওয়ালিদুয়ার (৬৬৬৩ মিটার), বলজুরি (৫৯২২ মিটার), নন্দাখাট (৬৬১১ মিটার), নন্দাকোট (৬৮১৬ মিটার) পাহাড়।ক ঠিন ট্রেলস পাস (৫৩০০ মিটার) যাবার রাস্তাও উঁকি দিচ্ছে। আর এই পাহাড় শ্রেণীর নীচ দিয়ে রুক্ষ পাহাড় কেটে নুড়ি পাথর আর মাটির স্তুপ সরিয়ে বিশাল খাদের মধ্যে দিয়ে নেমে এসেছে পিন্ডারি নদী। বাতাসও এখানে শিল্পী। দীর্ঘ দিনের চেষ্টায় সেও পাহাড়ের গায়ে ক্ষয়ের আঁকিবুঁকি কেটে ফেলেছে। বেশ কিছুটা সময় কাটালাম। উল্টোদিকে মেঘ জমছে বলে এবার অনিচ্ছাতেও ফিরতি পথ ধরতে হোলো।
থামলাম পিন্ডারিবাবার আশ্রমে। সদা হাস্যময় এই সাধু আমাদের গরম চা খাওয়ালেন। ওনার বয়স ৫১বছর। ১৯৮৬ সালে ঘর ছেড়েছেন। আট বছর গোমুখে ছিলেন। তারপর এখানে আশ্রম করে আছেন। উনি ঠিক প্রথাগত সাধুর মত ধ্যান বা সাধনায় নিজের মুক্তি খুঁজছেন না। উত্তরাখন্ডে সাধারণ মানুষদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ওনার প্রধান কাজ।নানাভাবে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আজ আমরা ফিরে যাব দ্বোয়ালি। কাল শনিবার ১৯.১০.২০১৯. খাটি হয়ে ফিরব জয়কুন। বৃষ্টির কথা ভেবে দেবেন্দার তাড়া দিল। এবার ফিরতে হবে। মন ভারাক্রান্ত। আবার সেই কেজো জগতে ফিরে যেতে হবে। মেমরি বক্স ঠাসা অসাধারন সব স্মৃতিতে। পিন্ডারি বাবা আর পিন্ডারি গ্লেসিয়ারের কাছে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালাম ফেরার পথে।
শেষ