মশাইরা, আপনারা ফুড বুটিক আর ফুড জয়েন্টের তফাত বোঝেন কি? আর কাকেই বা বলে মাল্টি ইয়ে রেস্তোরাঁ? আজ সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে এই ব্যাপারে গুগল স্যারের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিঞ্চিৎ জ্ঞানার্জন করা গেল। অথবা গেল না। (https://en.m.wikipedia.org/wiki/Types_of_restaurants)
কারণ? আজ্ঞে, তেমন কিছু না। আমার উচ্চাকাঙ্খী ডাক্তার কন্যারত্নটি অসতর্ক মুহূর্তে তার অনেক অবরুদ্ধ বাসনার মধ্যে একটা বাসনা খুব সিরিয়াসলি জানাল,- বুঝলে বাপি, একটা ফুড বুটিক খুলব, কলকাতায় কিম্বা অন্য কোনও মেট্রোয়। জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকাতেই বুঝিয়ে বলল। – এই ডাক্তারিটাক্তারি করে বেশি দূর যাওয়া যাবে না। সারা দিন সারা রাত হাড় ভাঙা খাটুনির পর, চিরজীবী মনুষ্য প্রজাতির একটিও মারা গেলে ক্যালাকেলি ভাঙচুর কমপেনসেশন মায় ডিগ্রি নিয়ে টানাটানি। তার চাইতে ব্যবসা ভালো। কর্পোরেট ব্যবসা।
– তাহলে যা জানিস, সেই ব্যবসাই খোল না বাপু। কর্পোরেট ব্যবসা যদি করতেই হয়, তবে ওই হাসপাতালের ব্যবসা কর। আমি আছি তো।
– না বাপি, খুব ঝামেলা ওতে। পাবলিক সামলাতে বাউন্সার মস্তান পোষা, দাদা-দিদি-পুলিশ সবাইকে খুশি রাখা, ফলস বিলিংএর হ্যাপা, সব মিলিয়ে পুঁজিপাটা বেলেঘাটা হয়ে যাবে। তোমার তো ব্যবসার জ্ঞান ওই প্রি মেডিকেলে সখ করে বেলুন বিক্রি আর বই মেলায় ভিখিরির মত লিটলম্যাগের লোকসান খাওয়া। তোমার সঙ্গে এগোন যাবে না।
– তবে?
– মাকে পার্টনার করে এগোব। মা তো শুধু আজ বলে নয়, চিরকালই উঁচু স্ট্যান্ডার্ডে রেঁধে গেল। মার অ্যাক্টিভ হেল্প নিয়ে একটা ফুড বুটিক খুলব।
আমি গেঁয়ো মানুষ। ছোটবেলায়এই বুটিক না বাটিক বলতে আঁকাবাঁকা ছাপ শাড়ি কাপড় হয় জানতাম। তারপর ক্রমে জেনেছি বড়লোকদের মেয়েবউরা বুটিক নামে এক রকমের দোকান দোকান খেলা করে। কাপড় জামা জাঙ্ক-জুয়েলারির। কেউ কেউ প্রচুর লাভের মুখও দেখে নাকি। তো এই ফুড বুটিক বস্তুটা কি?
মেয়ে বোঝাল, – কিচ্ছু খোঁজ রাখোনা বাপি তুমি। এই কলকাতা আর সাবার্বেই কতগুলো ফুড বুটিক রমরমিয়ে চলছে তুমি জানো?
না, তা জানি না। সত্যিই না। আমার কলকাতা আর মফস্বলি পাইস হোটেল অবধি দৌড়। শেয়ালদার আশেপাশের ফুটের হোটেলেও দেদার খেয়েছি এককালে। উন্নাসিকের দল যাকে বলত ভিখিরি হোটেল। চিনা খাবার বলতে বুঝতাম মাম্মিস্ কিচেনের পর্ক চাউমিন আর মোগলাই বলতে পার্ক সার্কাসের বিফ বিরিয়ানি আর রোল। চাংওয়া, নিজাম, আমিনিয়া, সাবির আড়চোখে দেখে এড়িয়ে যেতাম, যেমন আড়চোখে এড়িয়ে যেতাম সিনেমাহলের সামনে সাড়ম্বরে সাজানো হেমা মালিনী আর হেলেনের ছবি। অবশ্যি চাংওয়া থেকে হেলেন সবার সঙ্গেই নিষিদ্ধ স্বপ্নে দেখা হত কখনও। যাক, নিম্নবর্গীয় সেই সব আমিষ মেশানো বিলাস-কথা।
তো এখনের এই ফুড বুটিক ব্যাপারটি কী। জিজ্ঞেস করতে মেয়ে আমাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করল, – বললে তুমি বুঝবে?
– আহা বলই না! দেখি বুঝি কি না…
– না বাপি, এই আইডিয়া এমনকি তোমাকেও বলা যাবে না। তুমি তো ফুড বুটিক আর ফুড জয়েন্টের তফাতই বোঝো না। তোমার ব্রেকফাস্টের বিলাসিতা মানে রামুর ডিমটোস্ট, আর চূড়ান্ত লোভ মানে সন্ধ্যের চপ মুড়ি। তুমি এই সব উঁচু ভাবনা জাস্ট অ্যাসিমিলেট করতে পারবে না।
কিছুতেই সে তার আবিষ্কৃত খাদ্য-ব্যবসার গোপনতম রহস্যময়তা ভাঙল না। যা সে শেয়ার করবে জননীদেবী আর তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে।
শুধু অনেক তুতিয়ে পাতিয়ে তার সেই ফুড বুটিকের দুটি কোণের ভার তাও আংশিক, আমায় দিতে রাজি হল।
এক কোণে চার পাঁচটা নকল তালগাছের নীচে যে টেবিল, সেখানে দিশি মুরগির নাড়িভুড়ির আগুনে ঝাল চাটের সঙ্গে বিশুদ্ধ তাড়ি সার্ভ করা হবে। তালের রস গেঁজিয়ে তৈরি সে জিনিস এক্কেবারে যাকে বলে অর্গানিক। তালগাছে ইনসেক্টিসাইড কিম্বা সার দেয় না তো কেউ!
আর একটা টেবিলের পাশেই দেওয়ালে আঁকা থাকবে নাগাল্যান্ডের থ্রি ডি মনোরম পাহাড়-দৃশ্য। সেই টেবিলের একটা আইটেমের ভার আমি পেলেও পেতে পারি।
কন্যার ভাবী ব্যবসার এই দুটি মূল্যবান ভার পাবার সৌভাগ্যের কারণ দুটি যথাক্রমে বলি।
প্রথমটির কারণ হল, ক্লাস সেভেনে পড়া কালীন হিলোরা বলে এক গ্রামে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। মাস্টারমশাই পরিমিত পরিমাণ তাড়ি যা কিনা আদতে গেঁজানো তালের রস, সেবন করতেন স্কুল থেকে ফিরে। তাঁর মেয়েরা আমার সমবয়সী। তাদের কাছে জেনেছিলাম, তাদের বাবা, ও কিছু না, তালের রস খায় একটু। সদ্য শিক্ষিত আমার তালের রস সম্বন্ধে জানা ছিল না। কিন্তু খেজুর রস বিষয়ে জ্ঞান ছিল সম্যক। সেই লোভে পড়ে এক বিকেলে মাস্টার মশাইয়ের সেই তালরসামৃত চুরি করে আকণ্ঠ পান করেছিলাম।
সেই তীব্র ঝাঁঝালো, কিঞ্চিৎ বিকর্ষণকারী গন্ধযুক্ত তরল আদৌ খেতে ভালো ছিল না। খেজুর রসের মত মনোহারিণী নয় বলাই বাহুল্য। কিন্তু পান করার পর তার দ্রব্যগুণ যাবে কোথায়? ফলত সেই লোভী চোর বালক সন্ধ্যের মুখে টুপভুজঙ্গ। এবং বমনরত বলে তীব্র দুর্গন্ধে তার চৌর্যবৃত্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল। এবং অপমানিতা ক্রুদ্ধ এক মহিলা, যাকে আমি মা বলে জানতাম, তার হাতে গোবেড়েন। ওঃ, এখনও শিউরে উঠি। পাড়া পড়শী চমকিত।
শুধু মাস্টারমশাই নাকি মাকে বলেছিলেন মাকে, – আর মেরেন না গো দিদিমণি। পুরুষ বাচ্চা উ সব একটু আধটু না খেলে চলে?
তো সেই চির বালক গল্পটা তার কন্যাকে বলেছিল একদা।
এবারে দ্বিতীয় সৌভাগ্যের কথা। তার মূলেও আছে মেয়েকে বলা আমার জীবনের এক খণ্ড গল্প। ঠিক আমার একার গল্প না। আমি আর আমার তিন বছরের জুনিয়র বন্ধু রফি আমেদের যৌথ যাপনের গল্প। খাদ্যসন্ধানে কোথায় কোথায় না যেতাম আমরা। শেয়ালদা’ চত্বরে ভিখিরিদের হোটেল, ফিয়ার্স লেনে সস্তার পর্ক চাউমিন, মেট্রোগলির ধোঁয়াশা মাখা রহস্যময়তায়। একবার রফি খবর আনল খিদিরপুরে একজায়গায় ছ’আনায় মাংসভাত দিচ্ছে। আমরা পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে খেয়েও এলাম। রান্না খেয়ে আমরা মুগ্ধ। ওই অঞ্চলে পরে খোঁজ খবর করে রফি জেনে এল, ব্যাপারটা কুকুরের মাংসও হতে পারে। আর অত সস্তায় দিচ্ছে কাজেই রফি ভেবেচিন্তে বার করল, – অরুণাচলদা’ এমনি কুকুর না, সিয়োর অ্যাকসিডেন্টে মরা কুকুর। সেই চিন্তায় বমি শুরু হল তার। হাসপাতালে ভর্তি করে স্যালাইন দিতে হল কুড়ি বোতল।
রান্না করা নিষিদ্ধ সেই মাংসই পাবেন আমার ভাগের দ্বিতীয় টেবিলে।
আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ রইল আমাদের পারিবারিক এই কল্পিত কর্পোরেট ফুড বুটিকে। অন্য কোন টেবিলে কী থাকবে, তা আমার জানা নেই। শুধু আমার ভারপ্রাপ্ত টেবিলদুটোয় আমি সার্ভ করব। নো জিএসটি। আর ইয়ে, ব্লাড ব্যাঙ্কে যেমন ডোনেশনের কার্ড থাকলে রক্ত ফ্রিতে মেলে, তেমনই পাড়ার কোনও নেড়িকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আসতে পারলে নাগাল্যান্ডের টেবিলে, হেঁ হেঁ, আপনারও এক প্লেট ফ্রি…
আসবেন কিন্তু।