(এ লেখাটির সম্পাদিত রূপ গত ৭.০৯.২০২৩-এ আনন্দবাজার পত্রিকার উত্তর-সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। ধন্যবাদ জানাই স্বাতী ভট্টাচার্যকে।)
গত বছর পাঁচেক লোকসভা এবং রাজ্য সভায় বিভিন্ন বিল এবং অ্যাক্ট পাস করানোর বেশ একটা ‘বিল-প্লাবন’ এসেছে। শাসকদলের সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার দরুন ধ্বনি ভোটে বিল পাস হয়ে যায়। এরকম একটি বিল গত ২৭ জুলাই ধ্বনি ভোটে পাস হয়েছে কোনরকম আলাপ-আলোচনা বা বিতর্ক ছাড়াই – “জন বিশ্বাস (অ্যামেন্ডমেন্ট অফ প্রভিসনস) বিল, ২০২৩”। এই বিল সম্পর্কে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তি (২ আগস্ট, ২০২৩) জানাচ্ছে, “বিলের লক্ষ্য হল সহজে জীবনযাত্রা এবং সহজে ব্যবসা করার পথ সুগম করা। এই বিল প্রস্তাব করছে যে ১৯টি মন্ত্রকের ৪২টি কেন্দ্রীয় অ্যাক্টের ১৮৩টি বিধানকে সংশোধন করে বৈধ (‘ডিক্রিমিনালাইজ’) করা হবে।”
এই বিলের বৈধতার শক্তিতে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যাতে ওষুধের মানে গণ্ডগোল থাকা সত্ত্বেও ফার্মা কোম্পানিগুলোকে কিছু পেনাল্টি দিলেই, কোর্টের মুখোমুখি হতে হবেনা। প্রথম সংশোধনীতে সরকারি অ্যানালিসিস বা টেস্ট রিপোর্টকে ওষুধের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করার মতো অপরাধ বারংবার করলেও শাস্তির হিসেবে কিছু অর্থ জরিমান করা হবে। ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ (যে এতদিন পর্যন্ত চালু ছিল) অনুযায়ী এক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ দু বছর পর্যন্ত জেল হতে পারত। দ্বিতীয় সংশোধনী ওষুধের ‘কম্পাউন্ডিং’ সংক্রান্ত। ‘কম্পাউন্ডিং’ হল রোগীর প্রয়োজনোপযোগী করে ওষুধের বিভিন্ন উপাদানকে মেশানো, একসাথে জুড়ে দেওয়া কিংবা উপাদানের পরিবর্তন ঘটানো। কিন্তু এ কাজটি করতে গিয়ে বহুক্ষেত্রেই ‘নট-অফ-স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি’ বা NSQ ওষুধ বানানো হয়। অদ্যাবধি চালু ড্রাগ অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ অনুযায়ী ভেজাল বা জাল ওষুধ তৈরি করলে পাঁচ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অবধি হতে পারত। বর্তমান সংশোধনীর পরে এগুলো মৃদু এবং লঘু করার ফলে প্রায় কোন ক্ষেত্রেই কোর্টে বিচারের মুখোমুখি হতে হবেনা, শুধুমাত্র জরিমানা দিলেই হবে।
এখানে NSQ ওষুধ নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। প্রয়োজন কিছু তথ্য পাঠকদের গোচরে আনা। ডিসেম্বর, ২০২০-তে সরকারি সংস্থা xlindia.gov.in (Extended Licensing, Laboratory and Legal Node)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গুজরাট, মহারাষ্ট্র এবং কেরালা-র মতো ৩টি রাজ্যে বাজার থেকে সংগৃহীত স্যাম্পেলের মধ্যে ৭,৫২৫টি ওষুধ NSQ। CDSCO (Central Drugs Control Organization) বারংবার কাগুজে কলমে সতর্ক করা সত্ত্বেও ২০১৩ থেকে ২০২১-এর মধ্যে ২,৬৬৮টি NSQ ওষুধ পাওয়া গেছে। এ কথা স্পষ্ট করে মনে রাখা দরকার, একটি ওষুধ প্রকৃতপক্ষে একটি ব্যাচের ওষুধ বোঝায়। একটি ব্যাচ মানে কয়েক লক্ষ অব্দি ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, ইঞ্জেকশন ইত্যাদি হতে পারে। অর্থাৎ এ পরিমাণ ওষুধ বাজারে ঘুরছে, মানুষ কিনছে এবং ব্যবহার করছে। (দীনেশ ঠাকুর এবং প্রশান্ত রেড্ডি টি, The Truth Pill: The Myth of Drug Regulation in India, 2022, পৃঃ ১১২) এমনকি বহুক্ষেত্রে NSQ ওষুধে প্রত্যাশিত মাত্রার মাত্র ১০% বা ২০% সক্রিয় মলিক্যুল থাকে। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৩)
জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ এক অতি বিপজ্জনক অবস্থা। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ওষুধ – যা সাধারণ মানুষ তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কেনে – সেকি এতই হেলাফেলার বিষয়? জনস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যনীতির কেন্দ্রে যদি মানুষ না থাকে, ঠাণ্ডা ঘরে বসে যদি নীতি নির্ধারণ হয় তাহলে এরকম অবস্থা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়।
আরও উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পশ্চিমবাংলায় ৯ কোটি মানুষের বাস। সেখানে জানুয়ারি ২০১৬ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২-এর মধ্যে মাত্র ২,৬৩৭টি স্যাম্পেল পরীক্ষা করা হয়েছে। একই সময়কালে দিল্লিতে যেখানে ২ কোটি মতো মানুষের বাস সেখানে পরীক্ষিত স্যাম্পেলের সংখ্যা ৩,৪৩৩। প্রায় ১৩ কোটি মানুষের বিহারে এই সময়কালে ১৪,১০৩টি স্যাম্পেল পরীক্ষা করা হয়েছে। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২০)
আরেকটি বিষয় হল, যেসব ওষুধ ব্যাক্টেরিয় এন্ডোটক্সিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনা সেগুলো অনুপুযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। এন্ডোটক্সিন শরীরে ইমিউন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং জ্বর এবং প্রাণঘাতী অ্যানাফাইলেকটিক শক অব্দি হতে পারে। সংশোধিত বিলে এ ব্যাপারে নজর নেই। শুধু তাই নয়, অনেক সময় ইঞ্জেকশনের মাঝে অতি সূক্ষ্ম কাঁচের কণা মিশে থাকে। এর ফলাফল মানুষের কেন যেকোন প্রাণীর শরীরের জন্য কতটা ‘উপকারি’ এ কথা সহজেই অনুমেয়।
২০২২-এ অক্টোবর মাসে ভারতে তৈরি কাফ সিরাপ খেয়ে আফ্রিকার ছোট দেশ গাম্বিয়ায় ৬৯টি শিশুর কিডনি ইনজুরিতে মৃত্যু হয়েছিল এ খবর আন্তর্জাতিক মহলে শোরগোল ফেলেছিল (ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত)। এমনকি হু-ও ভারতকে ওষুধের গুণমান রক্ষা করার জন্য সতর্ক করেছিল। ভারতের তরফে যথারীতি বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। পরে রিপোর্ট আসে, এমনকি উজবেকিস্তানেও বেশ কিছু শিশুর মৃত্যু হয়েছে এই ওষুধের কারণে।
ভারতকে বিশ্বের ফার্মেসি বলা হয়। পৃথিবীর ২০% জেনেরিক ওষুধ ভারত থেকে রপ্তানি হয়। জেনেরিক ওষুধের রপ্তানি বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু আমেরিকার প্রভাবশালী সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের ওষুধ শিশু মৃত্যু ঘটিয়েছে, চোখের ড্রপ অন্ধত্বের কারণ হয়েছে এবং অ্যান্টি-ক্যান্সার ওষুধে দূষণ পাওয়া গিয়েছে। যারা ক্যাথেরেইন এবানের লেখা বটল অফ লাইয়েজ বইটি পড়েছেন তারা জানবেন যে ওষুধ কোম্পানিগুলো কোন কুটিল প্রক্রিয়ায় জেনেরিক ওষুধ তৈরির কারবার বহুক্ষেত্রে চালিয়ে যায়। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল কিংবা ল্যান্সেট-এ ভারতের ওষুধের গুণমান রক্ষাকারী সংস্থার তরফে যে বিপুল শিথিলতা এবং ছিদ্র আছে এ নিয়ে বহুসংখ্যক পেপার বেরিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। ক্যাথেরিন এবান-এর লেখা Bottle of Lies: The Inside Story of the Generic Drug Boom-এ এরকম শিথিলতা, ‘ম্যানেজ’ করে নেওয়া এবং প্রভাবশালীর চাপে নিম্ন মানের ওষুধের লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে বিস্তৃত তথ্য আছে। আগ্রহী পাঠকেরা নিশ্চয়ই এ বইটি এবং পূর্বোক্ত The Truth Pill বইটিও পড়ে নেবেন, আশা করি।
এখানে যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তাহল রাষ্ট্রিক মদতে ওষুধ কোম্পানিগুলো কি জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার গোলপোস্টটি ক্রমাগত ঠেলে পেছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? যেখানে ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সেখানে জনস্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ নিতান্ত জরুরী। সবচেয়ে বেশি অ-নিরাপদ কয়েক কোটি (হয়তো বা শত কোটির বেশি) যাদের দুর্মূল্য ওষুধ কেনার সামর্থ্য নেই। আবার যে ভেজাল কিংবা নিম্ন গুণমানের ওষুধ তারা নেবে তার ফলাফল কি হবে সেক্ষেত্রেও অনবহিত। এদের কোর্টে বিচার চাওয়ার সামর্থ্য নেই। আবার ওষুধ কোম্পানিগুলো্কে কোর্টের আওতা থেকে বাঁচানোর জন্য যে সংশোধনী “জন বিশ্বাস বিল” আনা হয়েছে তাতে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর ছাড়া আর কোথাও যাওয়া যাবেনা।
ভিন্ন একটি প্রসঙ্গে বলা যায়, ল্যান্সেট-এ ২০২২-এ প্রকাশিত একটি সুদীর্ঘ স্টাডি দেখিয়েছিল, হু-নির্ধারিত সাধারণ পুষ্টি এবং রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ভারতের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে কম। এটা জাতীয় স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। অমর্ত্য সেন সহ বহুসংখ্যক অর্থনীতিবিদ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, একটি দেশের স্বাস্থ্যের মান, সামাজিক সুরক্ষা এবং গড়পড়তা পুষ্টির অবস্থা নির্ধারণ করে সে দেশের মোট সামাজিক সম্পদ তথা শ্রমশক্তি উৎপাদন কত হবে। ভারতের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫ (২০১৯-২১) দেখিয়েছিল নারীদের ক্ষেত্রে ৫৭% এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ৬৭%-এর রক্তাল্পতা রয়েছে এবং এখনো ১৯% খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে। এরপরে দুটি ঘটনা ঘটলো – (১) এ বছরের ১ জুলাই থেকে যে নতুন সার্ভে শুরু হয়েছে সেক্ষেত্রে রক্তাল্পতাকেই একটি মাপকাঠি হিসেবে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, এবং (২) এই সার্ভে যে সংস্থা চালায় তার অধিকর্তাকে (কে এস জেমস) পদ থেকে অপসারিত করা হয়েছে। সহজেই বোধগম্য, মেডিক্যাল-পলিটিকাল কমপ্লেক্সের চাপে বিজ্ঞান পেছনে চলে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে প্রশ্নহীন “জন বিশ্বাস” উৎপাদনই একমাত্র পথ।
লেখাটা পড়লাম ভালোই লাগল, কিন্তু প্রশ্ন ‘জন বিশ্বাস উৎপাদন’ কি আদৌ সম্ভব? আর যদি তা করতে পারাও যায় তাতে কি আমরা এই মহামারী থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারব?
রাষ্ট্র কর্পোরেট সহযোগী থেকে এখন কর্পোরেট মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত
ভুতটা সর্ষের মধ্যেও একই পরিমানে আছে –
আবার আজকের বিশ্বে private profit making pharmaceuticals research না হলে নতুন ও উন্নত চিকিৎসা তৈরী ও তার প্রয়োগকরা সম্ভব নয় ।
নয়তো মধ্যযুগীয় চিকিৎসা পরিষেবা নিয় চলতে হবে ….
জন বিশ্বাস বিল টির প্রস্তাব গুলি অতীব খারাপ – multinationals এবং গুটিকয় পরিবার (যে পরিবার গুলি ভারতের মোট সম্পত্তির প্রায় 70% এর মালিক) ছাড়া কারো উপকার হবে না । এই বিলের কিছু বক্তব্য legal point of view থেকে এতই dubious যে বিল টি অ্যাক্ট এ পরিনত হওয়া র পরে অনায়াসে আদালতে যাওয়া যাবে – কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল, শাসক বা বিরোধী, যাবেন না ।
Excellent sir
Good sir
Lekhata pore valo laglo, kintu poristhir ki adou badol habe?