বুকে ব্যথা হলে সঙ্গতভাবেই আমাদের দুশ্চিন্তা হয়, হার্ট অ্যাটাক নয়তো। আর পেটে ব্যথা হলে ভাবতে হয় অ্যাপেন্ডিসাইটিস, পিত্তথলি বা গল ব্লাডারের ব্যথা, পাকস্থলীর অ্যাসিডের জন্য ব্যথা, প্যানক্রিয়াসের ব্যথা, বৃক্কের ও গবিনীর পাথরজনিত ব্যথা, মুত্রাশয়ের ব্যথা বা মেয়েদের এক্টোপিক গর্ভাধানের ব্যথা—এমন শতেক রোগের কথা। কিন্তু হারপিস জস্টার নামক ত্বকের রোগটিও যে বুকে ব্যথা বা পেটে ব্যথার কারণ হতে পারে আর তাকে হার্ট অ্যাটাক কিংবা অ্যাপেন্ডিসাইটিসের থেকে আলাদা করে চিনতে ডাক্তারদের মাথাব্যথা হতে পারে, সে কথা কমই ভাবা হয়।
জস্টারের ব্যথা
হারপিস জস্টার রোগটির ভাইরাসের নাম ভ্যারিসেলা জস্টার ভাইরাস। ভ্যারিসেলা হল জল বসন্ত বা চিকেন পক্সের আরেক নাম। এই ভাইরাসটি যখন সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে তখন জল বসন্ত রোগ হয়। আবার একই ভাইরাস দেহের একটা ছোটো অঞ্চলের মধ্যে প্রকোপ দেখাতে পারে, তাতে দেহের সেই অংশে অনেকগুলো ব্যথাযুক্ত ফোসকা বা ফুসকুড়ি তৈরি করে, সেটাই হারপিস জস্টার রোগ। ভ্যারিসেলা আর জস্টার এই দুটো মিলিয়ে ভাইরাসের নাম।
সাধারণত জল বসন্ত বা ভ্যারিসেলা রোগ হবার পরে ভাইরাসটি আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, তারপর হঠাৎ কোনোদিন সেই ভাইরাস কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে বেরোনো একটি স্নায়ু ধরে ত্বকে আসে। সাধারণত কোনো কারণে রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এরকম ঘটে। স্নায়ুতে এই ভাইরাস প্রদাহ ঘটায়, ফলে সেই স্নায়ুর গতিপথ ধরে ব্যথা হয়। মুখ ও গলা-ঘাড়ের স্নায়ু (সাধারণত ট্রাইজেমিনাল স্নায়ু) এবং বুক-পেট অঞ্চলে সুষুম্নাকাণ্ড থেকে যে সব স্নায়ু বের হয়, সেই স্নায়ুগুলো সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয়। সুষুম্নাকাণ্ড থেকে বেরোনো স্নায়ুগুলো পিঠের মাঝখান থেকে শুরু হয়ে পেট বা বুকের মাঝামাঝি এসে শেষ হয়, তাই হারপিসের ব্যথা ও ফোসকা বা ফুসকুড়ি পিঠের মাঝখান থেকে শুরু হয়ে বেঁকানো আধখানা বেল্টের মতো সামনের দিকে বুক-পেটের মাঝ-বরাবর শেষ হয়। ব্যথাও হয় এই স্নায়ু বরাবর। বুকের স্নায়ু বরাবর ব্যথা অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের কথা ভাবায়, আর পেটের স্নায়ু বরাবর ব্যথা ভাবায় পেটের নানা অঙ্গের রোগের কথা।
আরেকটা জিনিস এইখানেই বলে রাখা ভালো। হারপিস জস্টারের ফোসকা-ফুসকুড়ি সেরে যাবার পরে সেখানে দুটো সমস্যা থাকতে পারে—প্রায় সবারই ফোসকা-ফুসকুড়ির জায়গায় ক্ষতের দাগ থাকে, এবং অনেকেরই ব্যথা থাকে। এই ব্যথাকে বলে পোস্ট হারপিটিক নিউর্যালজিয়া, অর্থাৎ হারপিস জস্টারের ভাইরাস চলে যাবার পরেকার স্নায়ুগুলোর প্রদাহের জন্য ব্যথা।
যখন ফোসকা-ফুসকুড়ি নেই
ফোসকা-ফুসকুড়িগুলো বেরিয়ে যাবার পরে রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলে রোগটা ধরতে তাঁর তেমন অসুবিধা সাধারণত হয় না, বা সেগুলোকে হয়তো তিনি ভুল করে অন্য ত্বকের রোগ বলে ভাবতে পারেন। কোনো কোনো ত্বকের রোগের সঙ্গে হারপিসকে আলাদা করতে সমস্যা হয়, আমরা এখানে সেই আলোচনায় যাব না। ফোসকা বা ফুসকুড়ি বেরোনোর আগে ব্যথা নিয়ে রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলে তাঁর রোগ চিনতে বেশ অসুবিধা হয়।
বুকের একদিকে, বিশেষ করে বামদিকে, হঠাৎ ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে এলে তাঁর প্রথম কর্তব্য রোগীর মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন তথা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না দেখা। এই দেখার জন্য রোগীকে অনেক সময়ে হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগে ভর্তি করতে হয়। হার্ট অ্যাটাক শুরু হবার পরের এক ঘণ্টা হল ‘গোল্ডেন আওয়ার’, সোনালি এক ঘন্টা, যে সময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা করলে অনেক রোগীর প্রাণ বাঁচে ও হৃদ্যন্ত্রের ক্ষতি কম হয়, তাই তাড়াতাড়ি ভর্তি করে নানারকম পরীক্ষা বা টেস্ট দ্রুত করাই ভালো। রোগীর হারপিস জস্টার হয়ে থাকলে এই পরীক্ষায় হার্ট অ্যাটাকের চিহ্ন পাওয়া যাবে না, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত হারপিসের ফোসকা-ফুসকুড়ি না বেরোচ্ছে, ততক্ষণ চিকিৎসকের মনে শান্তি হয় না। এটা ভুল নয়, কিন্তু এর ফলে আইসিইউ থেকে রোগীর মুক্তি মেলে না, তাঁর ওপরে পরীক্ষা চলতে থাকে, টেনশন বাড়তে থাকে। ত্বকরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি নিজে এমন রোগী অনেক দেখেছি, অবশ্য প্রায় সবগুলোই ফোসকা বেরিয়ে রোগনির্ণয় সহজ হয়ে যাবার পরে। দু-একটা ক্ষেত্রে আইসিইউ-র চিকিৎসক ফোসকা বেরোনোরা আগেই আমাকে ডেকেছিলেন, এবং আমি শুধু বলতে পেরেছিলাম ‘সম্ভবত হারপিস জস্টার’। সত্যিই ফোসকা না বেরোলে নিশ্চিত করে বলা যায় না।
পোস্ট হারপিটিক নিউর্যালজিয়া, অর্থাৎ হারপিস জস্টারের ফোসকা মিলিয়ে যাবার পরে সেখানে ব্যথা শুরু হলেও কোনো কোনো সময়ে হার্ট অ্যাটাক বলে ভুল হতে পারে, তবে সাধরণত রোগী হারপিসের ইতিহাসের কথা বলেন, ও রোগটা তাড়াতাড়িই বোঝা যায়। সাধারণত হারপিসের ফোসকার আগে থেকে ব্যথা শুরু হয়, এবং ফোসকা সেরে যাবার পরেও ব্যথা থাকে। অনেক সময়ে এই ব্যথা কিছুদিন পরে বেড়ে যেতে পারে, এবং রোগী কোনো কারণে চিকিৎসককে হারপিসের ফোসকার কথা বলতেই ভুলে যান। সে ক্ষেত্রে রোগী ও তাঁর বাড়ির সদস্যদের ভালোভাবে জিজ্ঞেস করে হারপিসের ইতিহাস পেলে বা হারপিসের দাগ দেখতে পেলে তবেই রোগনির্ণয় করা যায়।
হারপিস জস্টারের একটি বিরল ধরন হল জস্টার সাইনে হারপিট (Zoster Sine Herpete), এতে হারপিস জস্টারের স্নায়ুতে সংক্রমণ ও প্রদাহ হয়, কিন্তু ত্বকে ফোসকা-ফুসকুড়ি হয়ই না। বুকের বামদিকে হলে একে হার্ট অ্যাটাক থেকে আলাদা করে চেনা খুব কঠিন। ব্যথা স্নায়ুর পথ ধরে হয়, এটা দেখে হারপিস সন্দেহ করতে পারা যেতে পারে, এবং হার্ট অ্যাটাক সহ অন্যান্য কারণ না পাওয়া গেলে আর রক্তে হারপিসের অ্যান্টিবডি (VZV IgG এবং IgM) পাওয়া গেলে তবেই এই রোগ নিশ্চিতভাবে ধরা যায়।
আরেকটা বড়ো সমস্যা হল যে, হারপিস জস্টার রোগটা নিজে হারপিস ভাইরাসজনিত পেরিকার্ডাইটিস রোগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। পেরিকার্ডাইটিস হল হৃদ্যন্ত্রের চারদিকের আবরণীর প্রদাহ, এটা গুরুতর রোগ। তখন ‘বুকের ত্বকের হারপিস জস্টারই ব্যথার একমাত্র কারণ’ ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে অন্য রোগ আছে কি না তা দেখার পরীক্ষানিরীক্ষা না করলে আখেরে রোগীর বিপদই বাড়ে।
এ ছাড়া সংখ্যাতত্ত্ব বলছে, যাঁদের হারপিস জস্টার রোগটা হয় তাঁদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি হয়, মস্তিষ্কে রক্তনার রোগের জন্য ’স্ট্রোক’-এর ঝুঁকিও বাড়ে। এখনও পর্যন্ত এর কারণ বোঝা যায়নি। কিন্তু সেগুলো হারপিসের সঙ্গে সঙ্গে হয় না, সুতরাং রোগনির্ণয়ে অসুবিধা করে না।
পেটে পেটে
হার্ট অ্যাটাককে অনেক সময়ে পেটের তীব্র রোগ, যেমন তীব্র পিত্তথলির ব্যথা বা তীব্র পাকস্থলীর ব্যথার সঙ্গে আলাদা করে চিনতে কষ্ট হতে পারে। যেভাবে বুকের হারপিস জস্টার আর হার্ট অ্যাটাক আলাদা করে চেনা কঠিন হতে পারে, ঠিক সেভাবে ও সেইরকম পরিস্থিতিতে ওপর পেটের হারপিস জস্টারের থেকে পিত্তথলির ব্যথা বা পাকস্থলীর ব্যথা বা প্যানক্রিয়াসের ব্যথা শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে, বিশেষ করে ত্বকে ফোসকা বেরোনোর আগে। আবার পেটের নীচের দিকে হারপিস জস্টারের ব্যথা আর বৃক্কের ও গবিনীর ‘রেনাল কলিক’ ব্যথা, অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা বা অন্যান্য পেটের ভেতরকার অঙ্গের ব্যথা থেকে আলাদা করা শক্ত হতে পারে। তাই নানারকম ব্যথার ক্ষেত্রেই এই রোগটির কথা মনে রাখা দরকার।