রবীন্দ্রপাঠের সময় রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় একটা বৈশিষ্ট্য বা সীমাবদ্ধতার কথা বোধ হয় আমাদের স্মরণে রাখা উচিত। পশ্চিমা ঘরানার ওই চর্চায় সম্মিলিত জ্ঞানার্জন চর্চার সে সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে সেই প্রাচীন গ্রিসের জিমনেশিয়াম থেকে প্রাক সোভিয়েত রাশিয়ার মার্কসবাদী স্টাডি সার্কেলের মধ্যে যেখানে কেবল বিষয়বস্তুর অধ্যয়ন নয়, তাকে বিশ্লেষণের জন্য প্রচুর পরিমাণ তর্ক বিতর্কের আয়োজন থাকতো যেটা মননশীলতাকে সমৃদ্ধ করতো, তীক্ষ্ম করতো। রবীন্দ্রনাথ এই জ্ঞানচর্চার ধারার সাথে তেমন ভাবে যুক্ত হতে পারেন নি কোনোদিন।
একে তো প্রথাগত বিদ্যায়তনিক চর্চার অবকাশ তাঁর জীবনে বিশেষ ছিল না, পরন্তু তাঁর অন্তর্মুখী স্বভাবও তাঁকে বাধ্য করেছে একক বিদ্যা চর্চায়। ঠাকুরবাড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় চলা নানান বিদ্যোৎসাহিনী সভাও রবীন্দ্রনাথকে তেমন ভাবে পুষ্ট করতে পারে নি। ফলে বহু বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান কেবল একক গ্রন্থ অনুশীলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। সংবাদপত্র ভিত্তিক, যাদের প্রায় সবটাই আবার ইংরেজ প্রোপাগান্ডায় ভরপুর, তার ওপর ভিত্তি করেই রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিজম আর বলেশেভিজমকে “একই ধরনের গুন্ডামি” বলে অভিহিত করছেন, ইদানীং পশ্চিমে বলশেভিজম ফ্যাসিজম প্রভৃতি যে-সব উদ্যোগ দেখা দিয়েছে আমরা যে তার কার্যকারণ তার আকার-প্রকার সুষ্পষ্ট বুঝি তা নয়; কেবল মোটের উপর বুঝেছি যে গুন্ডাতন্ত্রের আখড়া জমেছে।… রাশিয়ার জার-তন্ত্র এবং বলশেভিক-তন্ত্র একই দানবের পাশমোড়া দেওয়া।’’
অথচ সেই সময়েই সব রকমের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত, সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর এরা মার্কসবাদের তাত্ত্বিক অনুশীলন করে গেছেন, অবশ্যই একক ভাবে নয়, ওই সম্মিলিত চর্চার ধারা ধরেই।
এই সীমাবদ্ধতার মাশুল রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিয়েছেন তাঁর এককালের বক্তব্যকে পরবর্তীকালে নিজেই খন্ডন করে। যেমন রাশিয়ার চিঠিতে (তিন নম্বর) তিনি লিখছেন “মস্কো থেকে যখন নিমন্ত্রণ এলো,তখনও বলশেভিকদের বিষয়ে আমার মনে স্পষ্ট কোন ধারণা ছিলো না। তাদের সম্পর্কে ক্রমাগত উলটো উলটো কথা শুনেছি। আমার মনে তাদের বিরুদ্ধে একটা খটকা ছিলো। কারণ গোড়ায় ওদের সাধনা ছিলো জবরদস্তির সাধনা। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখলুম, ওদের প্রতি বিরুদ্ধতা ইউরোপেও যেন খানিকটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এমনকি অনেক ইংরেজের মুখেও ওদের প্রশংসা শুনেছি।”
যাঁরা ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থতার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথের লেখা চেরি পিকিং করে থাকেন, যেটা এই উত্তর সত্যকালে অনিবার্য, কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষজনের হাতে রবীন্দ্রনাথের এই স্ববিরোধিতা এক অনিবার্য হাতিয়ার হিসেবে উঠে আসতে বাধ্য। বলসেভিজমকে রবীন্দ্রনাথ কেবল গুন্ডামি বলে ছিলেন এইটাই তাঁরা জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারে অনায়াসে।
রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আবেগপ্রবণতা। তিনি যে শুধু শুষ্ক প্রাবন্ধিক নন, মূলত তিনি একজন কবি একথাও আমরা প্রায়শঃ ভুলে যাই। তথ্যের ওপর ভিত্তি না করে আবেগের বশে তিনি অনেক তাৎক্ষণিক মন্তব্য করেছেন যেগুলির তাৎপর্য সর্ম্পকে তিনি নিজেও বোধ হয় ওয়াকিবহাল ছিলেন না। যাঁরা প্রচুর লেখেন তাঁদের লেখা স্ববিরোধিতার রোগে আক্রান্ত হতে বাধ্য।
চেরি পিকিং যে কেবল এক পক্ষের লোকজন করে থাকে সেটা নয়, উত্তর সত্যকালে সত্য রচনায় সব পক্ষই সমান সিদ্ধহস্ত। যে পক্ষের মানুষ জন রাশিয়ার চিঠি নিয়ে গদগদ তাঁরা রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিটা নিয়ে কি বলবেন? রুশভ্রমণের দশমাস পর চিঠিটা রবীন্দ্রনাথ লিখছেন তাঁর দৌহিত্র নীতীন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে শান্তিনিকেতন থেকে। “কল্যাণীয়েষু, নীতু, তোর চিঠি পেয়ে খুসি হলুম। জর্ম্মানিতে ব্যাভেরিয়ার ভাবগতিক ভালো লাগছে না। যেখানে দারিদ্র্যে মানুষ দুর্ব্বল সেইখানেই যেমন মারী মড়ক জোর পায় তেমনি আজকালকার য়ুরোপে দুর্ভিক্ষ যতই ছড়িয়ে পড়চে ততই ফাসিজম এবং বলশেভিজম জোর পেয়ে উঠচে। দুটোই অস্বাস্থ্যের লক্ষণ। মানুষের স্বাধীনবুদ্ধিকে জোর করে মেরে তার উপকার করা যায় এ সব কথা সুস্থচিত্ত লোকে মনে ভাবতেই পারে না। পেটের জ্বালা বাড়লে তখনই যত দুর্বুদ্ধি মানুষকে পেয়ে বসে। বলশেভিজম ভারতে ছড়াবে বলে আশঙ্কা হয়——কেননা অন্নকষ্ট অত্যন্ত বেড়ে উঠেচে——মরণদশা যখন ঘনিয়ে আসে তখন এরা যমের দূত হয়ে দেখা দেয়। মানুষের পক্ষে মানুষ যে কি ভয়ঙ্কর তা দেখলে শরীর শিউরে ওঠে——মারের প্রতিযোগিতায় কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে সেই চেষ্টায় আজ সমস্ত পৃথিবী কোমর বেঁধেচে——মানুষের হাত থেকে বাঁচবার জন্যেই মানুষ কেবলই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠচে——এর আর শেষ নেই——খুনোখুনির ঘূর্ণিপাক চলল। আর যাই করিস এই সব মানুষখেকো দলের সঙ্গে খবরদার মিশিস নে।”
অর্থাৎ আবার সেই ফ্যাসিবাদ আর বলশেভিজমকে গুলিয়ে ফেলা। শুধু আবেগ নির্ভর হয়ে, তত্ত্ব ও তথ্যের যথোপযুক্ত সুশৃংখল কঠোর অনুশীলন ছাড়া সত্যের সন্ধানে ব্যাপৃত হলে খন্ড সত্য ছাড়া আর কিছুই ধরা দেয় না মানুষের কাছে, তাঁর ঋষি তুল্য প্রজ্ঞা থাকলেও।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্ববিরোধিতার আরেকটি উদাহরণ দিয়ে এই লেখা শেষ করবো। রাশিয়ার চিঠি’র শেষ পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আর একটা তর্কের বিষয় হচ্ছে ডিকটেটরশিপ অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যাপারে নায়কতন্ত্র নিয়ে। কোনো বিষয়েই নায়কিয়ানা আমি নিজে পছন্দ করি নে।” তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নি যে মার্কসবাদ লেনিন বাদের বুনিয়াদি তত্ত্ব ডিক্টেটরশিপ অব দ্য প্রলেতারিয়েত তথা শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্রের সাথে রবীন্দ্রনাথ পরিচিত ছিলেন না, এবং আর পাঁচজনের মতই শ্রেণীর একনায়কত্বের সাথে ব্যক্তি মানুষের একনায়কত্বকে গুলিয়ে ফেলেছেন, তবুও একথা মেনে নিতে হয় যে তাঁর আক্রমণের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি তথা নায়ক স্তালিন যিনি তখন রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান, যাঁর ‘ডিকটেটরশিপ’কে একটা ‘মস্ত আপদ’ হিসেবেই অভিধাচিহ্নিত করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন যে এই ‘আপদের বহু অত্যাচার’ সাম্প্রতিক রাশিয়ায় ঘটে চলেছে এবং এই তথ্য তিনি ‘বিশ্বাস’ করেন!
সেই রবীন্দ্রনাথেরই শেষ বক্তব্য একেবারে উল্টো। ২২শে জুন ১৯৪১ সালে হিটলার দ্বারা সোভিয়েত ভূমি আক্রান্ত হওয়ার পর পরই হীরেন মুখোপাধ্যায়, স্নেহাংশু আচার্য, জ্যোতি বসু, গোপাল হালদার চিন্মহণ সেহানবীশ প্রমুখের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ফ্রেন্ডস অফ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতি। ড: ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা (স্বামী বিবেকানন্দের ভাই) এর সভাপতি হন। সদ্য স্থাপিত সমিতির পক্ষ থেকে সুরেন গোস্বামী গেলেন শান্তিনিকেতনে – রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য তখন ভেঙ্গে পড়েছে, কিন্তু তাঁর আশীর্বাদের বড় প্রয়োজন ছিল সমিতির। কবি রাজি হলেন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হ’তে, তবে সাবধান করে দিয়ে বললেন যে, ইংরেজ নিজের স্বার্থে সোভিয়েতকে সাহায্য করবে বলছে বটে, কিন্তু “বিশ্বাস কোরো না ওদের; তোমরা কমিউনিস্টরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াইতে গা-ঢিলা দিয়ো না।” কমিউনিস্ট পার্টিরও চিন্তা তখন ঐরূপই ছিল – তাই সুরেন বাবু দেখালেন রবীন্দ্রনাথকে পার্টির সদ্য গৃহীত প্রস্তাব, কবি পুলকিত হলেন।
রবীন্দ্রনাথের জীবন অবসানের ঘটতে তখন দেরি ছিল না। সোভিয়েত আক্রান্ত হওয়ার পর ছয় সাত সপ্তাহের বেশি তিনি বাঁচেন নি। মৃত্যু শয্যায় শুয়ে কেবল জানতে চাইতেন যুদ্ধের খবর আর যে দেশে তিনি “লক্ষ্মীর কল্যাণী মূর্তি” দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশের জেতার সামান্য কোনো খবর পেলেও শিশুর মতো খুশি হতেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের মতো অন্তরঙ্গ সহচরকে বলে গিয়েছিলেন যে, “সোভিয়েত কখনো হার মানবে না।” ঋষিবাক্য যে বৃথা যায় না সেটা স্টালিনের লাল ফৌজ প্রমাণ করে দিয়েছিল সেই স্টালিন যার সর্ম্পকে একটু আগেই রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক মূল্যায়ন আমরা দেখেছি।
তাই সবশেষে একটাই কথা বলার। আমরা, যারা গাইতে পারি না, নাচতে পারি না, কবিতা আবৃত্তি করতে পারি না, অভিনয় করতে পারি না, কেবল পড়ার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানতে চাই, বুঝতে চাই, ভালবাসতে চাই, তারা এই উত্তরসত্য যুগে যদি রবীন্দ্রনাথের কিছু প্রেক্ষিত বিহীন উদ্ধৃতির ওপর ভিত্তি করে উপসংহার টানি, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করি তাহলে আমরা নিজেদের অজান্তেই প্রবঞ্চনার শিকার হবো। সামাজিক মাধ্যমে ঘোরাফেরা করা হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির কল্যাণে রবীন্দ্র বীক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। রবীন্দ্রনাথকে জানতে বুঝতে বলে একটা ফেসবুক পোস্ট এর বাইরে আমাকে আপনাকে কিছুটা সময় দিতে হবে সুধী পাঠক, এবং খোলা মনে, অন্ধ ভক্তের চশমা চোখে দিয়ে নয় -এটাই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের প্রার্থনা।
দ্যাটস্ ইট।ব্যস্ কেউ তো আমার সঙ্গে সহমত হলো।
আমার যেটা মনে হয়,রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ প্রীতি বা পাশ্চাত্য প্রীতি আমাদের দূর্ভাগা দেশ সম্বন্ধে তাঁকে কখনোই উদ্ভ্রান্ত করে নি।তিনি যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন এ পৃথিবীর ভবিষ্যত সম্বন্ধে। আমরা সাধারণ পাঠকরা যতটা হতাশ হয়ে পরেছি সেই অষ্টাদশ ঊনবিংশ শতক থেকে তিনি ততটা হন নি।রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার হালচালের পরিচয় পেয়ে রাশিয়াকে সভ্যতার রক্ষক মনে করেছিলেন। কিন্ত পরে দেখা গেলো রাশিয়ার বর্তমান মনোভাব পুরো সাম্রাজ্যবাদের পরিণত।আর বলশেভিকদেরও তো তখন পৃথিবীর ঐ অচল অবস্থায় নিজেদের ইস্তেহার বোঝাতেও সময় লেগেছে। সব মিলিয়ে দারুণ।
রবি ঠাকুর কে কয়েক টা প্রেক্ষিত ছাড়া কোটেশনে ফেলে দিলে তা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তাঁকে বোঝা বা বোঝানো কঠিন তো হবেই।ছ্যাবলামির নামান্তর অন্যতম।
বলশেভিক রা নিজেরাই কি তখন পৃথিবীর ঐ উথালপাথাল অবস্থানে জার তন্ত্র আর নিজেদের মধ্যের পার্থক্যের সুস্পষ্ট ধারণা দিতে বা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল জনমানসে। আর রবীন্দ্রনাথ তো ভগবান নন।তাঁকে ভগবান বানিয়ে সব দায় দোষ সমালোচনার আখরা বানিয়ে একধরনের কন্ট্রোভার্সির জাবর কাটা।এটাই ।এই আর কি!
উনি মহামানব আবার একদিকে সাধারণ মানুষ তথৈবচ।সেই মানুষের কথাই লিখেছেন লিখে গেছেন। নিজেও খুব নরম মন স্বভাবী সহজ সরল চিরআধুনিক একজন কবিমানসী।