যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য সামন্ত্যক দাস কাল আত্মহত্যা করেছেন। অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। কিছুদিন আগেই (এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি) আমার পুরোনো কলেজ “কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ”-এর রিউনিয়নের “বিতর্কসভায়’ অন্যতম বক্তা ছিলেন উনি। খুব সামনে থেকে ওনার অনবদ্য বক্তব্য শুনেছিলাম। তাই খারাপটা আরেকটু বেশী লাগছে।
এই “আত্মহত্যা” বিষয়ে বছর দুয়েক আগে আমার একটা লেখা ছিল, “#মন_নিয়ে_কথকতা বলে আমার একটি সিরিজের অংশ হিসেবে। লেখাটি আবার দিলাম। কোনো প্রশ্ন থাকলে করবেন, যথাসম্ভব উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
#মন_নিয়ে_কথকতা
(বিশেষ পর্ব/ “আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস” উপলক্ষে)
এই দিনসাতেক আগের কথা। ইমারজেন্সি নাইট ডিউটি করছিলাম, অনেকদিনের পার্টনার সব্যসাচীর সঙ্গে।
হুড়মুড়িয়ে রোগী আসছিল।
অ্যাক্সিডেন্ট ছিল বেশ কিছু, বাইক-টাইক নিয়ে আছাড় খেয়ে, মাথা, মুখ ফাটিয়েছেন, হাত, পায়ে কাটাকুটি। বেশিরভাগটাই নেশার ঘোরে।
এছাড়া জ্বর, পেটে ব্যথা, সাপ বা ইঁদুরের অজানা কামড়, শ্বাসকষ্ট, বুক ধরফর, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, এইরকম নানা কিসিমের নানা শারীরিক সমস্যা নিয়ে নানা বয়সের মানুষ।
আর ছিল, বিষ খেয়ে আসা রোগী। কমবয়সী মেয়ে, মধ্যবয়স্কা মহিলা, প্রৌঢ়, জোয়ান ছেলে… সব ধরনের ছিল। সব মিলিয়ে ঘণ্টা আটেকের সময়ে অন্তত: ছয় জন, নাকি সাত!
বেশীর ভাগই খেয়েছিলেন নানা ধরনের কীট নাশক, কেউ ইঁদুর-মারা বিষ। এখন কীটনাশক নানা ধরনের হয়। ফলে প্রতিষেধক, চিকিৎসা সম্পর্কে ভাল ওয়াকিবহাল থাকা যায়না, অনেকসময় শুধুমাত্র লক্ষণের উপর নির্ভর করেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে হয়।
এছাড়া একজনের ছিল গলাকাটা, মানে গলার সামনের অংশ ক্ষতবিক্ষত করে কাটা। ছেলেটি নিজেই কেটেছে। দুপুরে কেটেছে, আর রাত্রে এল হাসপাতালে, কতটা রক্তপাত হয়েছে বলা শক্ত।
যাহোক, এই বিষ খাওয়া বা গলাকাটার মূল উদ্দেশ্য ছিল আসলে নিজেকে মেরে ফেলা। অনেকে মরে যায়, অনেকে মরে না। ঘটনাচক্রে সেইদিন মরে যাওয়ার সম্ভাবনা কারোর মধ্যে ছিল না। কিন্তু অনেকদিন মরো মরো বা হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মরে যাওয়া রোগী আমরা পেয়েছি।
হ্যাঁ, বিষয়টা হচ্ছে আত্মহত্যা… সফল বা অসফল। নানা ভাবে চেষ্টা করা হয়। বিষ খাওয়া বাদ দিলে আরেকটি বহুপ্রচলিত পদ্ধতি হল, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পরা। সামান্য সময় ঝুলতে পারলেই মৃত্যু নিশ্চিত।
এছাড়া আরো কিছু ভয়ানক পদ্ধতি আছে, অনেক উচ্চতা থেকে লাফ দেওয়া, ট্রেনের সামনে ঝাপিয়ে পরা, নদীতে ঝাঁপ দেওয়া…
এগুলো হল সব পদ্ধতি। অনেকেই এই পর্যন্ত পড়ে হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন, আত্মহত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কেন এত পদ্ধতি নিয়ে সাতকাহন করছি!
সেইকথায় পরে আসছি, আগে সকলের কৌতুহল দূর করার জন্য আত্মহত্যার কারণ, প্রকৃতি, এইসব নিয়ে একটু কথা বলি।
বিষয়টা হচ্ছে, নিজে নিজেকে মেরে ফেলা। তারমানে কোনো একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে কারো মনে হচ্ছে, বেঁচে থাকার থেকে মরে গেলে, বা নিজেকে মেরে ফেললে অনেক বেশী যন্ত্রণার উপশম। কেন মনে হয় তাই নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কিছু বিশ্লেষণ আছে, আবার মনোবিদ্যার কিছু ব্যাখ্যা আছে। সামাজিক ব্যাখ্যাও আছে। সবটাই যে সর্বোতভাবে গ্রহণযোগ্য তা নয়, তবে মোটামুটি যেটা বলা যায়, সেটা হচ্ছে দুই ধরনের আবেগের প্রভাবে এই আচরণ হয়ে থাকে, যার একটা হচ্ছে ভীষণরকম তাৎক্ষণিক, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে একটা কাজ করে ফেলা।
আরেকটা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। বেশ কিছুদিন ধরে ভেবেচিন্তে বেশ একটা পরিকল্পনা করে নিজের মৃত্যু নিজে ডেকে আনার চেষ্টা।
দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে মানসিক অবসাদ একটি সবচেয়ে গ্রাহ্য কারণ। অন্যান্য কিছু মানসিক সমস্যাও কারণ হতে পারে। আবার নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক চাপ ও কারণও থাকতে পারে, যা সাময়িক মানসিক বৈকল্য ডেকে আনছে।
যখন ইমারজেন্সি রুমে ডিউটি করি, তখন আমাদের কাজ দাঁড়ায় কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করে ফেললে তাকে দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করা।
কিন্তু যখন মানসিক রোগের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করি তখন দায়িত্ব দাঁড়ায় যার চিকিৎসা করছি তার আত্মহত্যা করবার প্রবণতা কতটা তা যাচাই করে সেই অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, শুধু ওষুধের মাধ্যমে হোক বা তারসঙ্গে অন্যকিছু বন্দোবস্ত করে হোক।
এইক্ষেত্রে “risk assessment” অর্থাৎ বিপদের সম্ভাবনা কতটা আছে তা যাচাই করা বিশেষ জরুরী হয়। আর সেই অনুযায়ী তৈরী হয় প্রতিরোধের পরিকল্পনা।
কিন্তু যেখানে কাজটা হয় তাৎক্ষণিক আবেগের বশে, বা “আত্মহত্যার প্রবণতা” বিষয়ে কোনও আগাম খবরই থাকে না, চিকিৎসকের কাছে আদৌ নাই এসে থাকে?
এটাই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের জায়গা, আর এরজন্যই প্রথমে “পদ্ধতি” নিয়ে সাতকাহন গাইছিলাম।
আমাদের দেশে যে পদ্ধতির ব্যবহার সর্বাধিক হয়ে থাকে, প্রথমেই যে কথা বলছিলাম, সেটাই, অর্থাৎ কীটনাশক খেয়ে। গ্রামপ্রধান ও কৃষিপ্রধান দেশে এটাই সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। তাহলে এমন কিছু করা দরকার যাতে কীটনাশকের বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। এরজন্য সরকারের একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। এই বিষয়ে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সেখানে ১৯৯৫ সাল থেকে এই ধরনের কর্মসূচী নিয়ে চলায় আত্মহত্যার হার প্রায় ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে, আনুমানিক মৃত্যু কমেছে ৯৩ হাজারের মতো। (তথ্যসূত্র : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)
এদেশের অত্যন্ত সন্মানীয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: লক্ষ্মী বিজয়কুমার যিনি জীবনের বেশিরভাগটাই, এই “আত্মহত্যা প্রতিরোধ” বিষয়ে কাজ করে গেলেন, তিনি এই বিষয় নিয়ে একটি সুসংহত পরিকল্পনার রূপরেখা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রেখেছিলেন অনেকদিন আগে, কিন্তু তাই নিয়ে কোনো সদর্থক বড়সড় কাজ শুরু হয়েছে বলে খবর পাইনি।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পরীক্ষার আগে বা চলাকালীন বা ফলপ্রকাশের পরেপরেই ছাত্র ছাত্রীদের তাৎক্ষণিক আত্মহত্যা বা তার চেষ্টার ঘটনা ঘটে থাকে প্রচুর।
আত্মহত্যার ইচ্ছা মনের মধ্যে তৈরী হলে সাহায্য করার জন্য নির্দিষ্ট “হেল্পলাইন” দেশজুড়ে গড়ে তুলতে পারলে লাভ ছিল। কিন্তু কয়েকটি এন জি ও (NGO) দ্বারা পরিচালিত কিছু হেল্পলাইন আঞ্চলিকভাবে কাজ করে, জাতীয় হেল্পলাইন এখনো দূর অস্ত। উন্নত সব দেশেই কিন্তু এই ধরনের ব্যবস্থা আছে।
আরেকটি বিপজ্জনক প্রবণতা হচ্ছে, বয়স্কদের আত্মহত্যা। মানুষের বেঁচে থাকার গড় বয়স চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সূত্রে অনেকটাই বেড়েছে আর এই সূত্রে বেড়েছে বয়স্ক মানুষদের নিঃসঙ্গতা, নিরাপত্তাহীনতা। সেই সূত্রেই আত্মহননের হারও বাড়ছে।
২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে বছরে আত্মহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় আট লক্ষ, আর তারমধ্যে আমাদের দেশে প্রায় এক লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার। এগুলো সবটাই নথিভুক্ত ঘটনা, আর এদেশে অনেক ঘটনাই থেকে যায় নথির বাইরে, তাই সংখ্যাটা আরো বেশী হতে পারে। চিন্তার বিষয় হল আমাদের দেশে আত্মহত্যার চেষ্টা এবং তার ফলে মৃত্যু, এই হার ক্রমবর্ধমান।
তথ্য পরিসংখ্যান ছেড়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জগতে ফিরি। অনেকগুলি আত্মহত্যার চেষ্টা ও মৃত্যুর ঘটনা মাথায় আছে, তারমধ্যে থেকে সামান্য উল্লেখ করি।
একটি ছেলে, অল্পবয়সী, আমাকে চেম্বার আর হাসপাতাল, দুই জায়গাতেই দেখাতো। মানসিক অবসাদ ছিল, পাশাপাশি শরীর নিয়ে নানারকম দুশ্চিন্তা। অনিয়মিত ছিল চিকিৎসা। একদিন শুনি সে বাথরুম পরিষ্কারের “হারপিক” খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। পরে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। অনেকদিন চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়। মানসিক সমস্যারও চিকিৎসা আবার শুরু হয়, কিছুটা ভাল হয়ে ওঠে। …. কিন্তু আবার। এবারে অন্য পদ্ধতি। ঝুলে পড়া। আর বাঁচেনি।
আরো বেশ কিছু মৃত্যুর কথা মনে আসছে। সেগুলো থাক। বরং অন্য একটি ঘটনার কথা বলি।
শহরের একটি নার্সিংহোম-এর HDU তে আমাকে একবার ডেকে পাঠায়। দেখি, একটি অল্পবয়সী মেয়ে, বিবাহিতা, কাছাকাছি গঞ্জে থাকে, ভর্তি আছে। সাংসারিক অশান্তি, তাই নিয়ে অবসাদ, গলায় দড়ি দিয়েছিল, কিন্তু খুব জোর বাঁচানো গেছে। অত্যন্ত সংকটময় সময় পেরিয়ে তখন শারীরিকভাবে সুস্থতার পথে। মানসিক সমস্যার চিকিৎসা শুরু হয়। স্বামী চিকিৎসার ব্যাপারে আন্তরিক ছিল। আস্তে আস্তে সুস্থ হয়। পরে একটি ছেলের মা হয়ে সুস্থভাবেই সংসার করছে, যদিও চিকিৎসা চালু রাখতে হয়েছে, মাঝেমধ্যে কিছু সুবিধা -অসুবিধা হলেও মোটের উপর ভালই আছে।
সবশেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর বর্তমান প্রধানের একটি সতর্কবার্তা শুনিয়ে রাখি, “সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে এখন পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যার কারণে মারা যায়। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সর্বাত্মক উদ্যোগ তাই ভীষন জরুরী। পৃথিবীর সবদেশেই এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কর্মসূচী নেওয়া প্রয়োজন”।
একটি বিশেষ তথ্য দিয়ে শেষ করবো। সারা পৃথিবীতে, ১৫ থেকে ২৯ – এই বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আত্মহত্যা, দুর্ঘটনার পরেই। চিন্তার কারণ নয়?? (তথ্যসূত্র : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)
এইসব হাবিজাবি লিখতে লিখতেই কখন যেন পার হয়ে গেলো দিনটা। হ্যাঁ, গতকাল, ১০ই সেপ্টেম্বর ছিল “বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস” !!!
আমাদের মতো মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে অবশ্য রোজই “আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস”….
(ছবি ইন্টারনেট সূত্রে)