থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত সমস্যা। এই রোগে মানুষের রক্তের লোহিতকণিকা খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রোগীর অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা যায় এবং রক্তের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। সাধারণতশৈশবকালেই এই রোগ ধরা পড়ে। কয়েক বছরের মধ্যেই শিশুর প্লীহা (Spleen) বড়ো হয়ে যায়, হাড় দুর্বল হয়ে যায় এবং শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়। শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতি মাসে এক বা একাধিক বার রক্ত সঞ্চালন করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ২০-৩০ বছর বয়সের মধ্যেই বাচ্চা মারা যায়।
পৃথিবীতে যত থ্যালাসেমিয়া রোগী আছে তার মধ্যে দশ শতাংশই বাস করেন ভারতবর্ষে। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫০০ শিশুর জন্ম হয় থ্যালাসেমিয়া জাতীয় সমস্যা নিয়ে। ভারতীয়দের মধ্যে প্রতি ৩০ জনের মধ্যে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আর স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যখন এই রোগের বাহক হন তখন সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হবার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। ইংরেজি ভাষায় বাহকদের বলা হয় carriers বা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Mainor) আর রোগীদের বলা হয় থ্যালাসেমিয়া মেজর (Major)।
এবার দেখে নেওয়া যাক বাবা-মায়ের কাছ থেকে থ্যালাসেমিয়া রোগ সন্তান-সন্ততির কাছে কীভাবে পৌঁছোয়। মানুষের শরীরে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য এক জোড়া জিনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। এর একটি আসে বাবার কাছ থেকে আর একটি আসে মায়ের কাছ থেকে। বংশগত রোগের ক্ষেত্রেও একই সূত্র প্রয়োজন। যাদের শরীরে এই দুই জোড়ার মধ্যে একটি ভালো জিন অন্যটি মন্দ জিন তারা হলেন সেই রোগের বাহক। যাদের শরীরে রোগের জন্য দায়ী দু-টি মন্দ জিনই উপস্থিত থাকে তারা হলেন সেই রোগের রোগী। অর্থাৎ বাবা-মা দু-জনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক (Thalassemia Mainor) হন এবং তাঁদের মন্দ জিনটি সন্তানকে দেন তাহলে তাঁদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগটি (Thalassemia Major) হয়। এর সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। আর বাবা-মায়ের মধ্যে যদি একজন ভালো জিনটি দেন এবং আর একজন মন্দ জিনটি দেন তাহলে তাঁদের সন্তান হন থ্যালাসেমিয়ার বাহক। এর সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ। যদি দু-জনেই ভালো জিনটি দেন তাহলে সন্তান সম্পুর্ণভাবে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত হন। এর সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, বাবা-মা কে কোন জিনটি দেবেন সেটি কিন্তু কারও নিয়ন্ত্রনে নেই। সম্ভবত প্রকৃতির খেয়ালেই সে ঘটনা ঘটে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে কোনো মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা কীভাবে জানবেন। এর জন্য খুব সাধারণ একটি রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন। এর নাম HPLC। এই টেস্টের জন্য প্রায় চারশো টাকা খরচ হয়। সন্তান চাইছেন এ-রকম সব দম্পতির এই টেস্ট করিয়ে নেওয়া ভালো। সাইপ্রাস (Cyprus) দেশে আইন করে দু-জন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিবাহ বন্ধন করে দেওয়ার ফলে সে দেশ থেকে এই রোগ প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। ভারতবর্ষে এ-ধরনের আইন প্রণয়ন সম্ভব নয়। কারণ এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে পারে।
ধরা যাক বিয়ের পর বা গর্ভাবস্থায় প্রথম দু-মাসের মধ্যে জানা গেছে বাবা-মা দু-জনেই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। তাহলে কী করণীয়? প্রথম কথা, ঘাবড়াবেন না। এই পরিস্থিতিতেও বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া মেজর হবার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। বাকি ৭৫ শতাংশ বাচ্চা কিন্তু সুস্থ। এই সমস্ত বাবা-মায়ের রক্তে এর পর একটি করে জিন টেস্ট করতে হয়। তাতে বোঝা যায় ঠিক কী ধরনের জেনেটিক সমস্যা বা মিউটেশন-এর জন্য তারা থ্যালাসেমিয়া বাহক হয়েছেন। বাবা-মায়ের রক্তে সঠিক মিউটেশন চিহ্নিত করার পর আসে ভ্রূণ পরীক্ষার পালা। ভ্রূণের মধ্যে ওই দু-টি মিউটেশনই থাকলে তবেই বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া মেজর হবে। যেকোনো একটি মিউটেশন থাকলে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া মাইনর হবে। আর কোনো মিউটেশনই না থাকলে বাচ্চা সম্পুর্ণভাবে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত হবে।
এবার আসি ভ্রূণ পরীক্ষাসংক্রান্ত কিছু কথায়। ভ্রূণ পরীক্ষারর জন্য মূলত যে টেস্ট করা হয় তার নাম CVS (Chorionic Villus Sampling)। এর অর্থ বাচ্চার সাথে যে ফুলটি (Placenta) থাকে তার সামান্য অংশ বের করে পরীক্ষা করা। গর্ভাবস্থার তিন মাস পর থেকে এই টেস্ট করা যায়। USG মেশিনে দেখতে দেখতে মায়ের পেটের মধ্যে একটি বিশেষ ছুঁচ (Needle) পাঠিয়ে এই কাজ করা হয়। মাকে এজন্য অজ্ঞান করতে হয় না। তবে, মায়ের পেটের সামান্য একটু অংশ অবশ করে নেওয়া হয় যাতে ব্যথা না লাগে। CVS থেকে প্রাপ্ত নমুনা (sample) এবার পাঠিয়ে দেওয়া পরবর্তী পরীক্ষার জন্য। রেজাল্ট পেতে সময় লাগে সপ্তাহ দুয়েক। CVS সম্পর্কে একটি কথা অবশ্য জানা প্রয়োজন। শতকরা ৯৯ জনের কোনো সমস্যা হয় না তবে এক শতাংশের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বাচ্চা সুস্থ কিনা জানতে হলে এইটুকু ঝুঁকি নিতেই হয়। আপনাকে ভাবতে হবে ঝুঁকি এখন নেওয়া ভালো না কি সারাজীবন একটি অসুস্থ্য সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া ভালো।
নানারকম টেস্টের জটিলতায় এতক্ষণে হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন এর ব্যয়ভার সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই সমস্তত টেস্টের খরচ আনুমানিক ১৫-২০ হাজার টাকা। যারা এত খরচ করতে পারবেন না তারা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ বা নীলরতন সরকার হাসপাতালের হিমাটোলজি বিভাগে যেতে পারেন। এই দুই হাসপাতালের বাইরে পশ্চিমবঙ্গে আর কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে জন্য ভ্রূণ পরীক্ষা হয় কিনা লেখকের জানা নেই। সরকারি হাসপাতালের টেস্ট কম বিশ্বাসযোগ্য এ-রকম ভাবার কোনো কারণ নেই।
এখন ধরে নেওয়া যাক গর্ভাবস্থায় চার মাসের মাথায় একটি ভ্রূণের থ্যালাসেমিয়া মেজর ধরা পড়েছে। তাহলে কী করণীয়? এ-রকম পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মা-বাবাই গর্ভপাতের রাস্তা বেছে নেন। ভারতবর্ষে নিয়মানুযায়ী ২০ সপ্তাহ বা পাঁচ মাস পর্যন্ত বাচ্চা নষ্ট করানো যায়। সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত ডাক্তারের কাছে গর্ভপাত করালে মায়ের স্বাস্থ্যহানির বিশেষ আশঙ্কা থাকে না। পরবর্তীকালে গর্ভধারণেও কোনো অসুবিধা হয় না। মনে রাখতে হবে বাবা-মা থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে যতবার প্রেগন্যান্সি আসবে ততবারই ভ্রূণের পরীক্ষা করাতে হবে।
থ্যালাসেমিয়া রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা হয় না। রোগ উপশম-এর জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়ে রোগীকে সাময়িক সুস্থ রাখা যায় মাত্র। বারংবার রক্ত সঞ্চালনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও (Side-effects) অনেক। কয়েক বছর বাদেই প্লীহা বাদ দেবার জন্য অপারেশন (Splenectomy) করতে হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (Bone Marrow transplant) এবং স্টেম সেল প্রতিস্থাপন এর মতো আধুনিক চিকিৎসা ভীষণ ব্যয়বহুল। সব ক্ষেত্রে সফলও হয় না। এজন্য এই মারণ-রোগের হাত থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে একটাই রাস্তা, প্রতিরোধ। বিয়ের পর-পরই স্বামী-স্ত্রী থ্যালাসেমিয়া কেরিয়ার কিনা জানার জন্য HPLC Test অবশ্যই করানো উচিত। দু-জনের মধ্যে যেকোনো একজন যদি থ্যালাসেমিয়া মুক্ত থাকেন তাহলেই আর কোনো চিন্তা থাকে না। যদি দু-জনেই থ্যালাসেমিয়া কেরিয়ার হন তাহলে দু-জনেরই জিন টেস্ট করা প্রয়োজন। তারপর বাচ্চা এলে ভ্রূণের পরীক্ষা করানো অবশ্যকর্তব্য। আর একবার মনে করিয়ে দিই, এই পরীক্ষাগুলো করাতে অন্য কোথাও যেতে হয় না। কলকাতাতেই অন্ততপক্ষে দু-টি সরকারি হাসপাতালে এই সমস্ত পরীক্ষা করানো যায়। খরচও বেশি নয়। সামান্য একটু সচেতনতা দেখাতে পারলেই থ্যালাসেমিয়ার মতো মারণ রোগের প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অসাধারণ মানবিক উদ্যোগ….
ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করবো না…
পাশে আছি ডক্টর ডাইলগ্স