রোবোটের মত হয়ে গেছি বহুকাল হল। নিয়ম করে ঘুম থেকে ওঠা, নিয়ম করে প্রাত্যহিক ঘরের কাজ সেরে রোগী দেখা, প্রতিদিন অসংখ্য সমস্যার কথা শোনা, সমাধান করার চেষ্টা করা, ফের বাড়ি ফেরা, খাওয়া দাওয়া ঘুম- সব যেন ঘড়ির কাঁটায় মিলিয়ে মিলিয়ে!
একঘেয়েমি কোন লেভেলে যেতে পারে – এখন বুঝতে পারছি।
ক’দিন আগে এরকমই এক সকালে বসেছি পরীক্ষা করতে। একের পর এক রোগী। প্রত্যেকের আলাদা সমস্যা। রোগীদেরও দেখে মনে হয় রোবোট হয়ে গেছে!
অসহায় মুখে নিজের সমস্যার কথা বলা, কি হয়েছে জানা, কি করা যাবে সেটা জানা – অসুখ বোধহয় মানুষকে খানিকটা রোবোটের মতোই ব্যবহার করতে শেখায়।
এ যন্ত্রণা জানি। এই যন্ত্রণা প্রতি দিন ভিজিয়ে দিতে থাকে। এক আশ্চর্য নীরবতা গ্রাস করে।
হঠাৎ ঘরের বাইরে জোর চিৎকার চেঁচামেচি। কেউ একজন জোরে চিৎকার করে যাচ্ছেন। এগুলোও নিয়মিত চলতে থাকে। হয় দেরী হয়েছে, নয়তো লাইনে পিছিয়ে পড়েছেন বা কাউকে জরুরী বলে আগে ডাকা হয়েছে। অসুস্থ হলে ধৈর্য ধরাটা অসম্ভব হয়ে ওঠে, কিন্ত সেটা না করে উপায় থাকে না।
মাঝে মাঝে নিজে বাইরে বেরিয়ে রোগীদের বুঝিয়ে আসি। খানিকক্ষণ শান্ত থাকেন সবাই। আবার শুরু করেন চেঁচামেচি।
সেদিন অবশ্য তেমন হবার ছিল না। তাই জিজ্ঞেস করলাম – কি হয়েছে?
সহকারী জানালো – ভদ্রলোক সকাল থেকে এসেই ঝামেলা শুরু করেছেন।
বললাম – ভেতরে ডাকো ওনাকে।
সহকারী বললো – স্যার ডাকবেন না! মহা বদমাশ লোক।
বললাম – আরে যেই হোক, ডাকো। তার আগে বলো – সমস্যা কি?
সহকারী ডাকার আগেই ভদ্রলোক নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেই ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছেন।
অন্য কোন জায়গা হলে ঘাড় ধাক্কা খেতেন অবধারিতভাবে। কিন্ত ডাক্তারিতে এসে বুঝেছি – এই ধরনের অসভ্যতা এখানে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। হ্যাঁ দোহাই সেই একটাই – মানুষ অসুস্থ। আর আমি ডাক্তার!!
আমি যথারীতি চেয়ারটা ঘুরিয়ে তাকালাম। বললাম – সমস্যা কি বলুন।
ভদ্রলোক প্রায় অসভ্যের মত চিৎকার করছেন – কি হয়েছে মানে! চিটিং হয়েছে চিটিং!
– মানে? কি বলছেন বুঝিয়ে বলুন।
– বুঝিয়ে কি বলবো! এখানে তো আসা অব্দি ঝামেলি! পরীক্ষা করাতে তিন ঘণ্টা বসে ছিলাম। তারপর কি পরীক্ষা হয়েছে, দেখতে ও পাইনি। তারপর তো ঝামেলির শেষ নাই!
ঝামেলিটা কি ঝামেলার স্ত্রী লিঙ্গ? জানি না। হাসি পাচ্ছে, হাসতে পারছি না।
বললাম – আগে সব খুলে বলুন। এভাবে কিছু বোঝা যায় না।
– আরে কি ঝামেলি! এত্তো টাকা দিয়ে পরীক্ষা করালাম। ডাক্তার তো পরীক্ষাই করেনি!
মারাত্মক অভিযোগ। ইউএসজি তো আমিই করি। ইনি যা বলছেন, তার মানে দাঁড়ায় আমার বদলে অন্য কেউ ইউএসজি করেছে, এবং সে ডাক্তার নয়!
বললাম – কি পরীক্ষা হয়েছে আপনার?
– আরে ঝামেলি তো মশাই! আমার পরীক্ষা হবে কেন! হয়েছে আমার বউ এর। ঝামেলি হলো, সেটা তো ডাক্তার করেইনি!
বললাম – আপনার রিপোর্ট দিন। কবে কি পরীক্ষা হয়েছে বলুন। দেখছি।
সবাই জানে, ইউএসজি একমাত্র স্বীকৃত রেডিওলজিস্টদেরই করার কথা। অন্য কেউ করলে সেটা একপ্রকার ভুয়ো ডাক্তারি! আর এখানে যেহেতু আমিই করি, তাই সে প্রশ্ন ওঠে না।
সহকারীর খানিকটা রাগ হলো। সে জিজ্ঞেস করলো – কে বলেছে ডাক্তার পরীক্ষা করেনি? কে বলেছে বলুন।
ভদ্রলোক ততোধিক অসভ্যের মত চেঁচিয়ে বললেন – সব জানি। এখানকার এই মেয়েরা কেউ করেছে।
অভিযোগ মারাত্মক ভেবে আমি বললাম – আগে রিপোর্ট আনুন। তারপর দেখছি।
সহকারী জানালো – দুদিন আগে ভদ্রলোকের মিসেস-এর প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ইউএসজি হয়েছে। আমিই করেছি।
ভাবলাম – কোথাও ভুল হয়ে থাকতে পারে। আগে দেখে নিতে হবে।
বললাম – আগে রিপোর্ট দেখবো। তারপর আপনার কথা শুনবো। আনুন।
ভদ্রলোক বললেন – ঝামেলি করবেন না বলে দিলাম। এখানে ডাক্তার ছবি করে না! প্রমাণ আছে।
এবার রাগ হলো। বললাম – আপনি কে মশাই? কি করতে এসেছেন? আগে রিপোর্ট আনুন। কোথায় ঝামেলি দেখবো আগে। তারপর অভিযোগ করবেন।
– রিপোর্ট নাই!
– মজা করার জায়গা পাননি! কে বলেছে ডাক্তার পরীক্ষা করেনি? আপনার মিসেসকে ফোন করুন। এখানকার মেয়ে না ডাক্তার পরীক্ষা করেছে বোঝা যাবে।
ততক্ষণে আমি রিপোর্ট বের করেছি কম্পিউটারের ফাইল থেকে। সহকারীরা এসব জানে।
ভদ্রলোক মিসেসকে ফোন করলো। ভদ্রমহিলা খানিকটা ধরা গলায় বললেন – একজন পুরুষ মানুষই করেছে পরীক্ষা।
প্রথম সমস্যা মিটলো?
না! ভদ্রলোক থামলেন না। এঁরা যে কি দিয়ে তৈরি কে জানে!
– বলুন এবার কি বলবেন।
– ঝামেলি বাড়াবেন না। এখানে কিসের পরীক্ষা হয়? একটা ও ঠিক হয় না!
এবার রাগ বাড়ছে। তবুও বললাম – ভুল কোথায় হয়েছে বলুন। এই তো রিপোর্ট। এর পরে অন্য কোথাও পরীক্ষা করেছেন যে ভুল বলছেন?
– কি ঝামেলি। পরীক্ষা করাবো কেন?
রোবোট হলেও মেজাজ ধরে রাখা কঠিন। বললাম – তাহলে ভুলটা বুঝলেন কি করে?
ভদ্রলোক অভদ্রের মতো কথা বলেন। – ঠিক হয় কেমনে? পরীক্ষা করালাম। রিপোর্ট এলো দু’সপ্তাহ পরে বাচ্চা হবে। পরের দিনই নর্মাল ডেলিভারি হয় কি করে?
দেখলাম – ভদ্রমহিলার পেটের বাচ্চার বয়স এসেছে পঁয়ত্রিশ সপ্তাহ। মানে আর দুই সপ্তাহ পর বাচ্চা জন্মালে নিয়মমতো সেটা ঠিক। তার আগে বাচ্চা জন্মেছে।
আমি কয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন করলাম। ব্যথা হয়েছিল কিনা, অ্যামনিওটিক ফ্লুইড বেরিয়ে গিয়েছিল (সাধারণ মানুষের কাছে জল ভাঙা) কিনা – ইত্যাদি।
ভদ্রলোক কি বুঝেছেন কে জানে। চেঁচিয়ে বলতে থাকলেন – এই রকম ঝামেলি হয় কি করে ?
আমার পরীক্ষার টাকাটা পুরা জলে গেল! বাচ্চা যদি পরের দিনই হবে, তাহলে পনের দিন পর বললেন কেন? পয়সা ফেরত দিন না হলে ঝামেলি কারে কয় দেখিয়ে দেব!
এতোক্ষণে পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হলো। এবার আমি আর পারলাম না। এই ঝামেলি দূর করতে হবে। বললাম – আপনি আমার সাথে আসুন।
ভদ্রলোককে নিয়ে বাইরে বেরোলাম। ওয়েটিং রুমে অনেক রোগী অপেক্ষা করছেন। সাথে বাড়ির লোকজন। সবাই তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে। কারণ এই ভদ্রলোক কাজের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।
সবার সামনে গিয়ে ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললাম – এই যে ভদ্রলোক, এনার ঝামেলি শুনুন আপনারা।
দু’সপ্তাহ আগে বাচ্চা জন্মেছে বলে, ওনার অভিযোগ ছিল, ডাক্তার পরীক্ষা করেনি। সেটা নিয়ে
ওনার বউ ওনার মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন।
তারপর অভিযোগ – বাচ্চা কেন আগে জন্মালো?
আপনাদের মধ্যে ইউএসজি করানোর অভিজ্ঞতা আছে যাদের, বা এমন কেউ আছেন যাঁরা জানেন যে বাচ্চা সময়ের আগেই জন্মাতে পারে?
দেখলাম ভিড়ের মধ্যে থেকে দশ পনের জন জানালেন যে – এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। আমাদেরই হয়েছে। এই নিয়ে সময় নষ্ট?
তারপর যা হয় – ভিড়ের মধ্যে থেকে ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে ছুটে এলো অগুণতি গালাগালি। যে যা পারলো – ভাষার সুমিষ্ট ব্যবহার করে নিল। সবার সময় নষ্ট করার জন্য, ডাক্তারকে অকারণে হ্যারাস করার জন্য যে সকল বাক্যবাণ ছুটে এলো, আমি তো উচ্চারণই করতে পারবো না।
ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলেন। অবশেষে বিড়বিড় করতে করতে লেজ গোটালেন। আমিই সবাইকে থামিয়ে দিলাম শেষে।
ঝামেলি শেষ হলো?
না। কেউ ভাববেন না যে – এই অন্য লোকগুলো সব বুঝে শুনে নিয়েছেন। মোটেই না।
এই এঁদের ভিড়ে রয়েছেন এমন অনেক মানুষ, যাঁরা সময় সুযোগ পেলেই এমন ঝামেলি পাকাতে ওস্তাদ।
মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে, এমনকি সাধারণ বোধ বুদ্ধিরও এতো অভাব দেখি প্রতিদিন যে এই ঘটনা টা কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন নয়!
আমার বা আমাদের বুক ফোলে না এতে। কাজ করার জন্য যে সুস্থ সুন্দর পরিবেশ দরকার হয়, তার শ্রাদ্ধ হয় শুধু। পরিষেবা পাওয়া ক্রমশঃ জটিল হয়ে ওঠে। ফল ভোগ করেন সবাই!!
তাই অনুরোধ, ডাক্তারের সাথে ঝামেলি করার আগে, মানে লাফ দিয়ে উঠে জামার হাতা গুটিয়ে নিজেকে বীরপুঙ্গব প্রমাণ করার আগে খানিকটা হলেও পড়াশোনা করতে হয়!! খানিকটা যুক্তি তর্ক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হয়।
সবচেয়ে বড় কথা হলো- আপনার সমস্যা আপনাকে প্রথমে বলতে হবে ডাক্তারকেই! যিনি চিকিৎসা করছেন তাঁকে বলতে পারেন, সন্তুষ্ট না হলে অন্য ডাক্তারকে বলতে পারেন, না হলে আইনকানুন মেনে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারেন!! ভিড়ের মধ্যে থেকে আপনার সাপোর্টে যে লোকটি এগিয়ে এলো, সেই লোকটি কি আদৌ কিছু জানেন কিনা, সেটা না বুঝে দলভারী করে ঝামেলি করাটা আর যাই হোক বুদ্ধির পরিচয় নয়!!!
শেষ কথা – আপনাকে বুঝতে হবে, স্বাস্থ্য পরিষেবা এখন আর সেবা নয়! বাজার থেকে চাল ডাল তেল আলু পেঁয়াজ যেমন কিনে আনেন, কাঁকড়া বা পচা গন্ধটুকু যেমন মুখ বুজে সহ্য করে নেন অবলীলায় , ঠিক তেমনি সহ্য করতে হবে এক্ষেত্রে ও ! আর যদি বা সেবা হয়, সেক্ষেত্রে ঝামেলি করাটা নির্বুদ্ধিতা!!
তবু ও বলবো – শরীর অসুস্থ হলে মানসিক চাপের দোহাই দিয়ে হল্লা শুরু করবেন না। বরং একটুখানি ধৈর্য রাখুন। ডাক্তারের উপর বিশ্বাস রাখুন। দেখবেন ঝামেলি করার দরকার পড়বে না।