ডাক্তারির সামান্য খুঁটিনাটি নিয়ে মাঝে মাঝে লিখতে ইচ্ছে করে। অথচ সব সময় সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
সত্যি বলতে – নিজেকে, পরিবারকে দেয়ার মত সময়টুকুরই অভাব সবচেয়ে বেশি হয়ে যায়!
অথচ, যতটা সময় ডাক্তারি করতে চলে যায়, তার তুলনায় এই দরকারে খুব সামান্য সময়ই লাগে!
তাই যতটুকু সময় পাওয়া যায়, সেটুকুতে পরিবারকে দিয়ে, আলাদা করে ভেবেচিন্তে কিছু লিখতে বসা আমার মতো অলস টাইপের মানুষের কাছে বেশ কঠিন ব্যাপার।
আর কাজ করতে করতে যখন ঠিক মতো খাবার খাওয়ার সময় মেলে না, তখন অন্যকিছু করা আরোই অসম্ভব!
অতএব, প্রায় জোর করেই রাত জেগে খানিকটা আঙ্গুল নাড়ানোর চেষ্টা করি। কারণ, খাতা কলম নেই এখন আর!!
কলম নেই বলতেই মনে পড়লো- এই সময়ে কলমের ব্যবহার এতোটাই কমে গেছে যে, সামান্য কিছু লেখার দরকার হলে লোকজন কলমের বদলে মোবাইল বের করে! কারণ, কলম খুঁজে পাওয়া যায় না!! অথচ, একটা সময় ছিল, যখন পকেটে একটা কলম থাকা লোকটিকে গ্রামের মানুষেরা সম্মানের চোখে দেখতেন। একটা কলম – তখন স্টেটাস সিম্বল!
আর এখন পকেটে কলম না থাকাটাই যেন স্ট্যান্ডার্ড! কি অদ্ভুত এই পরিবর্তন।
প্রসঙ্গত বলে রাখি- কলমের বদলে মোবাইলের ব্যবহারকে যদি কেউ ভাবেন খুব স্মার্ট ব্যাপার, তাহলে বলে রাখি- আপনি ভুল করছেন!ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার আপনাকে ইন্টেলিজেন্ট করে তুলছে না সবসময়, বরং রীতিমত একটি অলস মস্তিষ্কের পরিচয় দিচ্ছে!বরং একটি কলম রাখলে আপনার পরিচয় এখনো একটু আলাদাই হবে।
মোবাইলে ল্যাপটপে লেখালেখি করতে অভ্যস্ত নেটিজেন ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে একটি বিখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে একটি গবেষণা হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল – তাঁদের ইংরেজি হাতের লেখা এতো জঘন্য যে পড়া যায় না! এবং এই কারণে ঠিক হয়েছিল – লেখা পরীক্ষা তুলে দিয়ে ল্যাপটপে পরীক্ষা নেয়া উচিত!
অথচ একজন মানুষের হাতের লেখা তাঁর পরিচয়। এটা একটা স্বতন্ত্র ব্যাপার।
যে ঘটনা বলার জন্য এই গল্পের অবতারণা, সেটি বলি।
একজন রোগী এসে বললো – ডাক্তার বাবু আপনি তো ইউএসজি করলেন। আপনাকে ভালো লাগলো খুব। একটা সাহায্য চাইবো।
বললাম – হ্যাঁ বলুন।
রোগী – আমার অন্য একটি অসুখ আছে। সেটি হলো – মানসিক সমস্যা। আমি মাঝে মাঝেই ডিপ্রেশনে ভুগি।
বললাম – সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখান। বা কোন কাউন্সিলরের সাথে কথা বলুন।
– হ্যাঁ সে তো দেখাই। কিন্ত লকডাউনে কলকাতা যেতে পারছি না। আপনি যদি একটু ওষুধ দেন , ভালো হয়।
বললাম – আমি তো এখন রেডিওলজি বাদে জেনারেল মেডিসিন বা অন্য কোন বিষয়ে প্রাকটিস করি না। তাই কোন রোগীকে ওষুধ প্রেসক্রাইবও করি না।
– কিন্ত আপনি তো এমবিবিএসও! চাইলেই পারেন!
বুঝলাম ইনি খানিকটা জানেন।
বললাম – হ্যাঁ তা ঠিক। চাইলেই আমি জেনারেল ফিজিশিয়ান হয়ে প্রাকটিস করতেই পারি। কিন্ত আমি এমডি করতে ঢোকার পরই ঠিক করেছিলাম, যেটা আমার সাবজেক্ট, তার বাইরে গিয়ে কোন রকম প্রাকটিস করবো না। কোন রোগীর জন্য দরকারি চিকিৎসা জানলেও করবো না। আমার নিজের কাছে দেয়া কথা নিজে মেনে চলেছি এখনো অব্দি।
এরপর রোগীর তরফে বারবার অনুরোধ – যদি একটু সাহায্য করেন!
বুঝলাম না হঠাৎ মানসিক রোগের চিকিৎসা কেন আমাকে দিয়ে করাতে চাইছেন! অবশ্য ডাক্তার বাছার বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের চিন্তা ভাবনার ধরন ই আলাদা! কোন কারণে একজন ডাক্তারকে ভালো লাগলে, তাঁকে দিয়েই সব ধরনের চিকিৎসা করাতে চান!
হয়তো খানিকটা মানসিক জোর পান এই ভেবে যে- এই ডাক্তার ঠিক ভালো করে দেবে!
এ বিষয়ে একটি ঘটনা মনে পড়ে – একজন চেনা ডিএম কার্ডিওলজিস্টের প্রেসক্রিপশনে নাম দেখে ভেবেছিলাম রোগীর নিশ্চিত হার্টের কোন সমস্যা আছে! ভালো করে পড়ে দেখলাম – মহিলার আসল সমস্যা ইনফার্টিলিটি!
তো ওনাকে বুঝিয়ে বললাম – দেখুন, আপনাকে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের নাম বলতে পারি। এই বিভাগে তিনি পারদর্শী।
রোগী বললেন – না না। দরকার নেই। আপনিই করে দিন।
শেষে বললাম – দেখুন, সত্যি কথা হলো আমার কোন প্রেসক্রিপশন প্যাড অব্দি নেই। আর এটা আমার মতে ইলিগ্যাল প্রাকটিস। আমি করতে পারবো না। দুঃখিত।
রোগী বললেন – আপনাকে যদি আগের প্রেসক্রিপশন দেখাই, কি করা উচিত একটু বলে দেবেন?
দেখলাম, একে কিছু একটা বলে বিদায় না করলেই নয়। বললাম – দেখান।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা কাগজের ছবি বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন মোবাইলটা! সে ছবির অর্ধেক বোঝা যাচ্ছে না, অর্ধেকে এমন আলো পড়েছে যে লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
বললাম – এটা দেখে কিছু বলা সম্ভব নয়। আপনি কাগজ নিয়ে আসুন।
রোগী আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন – ডাক্তার বাবু, সত্যি বলতে প্রেসক্রিপশন তো আর নেই। মোবাইলে ছবি তুলে রেখেছিলাম বলে কাগজটা আর রাখিনি।
এই হলো এখনকার অবস্থা! ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে এঁরা কি কি যে করেন তাই ভাবি! শতকরা নব্বই জন মানুষ পুরানো প্রেসক্রিপশন রাখেন না। বা সঙ্গে আনেন না। যদিও বা নিয়ে আসেন কোন পোটলাপুটলি থেকে বের করে, তাহলে তাঁর অবস্থা এমন করুণ হয়ে পড়ে যে, রীতিমত সাবধানে ধরতে হয়।
কেউ কেউ আবার এমনই বুদ্ধিমান, আগের রিপোর্ট কিছুতেই দেখাবেন না! ডাক্তারের পরীক্ষা নিতে আসেন যেন!!
দু’একজন তো এমনও বলে – আপনি নিজে দেখে নিন কি সমস্যা!
অথচ চিকিৎসার জন্য এই পুরানো একটি কাগজ যে কত দরকারি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না!
এমনিতেই বেশিরভাগ মানুষ আগে কোন রোগের চিকিৎসা হয়েছে, কি অপারেশন হয়েছে সে সব বলতে পারেন না! তার উপর কাগজগুলোও রাখেন না!
এখন আবার এই নেটিজেনদের পাল্লায় পড়ে দামী প্রেসক্রিপশনখানা একটি ছবি হয়ে যায় মাত্র!
এই সেদিন একজন রোগীর রিপোর্ট করছিলাম।
তাঁর সারা পেটে ছড়িয়ে পড়েছে ক্যান্সারের বাচ্চারা, মানে মেটাস্টেসিস। কিন্ত টিকিটের সাথে রোগীর প্রেসক্রিপশন বলে কিছু নেই।
ফোন করে জানলাম – নিজে থেকেই পেটের স্ক্যান করিয়েছেন! যস্মিন দেশে যদাচার!
তবু ও ভাবলাম – নিশ্চিত খারাপ কিছু ভেবেই ছবি করিয়ে যখন ক্যান্সার ধরা পড়েছে, তখন এরপরে এগোনো সহজ হবে হয়তো।
ফোন করলাম। বললাম – যা কিছু পুরানো কাগজপত্র আছে, নিয়ে আসবেন।
রোগী জানালো – তাঁর বাড়ি অনেক দূরে। আসা তো সম্ভব নয়। যদি বলেন তো মোবাইলে ছবি তুলে পাঠাতে পারি।
দেখলাম মন্দের ভালো যদি কিছু জানা যায়। ব্যাজার মুখে বললাম – পাঠান ।
এরপর খানিক বাদে একজনের মোবাইলের নাম্বার থেকে পরপর আসতে থাকলো ছবি। জানি না, মোবাইল ক্যামেরা হাতে পাওয়ার পরই সবাই কেন ফটোগ্রাফার হয়ে যায়!! কিন্ত কিসের ফটো তুলছে, সেটা না জানলে ফটোগ্রাফিটা যে কেলেঙ্কারি হয়ে যেতে পারে সেটাও বোঝেন না অনেকে!!
প্রথমেই যে ছবিটা খুললাম – সেটা একটা স্ট্যাম্প পেপার!!
দ্বিতীয় ছবিতে গেলাম – সেটি একটি জমির খতিয়ান। আর দলিলের পাতা।
লিখলাম – এগুলো নয়।
ফের দু’মিনিট পর ছবি।
এবারে পঞ্চায়েতের দেয়া রেশন কার্ড!
আমার তখন হাসি ও পাচ্ছে, রাগও হচ্ছে।
তারপরের ছবি এলো টুং করে। দেখলাম – তাতে একটি বাচ্চার হাতের এলোমেলো ইংরেজি লেখা।
উদ্ধার করলাম – একটি ছড়া লেখা।
হাসলাম। কি জানি এরপর হয়তো নিজেদের সংরক্ষিত লাভ লেটার বা অন্য কিছুর ছবি পাঠিয়ে বসবেন!!
বললাম – আরে আপনার ছবির একটাও প্রেসক্রিপশন নয় !! অপারেশন হয়েছিল বললেন তো! সেই কাগজ খুঁজুন! অন্য কিছু দরকার নেই!
অবশেষে নিয়ম মেনেই সেই প্রেসক্রিপশনের কাগজটি আর পাওয়া গেল না!!
আবার এই সেদিন একজন পুরানো রিপোর্ট পাঠাতে গিয়ে নিজের ছবিই পাঠিয়ে দিলেন!! সেটা বলায় আবার বিরক্তও হলেন!! বললেন – দেখুন ঠিক করে! আবার পাঠাচ্ছি।
এবার যেটি পাঠালেন সেটি বার্থ সার্টিফিকেট!!
এই রকম ঝামেলি এখন রেগুলার লেগে আছে।
কেউ কেউ অবশ্য ঠিকঠাক ছবিও রাখেন!
কি জানি কেন মানুষ ভাবছে, এরকম গ্যাজেটের ব্যবহার তাঁকে ইন্টেলিজেন্ট করে তুলবে !
একটা প্রেসক্রিপশন বা অপারেশনের কাগজ, যেটা রোগীর নিজের জন্যই খুব দরকারি, সেটাকে কেউ কেন মোটেই পাত্তা দেয় না?
কত কত বস্তা পোস্টার প্যামফ্লেট দলিল দস্তাবেজ নাগরিকত্বের প্রমাণ সবাই সংরক্ষণ করে রাখে! কিন্ত চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়ে কি সীমাহীন অবহেলা ভাবা যায় না!
তার উপর এইরকম হঠাৎ কাগজ কলম ফেলে একটা মোবাইল কিনেই নেটিজেন হওয়া কোন ভাবেই কাউকে ইন্টেলিজেন্ট করে তোলে না!!
একটি ননসেন্স রোবোট করে তোলে মাত্র।
মানুষজন যদি একটু সহযোগিতা করেন ডাক্তারের সঙ্গে, বহু কঠিন চিকিৎসাই সহজ হয়ে যায়। অথচ এই ‘নেই কাগজ’ এর ঝামেলায় গোটা চিকিৎসা পুনরায় করতে গিয়ে প্রতি পদে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা। ঝামেলায় পড়ছেন রোগীরা।
সম্প্রতি একটি উদ্যোগ অবশ্য নেয়া হবে বলে শুনেছি। দেখা যাক, রোগীদের ডেটা কালেকশন করা সম্ভব হয় কিনা।
ততদিনে মানুষ একটু সাবধান হলে অনেক ঝামেলা কমে যায়।
শেষ ঝামেলির কথা বলে শেষ করবো –
সেদিন একজনের রিপোর্ট করলাম। পেটের ইউএসজি। রিপোর্ট করার পর আমি নিজে একটা প্রোফর্মাতে সব লিখে দিই।
রোগীর হঠাৎ কি হলো কে জানে – সেটা দেখে বললেন – ডাক্তার বাবু, একটা সাহায্য করবেন?
বললাম – কি বলুন।
বললেন – আমার বাপের বাড়ি তো অনেক দূরে। যদি আপনি একটু আমার মোবাইলে ছবি তুলে আপনার রিপোর্টটা মাকে পাঠিয়ে দেন, খুব ভালো হয়।
আসলে এটা বেআইনি। রোগী বোঝেন না।
বাধ্য হয়ে বললাম – আসলে আমিও আপনার মতোই। মোবাইল ব্যবহার করতেই জানি না।
একসময় খুব সুন্দর হাতের লেখা ছিল বলে প্রশংসা করতো সবাই। এই মোবাইলের চক্করে পড়ে লিখতেও ভুলে গেছি! এই দেখুন না – কি জঘন্য হাতের লেখা! কি করে পাঠাই বলুন তো? তার চেয়ে রিপোর্ট বেরোলে আপনিই হাতে লিখে বা ছবি তুলে পাঠিয়ে দেবেন।
বুঝলেন কিনা জানিনা, তবে রোগীর মুখে খানিকটা লজ্জা দেখা গেল।
এ লজ্জা শুধু কি তাঁর? আমার নয়? আমাদের নয়? সমাজ বা দেশের নয়??
আদার ব্যাপারী ডাক্তার, সমাজের নীতি নির্ধারণী জাহাজের খবর নিতে পারলাম কই?? কবে আর আমাদের বলতে দেয়া হলো – ইন্টেলিজেন্স গ্যাজেট থেকে এসে মগজে ঢোকে না, মগজ থেকে গ্যাজেটে ঢোকাতে হয়!!