দুপুর দুটো। এ সময়ে শহুরে বস্তির গলিপথো খানিক ঝিমিয়ে নেয়। ব্যস্ত দোকানিরো টুকুন বিশ্রামের সময়। কিন্তু বিশ্রাম ভাঙলো একদল শিশুর হৈ হৈ চিৎকারে। চাচা চিপস দাও। স্কুল ফেরতা শিশু-কিশোরের ওই দলের প্রায় প্রত্যেকেরই রোজগার রুটিন এটা। শুধু এরা নয় শিশু থেকে কিশোর কিশোরী সব বয়সীদের স্কুল থেকে ফেরার পথে পছন্দসই চিপস চকলেট বা কুড়কুড়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতে দেখেছি আমরা। অথচ এই সময়টা দুপুরের খাবার খাওয়ার! শুধু ওই সময় নয়। সকালে কাজে বেরোনোর তাড়ায় শিশুকে চটজলদি ভোলাতে মায়েরাই তাদের মুখে তুলে দিচ্ছে চিপস কেক বা বিস্কুট। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের প্রচলিত খাবারের পরিবর্তে এই ধরনের খাদ্যে পেট ভরলেও পুষ্টির অভাব হতে বাধ্য।
সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী এদেশের পাঁচ বছরের নিচের ৪৫ শতাংশ শিশু মৃত্যু ঘটে অপুষ্টির কারণে। পাশাপাশি ওই রিপোর্টে উঠে আসা আরও বড় নির্মম সত্যি হলো দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৩৩.৫ শতাংশ শিশুই অপুষ্টির শিকার। যদিও বস্তিবাসীর সঙ্গে সাধারণ পরিবারের শিশুরাও রয়েছে ওই তালিকায়। কারণ বর্তমানে শুধু অর্থাভাব নয় খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের জেরে শিশুদের মধ্যে চরম অপুষ্টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সমীক্ষা বলছে বর্তমানে গ্রাম শহর নির্বিশেষে পাঁচ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও রক্তাল্পতা খুবই সাধারণ ব্যাপার।
গত আড়াই বছর ধরে শহুরে বস্তির মানুষদের মাঝে কাজ করছি আমরা। আমাদের কাজ মূলত গর্ভবতী মা, শিশু ও বয়সন্ধির বাচ্চাদের স্বাস্থ্য নিয়ে। এই কাজ করতে গিয়েই দীর্ঘ সময় ধরে শহরের বস্তির জীবন খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ এমন বস্তিতেও দেখেছি শিশুদের হাতে অভিভাবকরাই পাঁচ দশ টাকা তুলে দিচ্ছেন। কারণ তাদের কাজে বেরোতে হবে বা বাড়ির কাজ সারতে হবে। তাই চিপস চকলেট বা বিস্কুট এর মত প্যাকেটজাত মুশকিল আসান দিয়েই শিশুটির পেট ভরাতে বাধ্য হন তারা। একটু বড় হলে সেই বাচ্চাই ঘুম থেকে উঠে টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে দোকানে। নিজের পছন্দসই মনোহরা খাবার খেয়ে পেট ভরাচ্ছে। হয়তো বেলার দিকে মা বাড়িতে ফিরে রান্না চাপাবেন, সেই সময় পর্যন্ত তাকে নিজের পেট ভরিয়ে রাখতে হবে। আসলে বস্তি জীবনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুর যত্নের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় প্রতিদিনের অর্থ রোজগার বা রোজকার কাজ সারার ব্যবস্থাপনা। তাদের এই প্রবণতার জন্যই দেখেছি বেশিরভাগ বস্তিতেই সকালবেলা কচুরি, পরোটা, সিঙ্গারা, ঘুগনি, মাংসের সিঙ্গারা জাতীয় খাবার নিয়ে পসরা সাজিয়েছে দোকানিরা। তপসিয়া, টেংরা, খিদিরপুর আমাদের কাজের এই তিন বস্তি এলাকাতেই এটা লক্ষ্য করেছি।
আরো একটি বড় সমস্যা হল এইসব বস্তিতে খুব সহজেই মাল-বওয়া, চামড়া কাটা, প্লাস্টিক কাটা বা লোহার ছাট বিক্রির মত খুঁচখাচ কাজ সহজলভ্য। আসলে শিশু শ্রমিক কনসেপ্টটি এখনো আমরা কমিউনিটির ভেতরে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। বেশিরভাগ বস্তিতেই শিশুরা কাজ করবে আর দু’পাচ পয়সা রোজকার করবে এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বাস্তব জীবনের কঠিন রাস্তা বুঝে নিয়ে শিশু যদি উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠে কমিউনিটিতে তার শিশুর যোগ্যতার পরিচয়ক। তাই তার রোজকারের অর্থ দিয়ে সে বাড়ির ডাল ভাত না খেয়ে প্রতিদিন দোকানের বিরিয়ানি খেলে কার বা কি এসে যায়?? বস্তির দরিদ্র পরিবারগুলিতে প্রতিদিনের মজুরি একটি বড় অবলম্বন। এই অনটনের পরিস্থিতির জেরেই তাদের কাছে শিশুটির মজুরিও প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। বেশিরভাগ পরিবারেই প্রতিদিনের খোরাকি জোগাতে আগের দিনের কাজ থেকে পাওয়া অর্থর ওপরে নির্ভর করতে হয়। সেখানে পরিবারের একজনের খোরাকি কমে গেলে মন্দ কি?
যেসব মায়েরা বাইরে বা শ্রমিকের কাজ করেন স্বভাবতই তাদের পক্ষে সারাদিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরে রান্না করা সম্ভব হয় না। ফলে বাচ্চা এদিক ওদিক থেকে খুঁটে খাবে সেটাই স্বাভাবিক। পেট ভরা থাকলে বাচ্চা কাঁদে না। দিনের শেষে পুষ্টির চেয়ে পেট ভরাটাই বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে সবার কাছে।কিন্তু যে বাচ্চা অসুস্থ ঘ্যানঘ্যানে! তাদের?? কাশির ওষুধ খাইয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার মতো ঘটনা বস্তিগুলোতে নতুন নয়।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা কিন্তু অন্য জায়গায়। অপুষ্ট মায়ের শরীর থেকে জন্ম নেওয়া শিশুও অপুষ্টির শিকার হবে। গর্ভবতী মহিলার অপুষ্টি থাকলে তার শিশুটিও নানা সমস্যা নিয়ে জন্ম নেবে এটাই স্বাভাবিক। বাচ্চাদের অপুষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ এটি। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত গর্ভাবস্থায় অপুষ্টি আটকানো যায়নি। শিশুকাল থেকে বয়:সন্ধি পার হয়ে গর্ভাবস্থাতেও মেয়েদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে বিপুলসংখ্যক শিশু অপুষ্টির শিকার হয়ে পড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই অপুষ্টির জন্যই শিশুরা চরম বিপদের মধ্যে আছে।
তবে শিশু অপুষ্টির সমস্যা বর্তমানে শুধু বস্তির নয়, আজকাল শিক্ষিত, সচ্ছল বাবা মায়েরাও বাচ্চাদের হাতে বাইরের খাবার বা প্যাকেটজাত খাবার তুলে দেন। স্কুলের আগে বা স্কুলের পরে টিউশনি বা এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি এটেন্ড করতে গিয়ে পেট ভরায় বাইরের কোন ফাস্টফুডে। বাচ্চার টিফিন বক্সেও ঠাঁই পায় না বাড়ির তৈরি খাবার। আসলে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে অপুষ্টির তে নিবিড় সম্পর্কে রয়েছে তা আমরা কমিউনিটিতে বোঝাতে পারছিনা। পুষ্টি নিয়ে অসচেতনতা সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই আছে। একদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন অপুষ্টির ক্ষেত্রে অভিভাবকের শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কিন্তু আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত পরিবার নয়, পুষ্টির সঙ্গে দারিদ্রতার যেমন সোজাসুজি সম্পর্ক আছে তেমনি সম্পর্ক আছে সচেতনতারো। বিশ্বায়নের পালতোলা হাওয়ায় লাগাম ছাড়া প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্য আমাদের সামনে ছড়িয়ে। আমরা আমাদের সাবেকি খাবার ভুলতে বসেছি। বাড়ির তৈরি মুড়ি, চালভাজা, চিড়ে হাত রুটির যেকোন বিকল্প হয় না তা আমরা আমাদের সন্তানকে বোঝাতে পারিনি। বাইরের বিরিয়ানির থেকে বাড়ির ডাল ভাত সবজিতে কয়েক গুণ বেশি পুষ্টি সে কথা ভুলে গিয়েছি।
আমরা জানি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর প্রধান কাজটা সরকারের। কিন্তু অপুষ্টি দূরীকরণে ন্যাশনাল হেলথ মিশন, প্রতিটা স্কুলে মিড ডে মিল, অঙ্গনওয়াড়ি স্কুল সহ নানান প্রকল্প চললেও এখনো মানুষের মধ্যে মূল কাজটাই সরকার করে উঠতে পারেনি। অপুষ্টি দূরীকরণে খাদ্য দেওয়ার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার নিয়ে সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করাও একটি বড় কাজ ছিল। তার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচারের। স্কুলপাঠ্যে রোগ প্রতিরোধকারী খাদ্যের ভূমিকা, শরীর গঠনকারী খাদ্যের ভূমিকা রেখে শিশুদের মধ্যে খাদ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।