ফাঁকা চেম্বার। আমাদের ডাক্তারবাবু যথারীতি চেম্বারলীন হয়ে সান্ধ্য নিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বয়স হয়েছে তো …. সন্ধ্যায় বড়ো ঘুম পায়। রিসেপনিস্ট সুন্দরী কানে হেডফোন গুঁজে মৃদুমন্দ হাসিমুখে নখে রং মাখছেন। এমন সময় ডাক্তারের খুপরিতে এক বিলিতি কেতাদুরস্ত বৃদ্ধ এসে ঢুকলেন ।
শুভসন্ধ্যা কুশলাদি বিনিময়ের পর ডাক্তার যথাবিহিত সম্মানপুরোসরঃ প্রশ্ন করলেন “কি ঘটনা ভাই ?”
ভাই ডাকটা ভাইয়ের পছন্দ হয়নিকো । উনি বললেন “গুডিভ্নিং আমি মিস্ঠ্যা বি এস মালিক।”
ডাক্তার ঈষৎ বিব্রত হয়ে শুধালেন “পুরো নাম ?”
এবার বিলেতফেরৎ মানুষটি বললেন “ভবেন্দ্র সুন্দর মল্লিক।”
“বয়স?”
“এ্যাঁ?”
“বলি বয়স কতো হলো?”
“সেভেন্টি সিক্স”
ডাক্তার লিখলেন ছিয়াত্তর, “কি অসুবিধে?”
“আই হ্যাভ ভীষণ কাঁধে ব্যথা” ভবেন্দ্র সুন্দর বাঁ কাঁধে ডান হাত ঠ্যাকান। “এভ্রিবডি ইজ টেলিং ফ্রোজেন শোলডার, কিন্তু ঘুমোতে পারি না – সারারাত কাৎরাই।”
ডাক্তার হাঁক পাড়েন “পিসিমা ও পিসিমা, আরেক পেয়ালা চা হবে?” ( সবাই জানেন কোনও অজ্ঞাত কারণে আমাদের বৃদ্ধ ডাক্তার ঐ রূপবতী রিসেপনিস্টকে পিসিমা এবং ওর বরকে পিসিবাবা বলে ডাকেন।)
পিসিমা নখরঞ্জনী রেখে ব্যাজার মুখে উঁকি দ্যান “না একটু আগেই চা খেয়েছেন আর হবে না।”
ভবেন্দ্র সুন্দরবাবু ব্যাপারস্যাপার দেখে একটু ভ্যাবাচ্যাকা। ডাক্তার টাক চুলকে বলেন “আর কিছু অসুবিধে আছে? অন্য কোনও রোগ ব্যাধি?”
” শুগার আছে স্পেশালিস্ট দ্যাখাই – কিডনি আছে স্পেশালিস্ট দেখাই, হার্ট আছে স্পেশালিস্ট দেখাই – প্রস্টেট আছে স্পেশালিস্ট দেখাই”
ডাক্তারের চোখ জ্বলজ্বল করে। বাধা দিয়ে বলেন “বটে? প্রস্টেটও আছে? কে দ্যাখেন?”
ভবেন্দ্রসুন্দর অবজ্ঞাসূচক ঘোঁৎ করেন। “ল্যান্ড্যানের স্পেশালিস্ট ”
ডাক্তার যৎপরনাস্তি অবাক “ল্যান্ড্যানের? সেটা কি রকম?” ওনার গলা দিয়ে বিষ্ময় গড়িয়ে পড়ে ।
“ও শ্যূওর (ডাক্তার চটবেন কিনা বুঝতে পারেন না) আমি ল্যান্ড্যান মানে লন্ডন থেকে ফেরার সময় ওষুধের ডোজ ঠিক করে এনেছি ..”
“সেটা কতো বছর আগে?”
“ধরুন না ফাইভ ইয়ার্স আগে।”
বুড়ো ডাক্তার শূন্য চায়ের পেয়ালায় করুণ দৃষ্টি হেনে বলেন “পিএসএ কতো?”
“পিএসএ? সেটা কি?”
“প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন …ওটা প্রস্টেটের রক্ত পরীক্ষা।”
“শুনুন মশয় আমার প্রস্টেট একদম ঠিক আছে – ন্যো প্রোব্লেম -ওক্কে? কেবল কাঁধে অসহ্য ব্যথা। দুবার এক্সরে করেছি। শুগার ওক্কে। আপনি শুধু ব্যথাটা ..” ভদ্রলোক ঝুঁকে পড়ে যন্ত্রণায় মুখ ব্যাঁকান। “উফ মাঝে মাঝে ভেতরটা পুরো ঝিলিক মেরে ওঠে।”
“কতো জনকে দেখিয়েছেন ?”
“তিন চার জনকে …এক্স রে ঠিক ছিলো মাগো বড্ড ব্যথা ..” ভদ্রলোক যন্ত্রণায় বেঁকে যান “ব্যথার ওষুধেও কাজ হচ্ছে না”
“হুমমমমমমম চিৎপাৎ হয়ে যান ”
“এ্যাঁ?”
“উঠে শুয়ে পড়ুন ”
বুড়ো ডাক্তার ঠুকে ঠাকে টিপে টুপে ভবেন্দ্রবাবুকে পরীক্ষা করেন। “উঠে আসুন ভবেন্দ্রবাবু।”
ভবেন্দ্রবাবু উঠে এসে বসেন।
“কিস্যু পেলাম না ..সব তো ওপর থেকে ঠিকই আছে”
“সবাই তো তাই বলছে”
ডাক্তার চশমাটা খোলেন। গোলগোল চোখে ভবেন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে রৈলেন। হাঁক পাড়লেন “পিসিমা …” তারপরে বললেন “ও বাবা আর তো চা দেবে না বলেছে। ” খানিকটা সময় টেবিলে টরেটক্কা বাজালেন তারপর বললেন “ও ভবেনবাবু আপনি কি জানতে চান আপনার কি হয়েছে?”
ভবেন্দ্রবাবু রীতিমতো রুষ্ট “নিশ্চয়ই চাই।”
“তাইলে একটা ভাগ্যপরীক্ষা করা যাক কি বলেন?” রোগী রাগে গনগনে এবং চুপ -আমাদের বুড়ো খসখস করে একটা রক্তপরীক্ষা লিখে খচাং করে ব্যবস্থাপত্রটা (prescription) ছিঁড়ে ওনার হাতে ধরিয়ে দিলেন। “এই পরীক্ষাটা চটপট করিয়ে আনুন দেখি।”
ভবেনবাবু গজগজ করতে করতে চলে গেলেন “আবার সেই পিএসএ টেস্ট করাতে হবে যতসব কচুপোড়ার কমিশনখোর ডাক্তার …. …. এদের জন্যেই …. ..” আরও কিছু বলতে বলতে রোগী অপসৃত হন।
এসব কথা আজকাল ডাক্তারের সয়ে গেছে তাই আড়মোড়া ভেঙে আবার উনি নিদ্রাকর্ষণে মগ্ন হয়ে পড়েন।
★★★★★★★
পরের সন্ধ্যাকালে ডাক্তারের ঝর্ঝরে পুরোনো স্কুটারের পাশে একটা বিরাট লম্বা বিদেশী গাড়ি এসে দাঁড়ালো। সেই বিলেতফেরৎ বাবুটি সমস্ত আদবকায়দা ভুলে সুন্দরী পিসিমার কুটিল ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে দরজা টরজা ঠেলে হাঁফাতে হাঁফাতে সোজা বুড়ো ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়লেন।
ডাক্তার তখন আপন খেয়ালে নিজের টাকে হাত বোলাচ্ছিলেন। করজোড়ে ভবেন্দ্র সুন্দরকে আপ্যায়ন করলেন। ভবেন্দ্রবাবুর ওসব দিকে নজর নেই “দেখুন পিএসএ ..এতো মশাই ভয়ঙ্কর বেশী দ্যাখাচ্ছে একশো ঊনত্রিশ..….. ও গড”
ডাক্তার চশমাটা পরে দেখলেন “হুঁ বড্ড বেশী। আমি মানে … যাই হোক ভবাবাবু চিন্তার কিছু নেই … ঠিক হয়ে যাবে ..”
ভবেন্দ্রবাবু ফিসফিস করে বললেন “এটা কিসের টেস্ট?”
ডাক্তার অন্যমনে বললেন “কর্কট মানে ক্যানসারের পরীক্ষা ….এটাকে ক্যানসার মার্কার বলতে পারেন …”
“ক্যাহ্যানসাআর?” ভবেন্দ্রবাবুর গলাটা হাহাকারের মতো শোনায়।
ডাক্তার নীরবে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানান। “যেহেতু প্রস্টেট ক্যানসার হাড়ের ভেতরে ছড়ায় তাই আমার মনে হয়েছিলো … হয়তো এটা..…”
“আমি তো ওষুধ ঠিকমতোই খেয়েছি তাহলে …..ডাক্তার এটা কী বোঝাচ্ছে? প্রস্টেট জিনিসটা কি? ওষুধে ভালো থাকে না? আমি কি আবার অন্য জায়গা থেকে আরেকটা টেস্ট করাবো?”একঝাঁক প্রশ্ন করে ভবেনবাবু ক্লান্ত হয়ে পড়েন ।
ডাক্তার কিঞ্চিৎ দিশেহারা। ঘাবড়ে গেলেই চা পান করা ওনার বদভ্যাস। ডাক্তার গতকালের কথা ভোলেননি – তাই অতীব সুমিষ্ট স্বরে ডাক পাড়েন “পিসিমা তুই একটুসখানি দুকাপ চা এনে দিবি?”
পিসিমা নাক কুঁচকে টেবিল থেকে আরশোলা পড়া চায়ের গেলাসটা তুলে নিয়ে চা আনতে চলে যায়।
“পিসিমার চা আনার ফাঁকেই আমরা আপনার প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে থাকি?”
ঘর্মাক্ত ভবেন্দ্রবাবু ভুল করে টেবিলের ওপর রাখা ডাক্তারের রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে ফ্যাঁচ করে নাকটাও ঝেড়ে নিয়ে রুমালটা ফেরৎ দ্যান।
“দেখুন মশয় সহজ ভাষায় বলতে গেলে আমাদের মূত্রথলি থেকে মূত্রনালী বেরোনোর সময় নালীটার চারপাশ ঘিরে একটা গ্ল্যান্ড থাকে – এটার নাম প্রস্টেট। বয়সের সঙ্গে প্রায় সকল পুরুষেরই এটা বড়ো হয়। আর প্রতি আটত্রিশ জন প্রস্টেট বড়ো হওয়া রোগীর একজনের ক্ষেত্রে এটা ক্যানসারে পরিণত হয় …(ভবেন্দ্রসুন্দর চোখ কপালে তোলেন) না এখান থেকে হর্মোন টর্মোন কিচ্ছু বেরোয় না – যৌনমিলনের সময় কিছু রস কিছু এনজাইম লবণ টবন …”
ভবেন্দ্রসুন্দর অধৈর্য হয়ে পড়েছেন , বাধা দিয়ে বলেন “আহা এসব কথা বাদ দিয়ে বলুন ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও আমার ক্যানো এরকম রোগ হলো?”
এমন সময় পিসিমা দুকাপ চা নিয়ে ঢুকে বললো “মনোজ বলেছে ধারবাকিতে আর চা দেবে না হাজার টাকা মতো ডিউ হয়েছে আগামীকালের মধ্যে দিয়ে দিতে…. বুঝলেন?”
ডাক্তার টাকে হাত বোলাতে লাগলেন। বলাই বাহুল্য কথাটা ওনার পছন্দ হয়নিকো।
পিসিমা ফুট কাটলো “টাকে হাত বুলিয়ে লাভ নেই আগামীকাল টাকা আনবেন” বলে দরজা টেনে নিজের জায়গায় চলে গেলো।
ডাক্তার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন “যতো সব…. যাগগে ছাড়ুন ….. আসলে এসব ওষুধে তো ক্যানসার প্রতিরোধ করে না। কেবলমাত্র আপনার কষ্ট লাঘব করে… পেচ্ছাপটা যাতে সহজে হয় সেটুকুই দ্যাখে …তাই ওষুধ খাওয়া মানেই ক্যানসার হবে না এই ইয়েটা পুরোপুরি ভুল। আর এই ক্যানসার মূলতঃ হাড়েই ছড়ায়।”
ভবেন্দ্রবাবু খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন। বোধহয় ধাক্কাটা বড্ড জোরালো হয়ে গেছে। বেচারা লন্ডনের ওষুধ খেয়েও এসব হবে তা ভাবেন নি। আসলে চিকিৎসা পদ্ধতি তো সব জায়গাতেই মোটামুটি এক হয়তো কোথাও শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি বেশী আধুনিক ব্যস এই পর্যন্তই কিন্তু নিয়ম মেনে নিয়মিত ডাক্তার দ্যাখানোটা বাধ্যতামূলক।
“চিয়ার আপ ভাই …লড়াই তো সবে শুরু – এখনি ভেঙে পড়লে হবে ? নিন চায়ে চুমুক দিন .. ঠান্ডা হয়ে যাবে …”
“মানে দুধ চা তো স্বাস্থ্যের পক্ষে ইয়ে ….” বলে ইতস্ততঃ করেও ভদ্রলোক চায়ে চুমুক দ্যান । গর্মাগ্রম ধূম্রবতী চাঙায়নী সুধাপানেও ভবেন্দ্রবাবুর বিমর্ষতা কাটে না “আমি তো বুঝতেই পারলাম না যে এ্যাতো বড়ো একটা রোগ… আচ্ছা আমি বুঝবো কি করে যে আমার ইয়ে মানে এমন ভয়ঙ্কর একটা ইয়ে আমার শরীরে ঢুকেছে?” ভবেন্দ্রবাবু এখনও হতচকিত।
ডাক্তারের ঝুলভরা ময়লাজমা ঘরে প্রচুর আরশোলা মহানন্দে থাকে তারই একটা অজানাকে জানার উদ্দেশে ছাদে উঠেছিলো। ছাদে একটা টিকটিকি সেই মোটাসোটা আর্শুলাকে টার্গেট করে খাওয়ার জন্যে এগোচ্ছিলো। ডাক্তার কপাল আর চশমার ফাঁক দিয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ওনার দৃষ্টি অনুসরণ করে ভবেন্দ্রবাবুও তাকালেন । ডাক্তার ফিসফিসিয়ে বললেন ” টিকটিকি … নিঃশব্দে শিকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তারপরেই … কপাৎ …. ” কিন্তু মোটকু আরশোলাটা হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে পালিয়ে গেলো ।
“যাহ্ ফসকে গেলো” দম ছাড়লেন ভবেনবাবু ।
“হ্যাঁ শিকারকেও আত্মরক্ষার জন্যে সবসময় সচেতন থাকতে হয়। ….ও হ্যাঁ বলছিলেন বুঝবেন কি করে যে আপনার ইয়ে হচ্ছে তাই তো?”
ভবেনবাবু ঘাড় নাড়েন।
“ক্যানসার হলো কৈশোরের প্রেমের মতো নিঃশব্দসঞ্চারী …. যখন এসে ধাক্কা মারে কেবলমাত্র তখনই বোঝা যায় সে এসেছে। অথবা ঐ টিকটিকিটার মতোন নিঃশব্দ চরণে এগিয়ে আসে। তাই আপনাকে বছরে অন্ততঃ একবার টেস্ট ফেস্ট গুলো করাতেই হবে। আর ইয়ে… আপনাকে আরশোলা বললে আপনি রাগ করবেন না তো?”
ভবেন্দ্রবাবু ঘাড়নেড়ে জানান যে না রাগ করবেন না ।
“আক্রমণ হলেই আপনাকে আত্মরক্ষার জন্যে ঐ হোঁৎকা আরশোলাটার মতো মৃত্যুদূতের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে হবে … এবং সেটা খুব চটপট। আজকাল আর ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়। চটপট চিকিৎসা করতে হবে … রোগটা কতদূর ছড়িয়েছে দেখে নিয়ে তারপর ঠিকঠাক ওষুধ খেলেই সম্ভবতঃ … হ্যাঁ খুব সম্ভব আপনি ভালো হয়ে যাবেন। তাই এক্ষুনি আপনাকে অঙ্কোলজিস্টের কাছে দৌড়তে হবে। ক্যানসার মানেই জীবন শেষ তা কিন্তু নয়।”
ভবেন্দ্রবাবু উঠছিলেন ডাক্তার ধমক দিলেন “ইকি চা’টা শেষ করে যান। দেখছেন তো ধারদেনা করে চা খাওয়াচ্ছি । ”
ভবেন্দ্রবাবু খুশ মেজাজে এক গাল হেসে দুধ চা পানার্থে বসে পড়েন। ডাক্তারও চাঙায়নী সুধায় চীয়ার্স করেন ।
আমরাও প্রার্থনা করি ভবেন্দ্র সুন্দরবাবু সুস্থ হয়ে উঠুন ।
অসাধারণ লেখা, শ্রদ্ধেয় ডাক্তার বাবু
ধন্যবাদ
সুলিখিত। ভালো লাগলো। তবে ধারে চা খেয়ে তা মেটাবার মত পয়সা ডাক্তারের নেই, এমনটা পড়বার সময় হোঁচট খাচ্ছিলাম বারবার।
আছে আছে । বুড়ো অক্ষম হাতুড়ে আছেন ।
খুব ভালো লাগলো। নিজেকে নিয়ে মজা করা একটি বিশেষ আর্ট। সবাই পারেন না। ডা: ঘোষ পারেন। আর তাই কোন কঠিন বিষয় সহজবোধ্য হয়ে ওঠে।
ধন্যবাদ ।